জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব- ১৩/গৌতম বাড়ই

চিত্র- চন্দ্রিমা ঘোষ 

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ১৩
গৌতম বাড়ই

অনুরের পশ্চাদগমন

বাতাশ্বের পিঠে চেপে অনুর ফিরে চলেছেন তার রাজ্যপাটের সুরক্ষায়। যেখানে তার ওপর যাবতীয় ভার অর্পণ করা আছে। এই মুহূর্তে তার যেমন বুক হালকা লাগছে, আবার তেমনি রাজকন্যা সুসীমার কথা মনে পড়লে এই বুকের ভিতরে এক অজানা আশঙ্কায়, তার বিরহে বুক মাঝে- মাঝে মোচড় দিয়ে উঠছে। একই বুকের মাঝে আমাদের কয়টি প্রকোষ্ঠ? এত কেন ঢেউ বুকের মাঝে? অনুর জীমূতনাদের পিঠে বসে ভাবতে থাকে এইসব কথা। সুসীমাকে সে সত্যি গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছে। সুসীমার আবার ফিরে আসবার অপেক্ষায় সে সারাজীবন তার জন্যে বসে থাকবে। সুসীমার আত্মপ্রত্যয় তাকে সেই বিশ্বাসের প্রতি দৃঢ় কঠিন প্রতিজ্ঞা করতে বাধ্য করেছে। বয়সে অনেক ছোট হলেও, সুসীমার ব্যক্তিত্ব , তার চরিত্রের দৃঢ়তা সেনাপতি অনুর কে মুগ্ধ করেছে বারবার। যদিও জানে সুসীমার আবার নতুন করে এই ফিরে আসা কার্যত অসম্ভব। তবে পৃথিবীতে সব অসম্ভবের ওপর সম্ভব বলেও একটি শব্দও আছে। হাওয়ার বেগে ছুটে চলেছে সেই ঘোড়া, জঙ্গলাকীর্ণ বন্ধুর সেই পথ শুনশান। একমাত্র বাতাসের শব্দ কানে ঢোকা ছাড়া আর কিছু নজরে পড়ছে না। রাতের অন্ধকারের আগেই তাকে বঙ্গেশ্বরের রাজপ্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। জানে সেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতূহলের। জীমূতনাদ চিঁ- হিঁ! চিৎকার করে সামনের দুই- পা উঠিয়ে দাঁড়ালো একবার। সেনাপতি অনুর কানপেতে সামনের বিপদ বুঝে নিতে চাইল একবার। কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইলো জীমূতনাদের পিঠে। হ্যাঁ, হাজার সমবেত খুরধ্বনি সন্মুখে এগিয়ে আসছে যেন। সতর্ক হয়ে অনুর নিশ্চল অবস্থা থেকে চলতে শুরু করল। কিছুটা যাবার পর , দূর থেকে জঙ্গলের আলোছায়ায় ধেয়ে আসা যূথবদ্ধ ঘোড়া- বাহিনী নজরে পড়ল। আরও কাছাকাছি উভয়ে মুখোমুখি হবার অনেক আগেই আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে অনুরের বজ্রনাদ আকাশ বাতাস চমকে দিল। চেঁচিয়ে বললেন- " আগুয়ান মানুষেরা সাবধান হোন, আমি সেনাপতি অনুর, আমার হাতের উদ্যত তলোয়ারে প্রতি মুহূর্তে আমি গন্ডা- গন্ডা মুন্ড ছেদন করতে পারি। সাবধান আমি সেনাপতি অনুর! 

সামনের খুরধ্বনির আওয়াজ অনেক ম্লান  হয়ে এল। দৃষ্টিতে ধরা পড়ল অশ্বারোহীরা ধীর লয়ে এগিয়ে আসছে এইদিকে। তাদের হাতের নিশান এখনও স্পষ্ট নয়। সেনাপতি অনুর এক জায়গায় স্থির হয়ে গেলেন। এবারে দৃষ্টি গোচর হল হাতের নিশানে বঙ্গরাজ্যের চিহ্ন। দূর থেকেই সমবেত ধ্বনি ভেসে এলো, " জয় বঙ্গরাজের জয়! জয় সেনাপতি অনুরের জয়!"  সেনাপতি অনুরের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল অশ্বারোহীরা। সবাই অনুরের বিশ্বস্ত সেনা। সেনাপতির অঙ্গুলি হেলনে সেই অশ্বারোহী সৈন্যদল এবার ফিরে চলল তার সাথে বঙ্গেশ্বরের রাজধানীতে। রাজপ্রাসাদের দিকে। 
🍂

সুসীমার দিশাহীন অগ্রভাগে গমন 

একবার পিছনে আর একবার সামনে তাকিয়ে ছুটে চলেছে অনিশ্চিতের দিকে। সে শুধু জানে পলায়ন, এই রাজপরিবারের লৌহব্যূহ থেকে। কোন উদ্দেশে চলেছে জানে না, কিসের উদ্দেশ্যে চলেছে তাও জানে না। শুধু জানে নিজেকে আলাদা করে এক স্থানে লৌহবর্মের জালের ভেতরে প্রতিস্থাপন করতে হবে। যেখানে তার নিরাপত্তা সম্পূর্ণ অটুট থাকবে। কখনও সামান্য শব্দে বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে গাছের আড়ালে লুকিয়ে যাচ্ছে সুসীমা, আবার কখনও ছুটে চলেছে দ্রুত পদে, বাতাসে তার আঁচল উড়ছে। পায়ের তলায় রাঢ়ের লালমাটি। ফেটে আসছে যেন পায়ের পাতা। ভীষণ যন্ত্রণা। বালি, কাঁকড় ঢুকে যাচ্ছে সেই ফাটা পায়ে। সেই চোখ বুঝে সহ্য করে নিতে হচ্ছে সুসীমাকে। তাকে বেঁচে থাকতেই হবে, তাকে এগিয়ে যেতেই হবে। এগিয়ে যাওয়া মানেই সুসীমা জানে বেঁচে থাকা। একটি কুকুর সদৃশ কিছু মনে হল তার পিছু নিয়েছে, ভয়ডরহীন সুসীমা তার দিকে পেছন ফিরে চেয়ে দেখল, একটি শৃগাল মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাত নেড়ে তাকে ডাকলো, আর আবার এগিয়ে গেল সামনে। এমন সময় আচমকা সেই বনপথে দূর থেকে হৈ- হট্টগোল, বাদ্যি বাজনার আওয়াজ ভেসে এলো। আর ভেসে এলো অনেক মানুষের কন্ঠ। সঙ্গে সুমধুর না হলেও, গানের আওয়াজ। হে! হে! হই হই মানুষের গলার আওয়াজ। এগিয়ে আসছে তারা এদিকেই। সুসীমা শঙ্কিত হল। গাছের আড়ালে আশ্রয় নিল, যেখান থেকে নিরাপদে এই পথচারীদের খেয়াল করা যাবে। এগিয়ে আসছে তারা এই পথে। 


আড়ালে থেকে সুসীমা প্রথমে বুঝতেই পারল না এরা কারা? হাতে তীর, ধনুক, বর্ষা, তলোয়ার রয়েছে। রয়েছে লটবহর নিয়ে দেশি ঘোড়া, গাধা, গাইয়ে আর বাজনার দল। দেশি লোকেদের সাথে, আরও অন্যরকম প্রকৃতির মানুষ জন। এদের দেখে যোদ্ধাও মনে হচ্ছে না, আবার নিরীহ মানুষ বলেও বোধ হচ্ছে না। পাতার খসখস আওয়াজ তুলে বড় এক সরীসৃপ পাশ দিয়ে চলে গেল। সুসীমার সারা গায়ে রক্তের শীতলস্রোত বয়ে গেল। অথচ সেনাপতি অনুর যখন পাশে ছিল তার এই বুকে বাসা বাঁধেনি একটুকরো ভয়। ভরতভৃগুর মৃতদেহ মাটি দিয়ে ঢাকতে সে নিজেও সেনাপতির সঙ্গে হাত লাগিয়েছে। মানুষ তাই এই জগতে স্বীয় অবয়বে শক্তিশালী নয়, পুরুষের হিংস্রতা আর ভালোবাসার স্ফূরণ  যেমন একজন নারীসঙ্গে জেগে ওঠে, তেমনি এক নারী এক শক্তিশালী পুরুষের কামনায় নিজের ভালোবাসা আর হিংস্রতার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। আবেগ তার পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি, সে জয় করে ফেলে শক্তিশালী পুরুষ হৃদয়, পুরুষ হৃদয় চালিত হয় জগতের কল্যাণ এবং অকল্যাণে। তার নজরে পড়ল, কিছু শ্বেতাঙ্গ ভিনদেশী চ্যাপ্টা নাক, বলতে গেলে দাঁড়ি, গোঁফহীন খর্বাকৃতি পুরুষ মানুষদের। সেই দলবলের আগে আর পিছুতে বর্শাউচিঁয়ে ধরা পাহারাদারদের। তবে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে এরা কোনও গন্তব্যে সাধু উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। রাজকন্যা সুসীমা আর অপেক্ষা করতে পারল না এই জঙ্গলের আড়ালে থাকতে। সহসা এক ভীষণ দুঃসাহসিক কাজ করে বসল। খিদেয় তার দেহের অভ্যন্তর জ্বলে- পুড়ে নিস্তেজ হয়ে আসছিল।

বড় আশ্চর্যের এই মানব শরীর। যখন তাকে রাজপ্রাসাদের অন্দরে বন্দী করে রৌপ্যখচিত পাত্রে পঞ্চদশ ব্যাঞ্জনে রকমারি খাবার সাজিয়ে পরিবেশন  করা হচ্ছিল, তার দাঁতে কাটতে ইচ্ছে করছিল না। আর এই এখন পানীয় জলের জন্য গলা শুকিয়ে কাঠ, খিদের চোটে পেট চুঁইচুঁই করছে তার । পারছে না, সে আর পারছে না। দৌড়ে ছুটে চলল তাদের পেছন পেছন। 

সুসীমা চেঁচিয়ে উঠলো পেছন থেকে- " তোমরা চলে যেওনা। আমার কথা শোনো। আমি অসহয়া একজন মানুষ। " 

নারীকন্ঠের এই আর্তিতে সবাই থমকে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে চাইলো। 

সেই অভুক্ত  বণিকদলের মধ্যে এসে দাঁড়ালো অপরূপা এক নারী। বেশভূষা স্খলিত, চোখে-মুখে ভালোমতন খেয়াল করলে পরিশ্রম ও ক্লান্তির ছাপ, কিঞ্চিত ভবঘুরে যাপনের সামান্য ইঙ্গিত থাকলেও, তবুও উজ্জ্বল আর  পরমাসুন্দরী এ নারী।  কী চায় সে? কী তার অভিপ্রায়? 

মুটেরদল  আর অন্যান্য কিছু লোকজন এগিয়ে গেল প্রথমে। বণিকদল আর স্থানীয় মুটের দলের মাঝে ভাষার বিস্তর ফারাক। কারও শব্দ কেউ বোঝে না। ভিনদেশী উভয়েই। তবে আকার ইঙ্গিতে ইশারায়  মানুষের দরকারে মানুষের কাছে আসতে মানুষের  আজ পর্যন্ত অসুবিধা হয়নি কোথাও ভাষার জন্য। "কী চাও তুমি নারী? " -অনেকে বলল একসাথে।

"চাই তোমাদের সঙ্গ, চাই তোমাদের আশ্রয় । আমি অসহায়া, বিপদগ্রস্ত, সময়ে সব বলব, এই মুহূর্তে চাই তোমাদের সহযোগিতা আর আশ্রয়"- উচ্চকন্ঠে জানাল সেই অজ্ঞাতা কুলশীলা। 

এ নারী শুধু পরমা সুন্দরী নয়। সেই স্খলিত বেশভূষণ দেখলেও কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, খুব উচ্চ-ধনী ঘরের এই নারী বটে। উচ্চ-বংশের কেউ  বা কোনো জনপদের রাজকুমারী নয় তো? সারাদেহ ভর্তি সোনার অলঙ্কার। এই অরণ্যপথে, লোকালয়হীন অঞ্চলে একাকী সে এলো কোথা থেকে? রেশমবস্ত্র পরিধানে। আর এই রেশমবস্ত্র দেখে বণিকদল তো তাজ্জব হল! আসলে তো তারা প্রধানত  ঐ রেশমের কারবারি। এই রেশমসুতোর বস্ত্রের দাম তারা জানে। কোটিতে গুটিমাত্র নারী এ বস্ত্র পড়বার জন্য সৌভাগ্যবতী হয়! ঐ নারী অস্ফূট কন্ঠে বলল এরপর- " আমি ভীষণ ভাবে অভুক্ত। পথে ফলমূল যা পেয়েছি, খেয়েছি। সামান্য কিছু এই কাঁধের ঝোলায় আছে এখনও। আমায় খেতে দাও আগে কিছু। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, পানীয় জল দাও। শারীরিক বল প্রয়োজন আগে। তারপর হয়ত প্রাণ ভরে বাঁচব।" ভয়ার্ত চোখে বারবার পিছন ফিরে দেখছিল বঙ্গেশ্বরের রাজকন্যা সুসীমা। 

সেই চৈনিক পুরুষেরা, সেই ভিনদেশী বণিকেরা এই পরমাসুন্দরী নারীর রূপে মোহিত হয়ে গেল। আকাশের চাঁদ আজ তাদের মধ্যে নেমে এসেছে যেন। তারা মুখ তুলে মুটের দলকে প্রশ্ন করল,  এ কে? কে এই পরমা সুন্দরী নারী? 

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments