মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব - ৭৩
মাতঙ্গিনী হাজরা (শহীদ স্বাধীনতা সংগ্রামী, তমলুক)
ভাস্করব্রত পতি
'দুড়ুম’! একটা গুলি ছুটে এসে গুঁড়িয়ে দিল বৃদ্ধার বাম হাতটা। ডান হাতে পতাকাটি নিয়ে ফের ছুটে চললেন বানপুকুরের পাড় ধরে।
‘দুড়ুম’! আরও একটি গুলি। ডান হাতটাও জখম। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিধবার সাদা থান কাপড়টা। জখম দু'হাত দিয়ে, বুকের মাঝে পতাকাদণ্ডটা আঁকড়ে বৃদ্ধা ছুটলেন। মুখে 'বন্দেমাতরম'। 'ইংরেজ ভারত ছাড়ো'।
‘দুড়ুম'! এবার কপালের কাছে বাম চোখের নিচে। খুলি ফাটিয়ে বেরিয়ে গেল গুলিটা। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। তখনও তাঁর বুকে চেপে ধরা সেই পতাকাটা। একটা পুলিশ এসে পা দিয়ে সেই পতাকাটাকে ফেলে দিল মাটিতে। নিথর হয়ে পড়ে রইলেন 'গান্ধীবুড়ি'। 'মেদিনীপুরের মা' মাতঙ্গিনী হাজরা।
সেদিনটা ছিল ১৯৪২ এর ২৯ শে সেপ্টেম্বর। তখন বেলা ৩ টা। বিপ্লবী জনতার মিছিল চলছে তমলুক থানা ও দেওয়ানি আদালত দখলের লক্ষ্যে। তমলুক শহরের চারটে প্রধান প্রবেশ পথে সেই মিছিল আটকানোর জন্য মোতায়েন করা হয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ। থানার কাছে দায়িত্বে অফিসার মণিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। হ্যামিল্টন হাইস্কুলের কাছে চৌমাথা মোড়ে দায়িত্বে অপূর্ব ঘোষের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশবাহিনী। শংকরআড়া পুলের কাছেও পুলিশ পিকেট। আর শহরের উত্তরে কোর্টের পিছনে বানপুকুর পাড়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অনিল ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বন্দুকধারী পুলিশবাহিনী।
বিপ্লবীদের মুখে স্লোগান 'ইংরেজ ভারত ছাড়ো', 'গান্ধীজী কি জয়', “বন্দেমাতরম’। শহরের উত্তর দিকের গ্রাম হোগলা, আলিনান, জামিট্যা, সোয়াদিঘি, খোসখানা, ডিমারী, বিশ্বাস, ধলহরা, মথুরি, সিউরি, ক্ষারুই থেকে দলে দলে জনতা রূপনারায়ণের পাড় ধরে হেঁটে আসছে সেইসব শ্লোগান আওড়াতে আওড়াতে। পায়রাটুঙ্গি খালের কাছে এসে মিছিলের সামনে উদ্দীপিত বক্তব্য রাখলেন প্রফুল্লকুমার বসু।
গায়ের রক্ত ফুটতে শুরু করেছে জনতার। না, আর তো সহ্য করা যায়না ইংরেজদের। সামনে বিশাল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পথ আটকে দাঁড়িয়ে। আর এগনো চলবেনা। উদ্যত বন্দুকের সামনে তখন ফুটন্ত উদ্বেলিত জনতা। হঠাৎই মথুরি গ্রামের একটা ১৩ বছরের বালক লক্ষ্মীনারায়ণ দাস ছুটে গিয়ে এক ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইলেন বেয়নেট ভরা বন্দুক। এত বড় স্পর্ধা! বন্দুকের বাঁট দিয়ে থেঁতলে খুন করে ফেলা হলো তাঁকে। মৃত্যুযন্ত্রণার গগনভেদী চিৎকার কিছুটা থমকে দিল সেই জনতাকে।
ঠিক তখনই মিছিলের পিছন দিক থেকে এক ৭৩ বছরের বৃদ্ধা লোকজন ঠেলে সামনে এসে বললেন - 'কি হয়েছে রে? এত ঠেলাঠেলি কেন'? সব দেখে তিনি জানলেন, বুঝলেন, অনুভব করলেন। গায়ের ফুলে যাওয়া শিরা উপশিরাগুলোয় তখন রক্তের উন্মত্ত ছোটাছুটি। বললেন - 'এবার আমার সময় হয়েছে'।
একজনের হাত থেকে একটা পতাকা কেড়ে একটা বাড়ির দালানে উঠে সেই ‘ভীতু’ জনতার সামনে ফুলকি ওড়ালেন মুখ দিয়ে। 'কাপুরুষরা ফিরে যা। আমি একলাই যাচ্ছি। পিছন ফিরে চাইবনা। দেখবনা কেউ এলো কি এলোনা'।
পতাকাটি নিয়ে শুরু করলেন দৌড়। দেশমুক্তির অদম্য জেদ তখন সেই বৃদ্ধার অন্তরে। ‘খবরদার, এক পা এগোলেই গুলি করব' -- ব্রিটিশ পুলিশের হুমকি। যদিও সে হুমকি টলাতে পারেনি বৃদ্ধার গতিপথ। লক্ষ্য তখন পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচন। ভারতের স্বাধীনতা।
'দুড়ুম', 'দুড়ুম'!! গর্জে উঠলো ব্রিটিশ পুলিশের গুলি।
আজ থেকে ৮১ বছর আগে এই সেপ্টেম্বরে মেদিনীপুরের মাটিতে এক অকুতোভয় বিধবা মহিলার যে আত্মত্যাগ দেখেছিল ব্রিটিশ পুলিশ, তাতেই তাঁদের উপলব্ধি হয়েছিল যে, আর বেশিদিন এদেশে শাসন করা সম্ভব নয়। তার মাত্র পাঁচ বছর পরেই ভারত ছেড়ে পালাতে হয়েছিল তাঁদের। আমাদের দেশ পেয়েছিল স্বাধীনতার আস্বাদন।
সেদিন শুধু মাতঙ্গিনী হাজরা নয়, ব্রিটিশের গুলিতে তমলুকের মাটি লাল হয়েছিল লক্ষ্মীনারায়ণ দাস (মথুরি, ১৩), পুরীমাধব প্রামাণিক (দ্বারিবেড়িয়া, ১২), নগেন্দ্রনাথ সামন্ত (আলিনান, ৩০), জীবনকৃষ্ণ বেরা (মাগুরী, ১৮), পূর্ণচন্দ্ৰ মাইতি (ঘাটুয়াল, ২৪), নিরঞ্জন জানা (তমলুক, ২৭), রামেশ্বর বেরা (কিয়াখালী, ৪০), নিরঞ্জন পারিয়াল (হিজলবেড়িয়া), উপেন্দ্রনাথ জানা (খঞ্চি, ২৮), বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী (নিকাশী, ২৫) এবং ভূষণচন্দ্র জানা (খঞ্চি, ১৬)। মোট বারো জন সেদিন শহীদ হয়েছিলেন। গুরুতর আহত হয়েছিলেন কুড়ি জন। এঁদের কোনও না কোনও অঙ্গহানি ঘটেছিল। আলাশুলির বীরেন্দ্রনাথ মাঝির বাম হাত কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। আর পুরো অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব ছিল অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র কর, প্রফুল্লকুমার বসু এবং গুণধর ভৌমিকের ওপর।
কে এই মাতঙ্গিনী হাজরা? কেন তিনি 'গান্ধীবুড়ি'? তিনি আত্মবলিদানের অনুপ্রেরণা কিভাবে পেলেন? এজন্য আমাদের যেতে হবে মেদিনীপুর জেলার তমলুকের প্রত্যন্ত হোগলা এবং আলিনান গ্রামে।
১৮৮৮ সাল। মাতঙ্গিনী হাজরার পরণে এসেছে বৈধব্যের পোশাক। ফুল ফোটার আগেই যেন শুকিয়ে যাওয়া। চলে এলেন বাপের বাড়ি হোগলাতে। শুরু হলো জীবনযন্ত্রণার উপশমে এক অষ্টাদশী বিধবার অনন্য লড়াই। আজ এর বাড়ি, কাল ওর বাড়ি। গত হলেন বাবা মাও। পাহাড়প্রমাণ সমস্যা জগদ্দল পাথর হয়ে এবার দাঁড়ালো ‘মাতু’র জীবনে। ডাকনাম ছিল 'মাতু'। ফিরে গেলেন স্বামীর বাড়ি আলিনান গ্রামে। সেখানে স্বামীর ভিটার পাশে একটা ছোট্ট গোলাঘরে থেকে শুরু হলো দিনাতিপাত। সেই বাড়ি আজও আছে সেদিনের স্মৃতি আগলে। গোরু পুষে, দুধ ঘুঁটে বেচে যৎসামান্য আয়। অজয়কুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন ‘সাধারণ কৃষকের বাড়িতে সন্তানহীনা বাল্য বিধবা, লেখাপড়া জানতনা। ঝাঁটপাট দেওয়া, গোবর ন্যাতা দেওয়া, বাসন মাজা, ধান সিদ্ধ করা, চৌকিতে ধান ভানা, ভাত রাঁধা এইসব গৃহস্থালির কাজ করে জীবন কাটাচ্ছিল। সে আমাদের দলে যোগ দিল। আমার চেয়ে প্রায় ৩০ বছরের বড় ছিল, তবু আমাকে দাদা বলত'।
তিনি নিজের জীবনকে কষ্টের দোহাই দিয়ে ভাসিয়ে দেননি। লড়াই সংগ্রাম তো তাঁর মজ্জাগত। যখন কোনও প্রতিবেশী কলেরা, বসন্ততে হয়ে উঠত মৃত্যুপথযাত্রী, তখন তাঁর পাশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত অন্যেরা। তখন সেখানে ছুটে যেতেন মাতঙ্গিনী। মৃত্যু তাঁর পায়ের ভৃত্য। ভয় পেতেননা মরতে। সেই জীবনধারা প্রবাহিত জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলে তবেই তাঁর ‘ছুটি’।
১৯৩০ এর ১২ ই মার্চ মহাত্মা গান্ধী শুরু করলেন ডাণ্ডি অভিযান। সঙ্গে ৭৯ জন সত্যাগ্রহী। সবরমতী থেকে ডাণ্ডি। লবণ আইন আন্দোলন সেদিন গুজরাট থেকে ছড়িয়ে পড়ল সারা ভারতে। মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামও বাদ গেলনা। কুঁড়ে ঘরের বাসিন্দা মাতঙ্গিনীর অন্তরে ঠাঁই নিলেন জাতির জনক। দুরারোগ্য ‘আর্থাইটিস’ রোগে আক্রান্ত মাতঙ্গিনী যন্ত্রণার উপশমে খেতেন আফিম। পরবর্তীতে সেটাই তাঁর নেশায় পরিণত হয়। কিন্তু গান্ধীজীর আদর্শ গ্রহণের পর বদলে গেল জীবন। বিপ্লবী কমলা দাশগুপ্ত লিখেছেন – 'এককালের অভ্যস্ত নেশার জন্য যখনই তাঁর কষ্ট হত, তখনই তিনি ‘গান্ধীজী’ ‘গান্ধীজী’ ‘গান্ধীজী' বলে তিন গণ্ডুষ জল পান করতেন। তাঁর নেশার কষ্ট অচিরে দূর হয়ে যেত। এত বড় মনোবল এবং গান্ধীজীর প্রতি এমন অটুট নিষ্ঠা ছিল তাঁর। বাতরোগে আর কখনও তাঁর কষ্ট হয় নাই'।
গান্ধীজীর মতোই সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই মহিলা। তাই হয়ে উঠেছিলেন ‘গান্ধীবুড়ি’। জীবনের সম্বল বলতে ছিল একটি পেতলের থালা, বাটি, গ্লাস, ঘটি আর জামবাটি। অসুখেও ঔষধ খেতেন না। মাতঙ্গিনীকে সামনে থেকে দেখা প্রিয়নাথ জানা স্মৃতিকথায় লিখেছেন – ‘মাতঙ্গিনীদেবী ছিলেন নিরামিষভোজী। নিজের বাড়িতেই তিনি শাকসবজি চাষ করতেন। যা ফসল হত তা নিয়ে রান্না করে খেতেন, অতিরিক্ত সবজি প্রতিবেশীদের দিয়ে দিতেন। দিনে আতপচালের ভাত এবং রাতে পরটা, চালভাজা বা মুড়ি প্রভৃতি খেতেন। বরাবর তিনি স্বপাকে অর্থাৎ নিজ হাতে রান্না করে খেতেন। উনি প্রত্যহ সকালে স্নান সেরে তুলসী মঞ্চে জল দিয়ে ঠাকুরের নাম করবার পর কিছু আহার করতেন। বিধবা হওয়ার পর ছোট ছোট করে চুল ছাঁটাতেন। টিকি রাখতেন, আর কপালে তিলক কাটতেন'। মাতঙ্গিনীর সতীনের ছেলে মহেন্দ্রর নাতি মদনমোহন হাজরা জানান, 'পাশাপাশি দুটো টালির বাড়ি। আমাদের বাড়িতে মাছ মাংস পিঁয়াজ রসুন খাওয়া হয় বলে বড়মা স্বেচ্ছায় গোলাঘরে একা থাকতেন। সেখানেই তাঁর কেটেছে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো। সেই গোলাঘর থেকে রান্না করে খেয়ে দেয়েই দুপুরে যান তমলুক আদালত দখল করতে'।
১৯৩২ এর ২৬ শে জানুয়ারি তিনি জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। আইন অমান্য আন্দোলনে বিপ্লবীরা পেল এক সংগ্রামী মহিলাকে। ঠিক এক বছর বাদে ১৯৩৩ এর ১৭ ই জানুয়ারি তিনি ঘটালেন অভূতপূর্ব কীর্তি। সেদিন তমলুকে এসেছিলেন বাংলার গভর্নর অ্যান্ডারসন সাহেব। কিন্তু মাতঙ্গিনী তো তা চাননা। তাই তাঁর মুখে ধ্বনি ‘লাটসাহেব গো ব্যাক'। সেদিন শৈলবালা বর্মণ, মুক্তকেশী সামন্ত, মোক্ষদাময়ী সামন্ত, কামিনীবালা বর্মণ এবং বাসন্তীদেবীকে নিয়ে তমলুক থানায় ‘গো ব্যাক’ ধ্বনি দিলেন। ফলে ব্রিটিশ পুলিশের আক্রমণে হলেন রক্তাক্ত। ছয় মাসের জন্য বহরমপুর জেলে যেতে হলো তাঁকে। মাতঙ্গিনীর অন্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামে বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন সিউরি গ্রামের গুণধর জানা। নিয়মিত যাতায়াত ছিল ঐ বাড়িতে। দারুণ সখ্যতা ছিল গুণধরবাবুর স্ত্রী ললিতার সাথে। এখানেই তিনি গান্ধীজীর ছবি সংগ্রহ করেছিলেন। মনে মনে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন দেশমাতৃকার মুক্তির স্বপ্নে।
আজকের বিলিওনিয়ার বিজ্ঞানী মণি ভৌমিক তখন বারো বছরের বালক। সেদিনের সেই কপর্দকশূন্য বৃদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন তাঁর ‘বন্ধু’। সেই বর্ণনা লিখেছেন - ‘মাতঙ্গিনীর বাবার বাড়ির অবস্থা ভালো না থাকায় মাত্র বারো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে দেওয়া হয়েছিল ষাট বছরের ত্রিলোচনবাবুর সঙ্গে। মাতঙ্গিনী বিধবা হলেন আঠারো বছর বয়সে। মাতঙ্গিনী কিন্তু ধান ভাঙার কাজ করে জীবনধারণ করলেন একটি ঝুপড়ির মধ্যে। আমি তখন হাড় জিরজিরে নিঃসঙ্গ এক বালকমাত্র। মাতঙ্গিনী হয়ে উঠলেন আমার বন্ধু এবং উপদেষ্টা'।
সেই মাতঙ্গিনী ‘বন্ধু’ হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবীদেরও। আলিনান গ্রামেই (যা এখন ১৪ বিঘা শ্মশান নামে পরিচিত) লবণ তৈরির একটি শিবির খোলা হয়। যার মধ্যমণি ছিলেন তিনিই। ‘চৌকিদারী ট্যাক্স বন্ধ' আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল সামনের সারিতেই। ১৯৩৩ এ শ্রীরামপুরে মহকুমা কংগ্রেস সম্মেলনে তিনি ছিলেন প্রতিনিধি। ১২ কিমি পথ পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন তিনি। তেমনি ১৯৩৮ এ নাড়াজোলে তিনদিনের সম্মেলনে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিনিধি। সেদিনও তাঁর উদ্দীপিত বক্তৃতা ছিল প্রতিনিধিদের উপরি পাওনা। মাতঙ্গিনীর বাড়ি থেকে দু’কিমি দূরে ছিল যশোবন্তপুর গ্রামে বিপ্লবীদের গোপন শিবির। সেই শিবির দেখভাল করতেন তিনি। সেখানে চরকা কাটতেন আর শিবির আগলাতেন। তাঁর বাড়ি থেকে শিবিরের আবাসিকদের জন্য নিয়ে আসতেন চালভাজা, ছোলাভাজা, চিড়ে, গুড়, মুড়ি, নারকেল থেকে নিজের বাড়ির বাগানের নানা আনাজপত্র।
মাতঙ্গিনীকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন একজন বাঙালি অফিসার। তিনি অনিল ভট্টাচার্য। ব্রিটিশ পদলেহনের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি। বানপুকুরের পাড়ে মাতঙ্গিনী সহ পাঁচজনের মৃতদেহ পড়েছিল সারারাত। পরের দিন সকালে সেই মৃতদেহের ছবি তুললেন তমলুকের বতুবাবু তথা নরেশচন্দ্র মুখার্জি। এরপর আবাসবাড়ি এলাকার খালপাড়ে হ্যাজাক লাইট জ্বেলে মাতঙ্গিনী সহ অন্যান্যদের পোস্টমর্টেম করলেন ডাঃ কালীশংকর নন্দ ও ডাঃ মি. হালদার। সরকার পারিশ্রমিক দিল ২৫০ টাকা। এরপর তিনদিন ধরে মৃতদেহগুলি পড়েছিল পায়রাটুঙ্গি মর্গে। বাড়ির লোকজনদের হাতে দেওয়া হয়নি মৃতদেহগুলি। পচন শুরু হয়ে যায় দেহগুলিতে। দুর্গন্ধে টেকা দায়। তখন স্বামী বিশোকাত্মানন্দ মহারাজের উদ্যোগে ইংরেজ সরকার রাজি হয় হিন্দুমতে দাহ করার। ১ লা অক্টোবরের গভীর রাত। ডাক পড়ল গোবর্ধন জানা, রহিকা, রবি, কড়ু, গৌরা প্রমুখ ডোমদের। পৌরসভার ২ টি মহিষটানা গাড়ি নিয়ে মৃতদেহগুলি কড়া মিলিটারি প্রহরায় নিয়ে আসা হলো শহরের উত্তর প্রান্তে পায়রাটুঙ্গি খালের ধারে। যাবতীয় খরচ জোগালেন মন্মথনাথ বসু এবং জয়দেব ব্যানার্জি। শবযাত্রী হিসেবে ছিলেন বিশ্বরঞ্জন মাইতি, হরিপদ দোলুই, হেম মহারাজ, রোহিত অধিকারী, কালী পণ্ডা, দেবব্রত সিংহ, নিশীথরঞ্জন সিংহ, সর্দার সিংহ, চণ্ডী ভট্টাচার্য, রাম মাইতি, হরনারায়ণ মাইতি প্রমুখ। পৃথক পৃথক চিতায় জ্বলে উঠল বারো শহীদের মৃতদেহ। ভোর হয়ে আসছে তখন। নিভু নিভু চিতায় ফুল ছড়িয়ে শহীদতর্পণ করলেন দুই বর্ষীয়ান মহিলা – রাজলক্ষ্মী সিংহ ও ইন্দুপ্রভা চক্রবর্তী। চোখের জলে চিরদিনের জন্য বিলীন হয়ে গেলেন বাংলার বীরযোদ্ধারা।
🍂
1 Comments
বীরাঙ্গনা
ReplyDelete