জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ২০ /বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে – ২০
বিজন সাহা 

প্লিওস 

কস্ত্রোমা থেকে আমরা রওনা হলাম প্লিওসের পথে। আমার পরিকল্পনায় অবশ্য প্লিওস ছিল না। আমি চেয়েছিলাম রিবীনস্ক যেতে। রিবীনস্ক উগলিচ আর ইয়ারোস্লাভলের মাঝে ভোলগা তীরে এক বড় শহর। আর এই রিবীনস্ক ও ইয়ারোস্লাভলের মাঝে আছে আরও একটা সুন্দর শহর রোমানভ-বরিসোগ্লেবস্ক বা তুতায়েভ। তবে নদী তো নিজের মত করে চলে, তাই উগলিচ থেকে ভোলগা ইয়ারোস্লাভল আসে অনেক ঘুরে। রিবীনস্ক যাবার ইচ্ছা ছিল এ কারণে যে বছর পনেরো আগে সেখানে এক ফটো এক্সিবিশনে আমার একটা ছবি প্রদর্শিত হয়েছিল। দেমিদ বলল সেক্ষেত্রে আমাদের আবার অনেকটা উপরে মানে উত্তরে যেতে হবে আর তাতে একটা দিন নষ্ট হবে। কম্প্রোমাইজ ভ্যারিয়ান্ট হিসেবে ও প্লিওসের নাম প্রস্তাব করল। প্লিওস সত্যিকার অর্থেই ভলগা তীর খুব সুন্দর এক শহর। তাছাড়া এটা নিঝনি নভগোরাদের পথে। তাই আমরা পরবর্তী যাত্রা বিরতি প্লিওসে করব বলে ঠিক করলাম। ইভানভা রেজিওনের এই শহর রাশিয়ার ঐতিহাসিক শহরের ফেডেরেল লিস্ট ভুক্ত। ইভানভা রেজিওনে ট্যুরিস্টদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই শহরে মাত্র ২ হাজার লোক বাস করে। পর্যটনের দিক দিয়ে রাশিয়ায় ছোট শহরগুলোর প্রথম চারটি শহরের একটি এই প্লিওস। 

কবে যে প্লিওসের দুর্গ নির্মিত হয়েছিল সেটা সঠিক জানা নেই, তবে প্লিওস ও ইউরিয়েভেৎস ইভানভা রিজিওনের সবচেয়ে পুরানো দুটো শহর এ নিয়ে বিতর্ক নেই। নভগোরাদের দিনপঞ্জিতে প্লিওসের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১১৪১ সালে। এই স্থানে নভগোরাদ থেকে সুজদালে ইউরি দলগোরুকির কাছে পালানোর সময় যুবরাজ সভ্যাতোস্লাভের সাথে ইয়াকুন মিরোস্লাভিচ ধরা পড়েন বলে সেখানে উল্লেখ আছে। তবে এটাই যে সেই প্লিওস সে ব্যাপারে সবাই একমত নয়। এছাড়া গোল্ডেন হোর্ডদের সেনাপতি বাতি খান ১২৩৮ সালে ভোলগা তীরের যেসব জনপদ ধ্বংস করেছিলেন তাতে প্লিওসের নাম উল্লেখ আছে। দুর্গ ধ্বংস হলেও জনপদ টিকে থাকে। ১৪০৮ সালে মস্কো রাজ ভাসিলি দ্মিত্রিয়েভিচ চিওরনি গোল্ডেন হোর্ডদের সেনাপতি এদিগেইয়ের আক্রমণ থেকে কাস্ত্রোমা পালানোর সময় এখানে নতুন করে দুর্গ নির্মাণের আদেশ দেন। ১৪৭১ সালে আফানাসি নিকিতিন প্লিওস ভ্রমণ করেন। ১৭৭৮ সালে প্লিওস কস্ত্রোমা এলাকার এক গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়। এখানে লিনেনের কারখানা স্থাপিত হয়। ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্লিওস মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলার কেন্দ্রে পরিণত হয়। ইভানভা – শুইস্কি অঞ্চলে লাইট ইন্ডাস্ট্রি দ্রুত বিকাশ লাভ করতে শুরু করলে ১৮৭১ সালে রেল লাইন তৈরির আগে পর্যন্ত প্লিওস ছিল এলাকার অন্যতম প্রধান নদীবন্দর। বলা হয়ে থাকে যে প্লিওসের বনিকেরা প্লিওস পর্যন্ত রেল লাইন তৈরির বিরোধিতা করে, কেন না তাদের ধারণা ছিল এতে করে তারা দেউলিয়া হয়ে পড়বে। ফলাফল – প্লিওস প্রায় পরিত্যাক্ত জনপদে পর্যবসিত হয়। ১৯১০ সালে প্লিওসের ৫০০ বছর উপলক্ষ্যে গ্র্যান্ড ডিউক ভাসিলি দ্মিত্রিয়েভিচের আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়। সে বছরই স্বনামধন্য গায়ক ফিওদর শালিয়াপিন এখানে বেড়াতে আসেন। প্লিওসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে ১৯১৪ সালে তিনি সেখানে সামার হাউজ তৈরি করেন যা ১৯২৪ সালে রেস্ট হাউজে পরিণত হয়। এলাকার অন্যান্য শহরের মতই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্লিওস অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়। এর জনসংখ্যা ৪০০০ থেকে ১৭০০ তে নেমে আসে। ২০০৯ সালে রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট দ্মিত্রি মেদভেদেভ প্লিওসের উপকণ্ঠে মিলভকা নামক গ্রামে সরকারি রেসিডেন্স গড়ে তোলার আদেশ দেবার পর থেকে এখানে নতুন করে জীবন ফিরে আসে।      

🍂
প্লিওসের দর্শনীয় স্থানগুলোর ১৬৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত উসপেনস্কায়া গির্জা, ১৮১৭ সালের ভস্ক্রেসেনিয়ে খ্রিস্তভা গির্জা, ত্রইস্কায়া (১৮০৮) ও ভভেদেনস্কায়া (১৮২৮) গির্জা, সেন্ট ভারভারা গির্জা (১৮২১), প্রেওব্রাঝেনস্কায়া গির্জা (১৮৪০) ও কাঠের তৈরি ভস্ক্রেসেনিয়ে গির্জা (১৬৯০) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ১৮৪৫ সালে তৈরি পেত্রোপাভলভস্কায়া গির্জার গম্বুজ ও ঘন্টা সোভিয়েত আমলে ভেঙ্গে ফেলা হয় যা আর পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা হয়নি।    

বিখ্যাত রুশ শিল্পী ইসাক ইলিচ লেভিতান এখানে দুই শ'র বেশি চিত্র আঁকেন। বর্তমানে সেখানে তাঁর হাউজ মিউজিয়াম আছে যা ১৯৮২ সালে স্থাপিত প্লিওস রাষ্ট্রীয় ঐতিহাসিক, স্থাপত্য ও শিল্পকলা মিউজিয়ামের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া এখানে আছে লেভিতানের স্ট্যাচু। 

প্রায় দেড় ঘন্টা ড্রাইভ করে আমরা এসে পৌঁছুলাম প্লিওসে। শহরে ঢোকার মুখেই দেখা গেল রাস্তা বন্ধ। গাড়ি নিয়ে ঢোকা যায় না। এটা কোন বিশেষ কারণে নাকি বাইরের গাড়ি শহরে ঢুকতে দেয় না সেটা অবশ্য জানা হয়নি। লোকজন খুব একটা ছিল না বললেই চলে। তাই শহরে ঢোকার মুখে গাড়ি রেখে আমরা চললাম পায়ে হেঁটে নদী বন্দরের খোঁজে। খুব বেশিক্ষণ হেঁটেছি কি? না। তাছাড়া এটাকে শহর না বলে গ্রাম বলাই ভালো – অন্তত প্রাকৃতিক পরিবেশ গ্রামের মতই। গাছে গাছে ঢাকা রাস্তা দিয়ে আমরা এলাম এক পার্কে। জায়গাটা বেশ উঁচু। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে দূরে নীচে দেখা যাচ্ছিল ভোলগার জলরাশি। একটু খুঁজতেই দেখি একটা কাঠের সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে। কোথায় তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ ভেবে ঠিক করলাম নামা তো যাক, যদি সামনে কিছুই না পাওয়া যায় উঠে আসব না হয়। না, ভুল করিনি। সিঁড়ি আমাদের নিয়ে এল ভোলগা তীরে। সেখানে একটা গির্জা আর অনেকটা বাজার টাইপ। দেখেই বোঝা যায় নদী পথে যেসব ট্যুরিস্টরা প্লিওসে আসেন তাদের জন্যই এই বাজার বা  বানিজ্য মেলা। মূলত বিভিন্ন রকম স্যুভেনীর। কিছু কিছু একান্তই স্থানীয়। আর আছে সারি সারি ক্যাফে, দু' একটা হোটেলও দেখা গেল। নদীর তীরে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। সেখানে শালিয়াপিনের স্ট্যাচু। একটা নৌকা উল্টা করে তার উপর বসে আছেন। পেছনে একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুকুর নিয়ে। ২০২০ সালে স্থাপিত এই মেমোরিয়াল মনে হয় ইতিমধ্যেই প্লিওসের দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। খেতে খেতে দেখলাম অনেক লোকজন ওখানে এসে ছবি তুলল। 

দেমিদ এদিক সেদিক ঘুরে আমাদের নিয়ে গেল একটা রেস্টুরেন্টে। দেমিদ নিজেই এটা করে। কারণ খাবারের ব্যাপারে ওর নানা রকম রেস্ট্রিকশন আছে। ও ভেজ। আর এদেশে সেটা এক বড় সমস্যা। তাই আগে থেকে না জেনে গেলে অসুবিধা। এসব এলাকায় আমাদের মত বিদেশী খুব একটা আসে বলে মনে হয় না। বেশ আপ্যায়ন করেই আমাদের নিয়ে গেল, দোতলায় নিয়ে বসালো। জানালার কাছে সীট থেকে দূরে নদী দেখা যাচ্ছিল। সেখানে মাঝে মধ্যে দু' একটা বোট ভেসে বেড়াচ্ছে। আসলে বৃষ্টি না থাকলেও আকাশের মন খারাপ। হাসির কোন রেশ মাত্র নেই। এসব রেস্টুরেন্টে একটাই সমস্যা – খাবার দিতে দিতে অনেক দেরি করে। তবে গরম খাবার। ইতিমধ্যে তিনটে পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা হেলে পড়েছে। আমাদের সামনে অনেক পথ।  ধীরে সুস্থে খাওয়া দাওয়া শেষ করে কফি খেয়ে, এমনকি একটু রেস্ট নিয়ে আমরা বেরুলাম নদীর তীরে। যদিও আগস্ট আর সেই সাথে সামার শেষের পথে আর এটা এ দেশের মানুষের ঘোরাফেরা করার পিক আওয়ার তবুও নদীর তীরে বিভিন্ন ধরণের নির্মাণ কাজ চলছিল। এবং এসব কাজে যুক্ত মূলত মধ্য এশিয়ার লোকজন। নদীর তীরের রাস্তার একটা বড় অংশ পথচারীদের জন্য হলেও কিছু গাড়িও দেখলাম। হতে পারে এখানে গাড়িও চলে। পথচারীদের চলার পথের দু’ পাশে বিভিন্ন স্ট্যান্ড, দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে লোকজন বিভিন্ন জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখে বিক্রির জন্য। হয়তো দুপুর বলে এই মুহূর্তে খুব বেশি বিক্রেতা দেখলাম না। কেউ কেউ চীনেমাটির বাসনকোসন আর স্যুভেনির নিয়ে বসে ছিল, কারও কাছে ছিল শিল্পকর্ম – হয়তো নিজের বা স্থানীয় শিল্পীদের আঁকা। আমাদের কেনার জন্য ডাকল। আমি হেসে ওদের সাথে একটু গল্প করে চলে গেলাম। সামনে ফেরি ঘাঁট। এখানে থেকে মনে হয় ছোটখাটো ভোলগা ট্রিপের আয়োজন করা হয়। এখানে ভোলগা বেশ চওড়া, অন্তত দুবনার তুলনায় তো বটেই। ঘাঁটে আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছিল। আমরা ওখান থেকে আইসক্রিম কিনে খেতে খেতে রওনা হলাম গাড়ি পার্কিংএর ওখানে। এবার আরেকটু ঘুরেফিরে দেখার চেষ্টা করলাম জায়গাটা। না, আসলে তেমন কিছু নয়। হয়তো বা বেলি গোরাদক টাইপের কোন এক গ্রাম যার আছে অতীত ঐতিহ্য আর অপেক্ষাকৃত সাদামাটা বর্তমান। তবে এখানে বিভিন্ন সময় বড় বড় মিউজিক ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়। এটা মনে হয় শালিয়াপিনের কারণেই। এসব অনুষ্ঠানই হয়তো এসব ছোট ছোট জনপদের জীবনযাত্রা বাইরের দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে নেবার প্রচেষ্টা।         

প্লিওসের কিছু ছবি 

http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=247

ভিডিও 

https://www.youtube.com/watch?v=OtCuc5Y80ck&t=18s

Post a Comment

0 Comments