জ্বলদর্চি

দুর্গাষষ্ঠী /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৯২
দুর্গাষষ্ঠী

ভাস্করব্রত পতি

আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিনে সন্তানের মায়েরা সারাদিন উপোস করে থেকে ষষ্ঠীর পুজো করে। পূজোর শেষে ষষ্ঠী পূজোর প্রসাদ খায়। এই ষষ্ঠীর পূজোর উপচার যাঁরা পালন করেন তাঁদের সেদিন ভাত খাওয়া চলে না। রাত্রে ফল ফুলারি খেয়ে থাকতে হয়। আর খাওয়ার আগে অবশ্যই দুর্গার ব্রতকথা শুনতে হয়। এই লৌকিক উৎসবে প্রয়োজন হয় আতপচালের নৈবেদ্য, মিষ্টান্ন, ফুল, দূর্বা, ধূপ, ধুনো, প্রদীপ, ফল ইত্যাদি। দুর্গাষষ্ঠীর আলপনায় থাকে বেলগাছ। দুর্গাষষ্ঠী পালন করলে ছেলে মেয়েদের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ হয়। 

তবে ওড়িশাতে এই উৎসব সকল নারী এবং পুরুষরা দুজনেই পালন করে। এ জন্য প্রয়োজন ৮ রকমের ফুল এবং ফল। এছাড়া ৮ টি সুতোর গাঁট। এটি পালনের শেষে এই ৮ টি সুতোর গাঁট মেয়েদের বাম হাতে এবং ছেলেদের ডান হাতের বাহুতে পরানো হয়। মূলতঃ যাবতীয় পাপস্খলনের জন্য এটি পালিত হয়।

ড. শীলা বসাক লিখেছেন, "এই ব্রত আশ্বিন মাসের শুক্লাষ্টমী তিথিতে পালন করা হয়। পতি সৌভাগ্য কামনা এবং পতি ও সন্তানের মঙ্গলকামনায় পুত্রবতী সধবা নারীরা এই ব্রত পালন করে। এই ব্রতকে আবার এয়ো ব্রত নামে অভিহিত করা হয়। ফুল, ধূপ, দীপ, দূর্বা, আতপ চাল, ফল, মিষ্টি ইত্যাদি এই ব্রত পালনের প্রয়োজনীয় উপকরণ। পুজো করার পর ব্রতিনী ব্রতকথা শোনে এবং এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে। ব্রতের দিন ভাত খাওয়া বারণ। ব্রতিনীকে দিনের বেলা ময়দার তৈরি খাবার এবং রাত্রে ফলাহার করতে হয়। ব্রত পালনের শেষে সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হওয়ার কামনায় সধবা নারীরা একে অপরকে সিঁদুর আলতা পরিয়ে দেয়"।

এই দুর্গাষষ্ঠীর ব্রত কাহিনী এরকম। গণেশের জন্মবৃত্তান্তকে সামনে রেখেই কাহিনী আবর্তিত। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিন কৈলাসে মা দুর্গা মহাদেবের ওপর অসন্তুষ্ট হওয়ায় অনেকক্ষণ তাঁদের মধ্যে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে অনেক সাধ্যসাধনা করে মহাদেব দুর্গাকে বললেন, “হে দেবী! আজ ষষ্ঠীর দিনে তুমি মৌনব্রত করে নিশ্চুপ হয়ে রয়েছ কেন? আমি বারবার ডেকেও তোমার সাড়া পেলামনা। আমি বুঝতে পারছি না এর কারণ”। তখন দেবী দুর্গা বললেন, “তোমায় বলে লাভ নেই। তোমারই দেওয়া বরের দৌলতে কতজন সন্তান পেল। সেইসব সন্তানের মায়েরা আজ ঘটা করে ষষ্ঠীর দিনে কত আনন্দ করছে তাঁদের সন্তানদের নিয়ে। কিন্তু আমার কোনো সন্তান নেই যে এভাবে আনন্দ করি”। তখন মহাদেব বললেন, “পৃথিবীর সকলেই তো তোমাকেই ‘মা' বলছে। তবুও তোমার সন্তানের আশ মিটলোনা”? তা শুনে দুর্গা বললেন, “না, আমার সাধ মেটেনি। আমি মা হতে চাই। তুমি এখনি আমার কার্তিককে এনে দাও”। মহাদেব তখন চন্দ্রালোকে গেলেন কার্তিককে আনতে। কার্তিক দুর্গার গর্ভে না জন্মালেও সে আসলে শিবেরই ছেলে। এদিকে কৈলাসে জয়া ও বিজয়া মা দুর্গাকে তেল হলুদ মাখাতে লাগল। এতে মা দুর্গার গা থেকে যত ময়লা বেরুলো তাই দিয়ে দুর্গা একটি সুন্দর পুতুল গড়লেন। সেইসময় নারায়ণ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। পুতুলটিকে দেখে তাঁর খুব পছন্দ হল। তিনি তখন তার মধ্যে প্রবেশ করলেন। এতে পুতুলটি প্রাণ পেল। আর মা দুর্গাকে 'মা, মা' বলে তাঁর স্তন পান করতে লাগল। দুর্গা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন। এমন সময় মহাদেব কার্তিককে এনে দুর্গার কোলে তুলে দিলেন। দুর্গার কাছে মহাদেব পুতুলের সব কথা শুনলেন। তখন কৈলাসে উৎসব করার জন্য সব দেবতাদের নিমন্ত্রণ করলেন। সমস্ত দেবতারা কৈলাসে হাজির। কেবল এলেননা শনি। শনি আসেননি দেখে মহাদেবের খুব রাগ হল। কাজেই শনিকে শেষ পর্যন্ত আসতেই হল। কিন্তু শনি চোখে হাত চাপা দিয়ে থাকলেন। শনি ছিলেন আসলে দুর্গার সম্পর্কিত ভাই। এক সময় দুর্গা তাঁকে বর দিয়েছিলেন যে, শনি যাঁর দিকে চাইবে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুণ্ডু খসে পড়বে। এদিকে শনি ছেলেটিকে দেখছে না বলে মহাদেবের আরও রাগ হল। শনি তখন বাধ্য হয়ে চোখ খুলে ছেলেটির দিকে চাইলেন। শনির দৃষ্টিতে তখন ছেলেটির মাথা উড়ে গেল। দুর্গা তখন খুব কাঁদতে লাগলেন। তিনি শনির ওপর ভয়ানক অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু হঠাৎ তাঁকে বর দেওয়ার কথা মনে পড়ায় দুর্গা নিজের ভুল বুঝলেন বটে, তবে ছেলেটির জন্যে খুব কাঁদতে লাগলেন। তবে অন্য একটি মত যে, শনিরাজ চিত্ররথের কন্যাকে বিবাহ করেন। একদিন তাঁর স্ত্রী ঋতুস্নান করে তাঁর সঙ্গম প্রার্থনা করে। কিন্তু তখন তিনি এমনই ধ্যানমগ্ন ছিলেন যে, স্ত্রীর কথায় কর্ণপাত করেননি। ফলে ঋতু বিফলে যাওয়ায় তাঁর স্ত্রী তাঁকে শাপ দেন যে, শনি যাঁর দিকে দৃষ্টিপাত করবে তৎক্ষণাৎ সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। সমস্ত কিছু শুনেও পার্বতী শনিকে তাঁর ছেলের দিকে একবার তাকাতে বললেন। শনি শিশুর দিকে তাকানো মাত্রই শিশুর মুণ্ড আলাদা হয়ে যায়। এই ঘটনা ঘটায় দেবতারা বিচলিত হয়ে ওঠে। তখন মহাদেব নন্দীকে বললেন, “তুমি ত্রিভুবন ঘুরে এসে যেখানে দেখবে কেউ উত্তর দিকে মাথা রেখে শুয়ে আছে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুণ্ডটা কেটে নিয়ে চলে আসবে”। 

নন্দী সাত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল। আর স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল ঘুরে এক জায়গায় দেখল একটা হাতি উত্তর দিকে মাথা করে শুয়ে আছে। নন্দী তখনই তাঁর শুঁড়যুক্ত মাথাটা কেটে মহাদেবের কাছে নিয়ে এল। মহাদেব সেটি ছেলের ঘাড়ে জুড়ে দিলেন। ছোট ছেলেটি তখন ‘মা, মা' বলে ডেকে উঠলো। ছেলের মুখে হাতির মাথা দেখে দুর্গাতো মূর্ছা যায় যায়। দুর্গার এই পরিস্থিতি দেখে দেবতারা তাঁকে বললেন, “মা, আপনি দুঃখ করবেননা। এই ছেলের নাম রাখা হল গণপতি। সবার আগে এঁরই পূজো করতে হবে। তারপর বাকি দেবতারা পুজো পাবে"। 

তবে ব্রম্ভবৈবর্ত্য পুরাণ মতে গণেশের মুণ্ডচ্ছেদের কাহিনী আলাদা। এখানে শিবকে কশ্যপের অভিশাপের ফলে গণেশের মুণ্ডচ্ছেদ হয়। একবার সূর্য মালী ও লোঁ নামে দুই শিবভক্তকে হত্যা করার চেষ্টা করলে শিব সূর্যকে ত্রিশূলাঘাত করেন। এই আঘাতের ফলে সূর্য অজ্ঞান হয়ে যান। তখন সারা পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং চারিদিকে হুলুস্থুলু পড়ে যায়। সূর্যের পিতা মহর্ষি কশ্যপ পুত্রকে এহেন অবস্থায় দেখে শিবকে অভিশাপ দেন যে, তাঁর পুত্রের মাথাও একদিন কাটা পড়বে। এই অভিশাপের ফলেই গণেশ নিজের মুও হারান ও ইন্দ্রের ঐরাবত হস্তীর মাথা তাঁর মাথার ওপর লাগানো হয়েছিল। আবার স্কন্দপুরাণের গণেশখণ্ডে পাওয়া যায় যে, সিন্দূর নামক এক দৈত্য পার্বতীর গর্ভে অষ্টম মাসে প্রবেশ করে গণেশের মুণ্ড কেটে ফেলে। এতে বাচ্চার মৃত্যু না হলেও জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীতে। এরপর নারদ তাঁকে নিজেই নিজের মাথা সংগ্রহ করতে উপদেশ দেন। বালক তখন নিজের ক্ষমতাবলে গজাসুরের মাথা কেটে নিজের ঘাড়ে আটকে দেয়। তখন থেকেই গণেশের নাম হয় গজানন। 

যাইহোক, এরপর দুর্গা, কার্তিক আর গণেশকে নিয়ে হিমালয়ে গিরিরাজের ঘরে এসে ছেলেদের দেখিয়ে মেনকাকে সব ঘটনার কথা বললেন। তখন মেনকা খুব ঘটা করে সেখানে দুর্গাষষ্ঠীর ব্রত করলেন। দুর্গা বললেন, “মা! আশ্বিনের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে যে স্ত্রীলোক ভক্তিভরে আমার পুজো করবে এবং কথা শুনবে, আমার মত তাঁর সুন্দর সন্তান লাভ হবে"। ক্রমে এই দুর্গাষষ্ঠীর এই কথা ভূবলয়ে প্রচারিত হল। সবাই তখন এই উৎসব খুব ভক্তিশ্রদ্ধা সহকারে করতে শুরু করল।
🍂

Post a Comment

0 Comments