জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো/পর্ব ২৩ /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কালের অতল তলে কলোরাডো
পর্ব ২৩
চিত্রা ভট্টাচার্য্য


পৃথিবীর কঠিন অসুখ করেছে। স্বচ্ছ মেঘ মুক্ত নীল আকাশ টা রোগ ব্যাধির বিষ বাস্পের জ্বালায় ক্রমশঃ যেন নীলিমাহীন কালো কুন্ডলি পাকানো ধোঁয়াটে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কুয়াশায় ঢাকা অস্পষ্ট জীবনে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে জনমানব মেতেছে দুর্নিবার জীবন সংগ্রামে। আদি সৃষ্টি দিশেহারা। তার ধমনীর শিরায় শিরায় উষ্ণ শাণিত রক্ত ধারার প্রবাহে চলেছে অসীম ব্যাকুলতা। মানুষ কিংকর্তব্যঃ বিমূঢ় ,হতাশায় জর্জরিত ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীর আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায় বেদনার ক্রন্দন। দিগন্তের প্রান্তরেখায় প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে রিক্ত প্রাণের চীৎকার। বিশ্বজুড়ে সংশয় চলেছে শুধুই টিকে থাকার। এই জীবন মরণের লড়াইয়ে কোনো  হাতিয়ার নেই। কে দেবে আশ্বাস? বিশ্ব ব্যাপী এই মহাসঙ্কটে জনমানুষের অবস্থা ঢাল হীন তরোয়াল হীন নিধিরাম সর্দারের মত। লড়াইয়ের অজানা রুক্ষ পথে চলতে গিয়ে বারবার মুখথুবড়ে পড়ে রক্তাক্ত হচ্ছে তবুও    কঠিন পরিস্থিতে অন্ধকার হাতড়ে যুদ্ধ জয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। সাফল্য সহজে কিছুতেই আসবে না,তবু চেষ্টা চালাতে দোষ কি ? নির্মম মৃত্যুর হাতে আত্মসমর্পণ করতে বীরভোগ্যা ধরণী মোটেই প্রস্তুত নয়।   
                                                                                     প্রতিদিনের খবরের বুলেটিন দেখছি লাশের পাহাড় জমছে। সৎকারের ব্যাবস্থার ও তেমন সুবিধা নেই। জানিনা, শবদেহ গুলো অবশেষে যাচ্ছে কোথায় ? বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় পড়ছি গরীব দেশ গুলোর অবস্থা আরো করুণ ,হস্পিটাল ডক্টর নার্স স্বেচ্ছাসেবী আইসোলেশন ওষুধ পথ্য খাদ্য সর্বোপরি জনবল প্রয়োজনের তুলনায় খুব স্বল্প হওয়ায় অবস্থা বড়োই শোচনীয়।  কে আছে অদৃশ্য লোকে? বঞ্চিত স্তম্ভিত রিক্ত ধরণীর বুকের পরে ছোঁয়াবে সান্ত্বনার স্নিগ্ধ মরমী হাতের পরশ। প্রাণের আরাম দিয়ে শোনাবে অভয় বাণী। চারদিক থেকে শ্বেত শুভ্র চাদরে ঢাকা শীতল মৃত্যুর অঙ্গুলি হেলনে অহর্নিশি চলছে জীবিত মৃতের লকোচুরি খেলা। সেখানে বেঁচে থেকে সুস্থ জীবন ধারণের কোনো আশ্বাস নেই। চিকিৎসাবিদরা বলছেন এ রোগ প্রতিরোধে সংক্রমণ ও ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলার সাথে শরীরে পর্যাপ্ত পরিমানে দুধ ফল প্রোটিন ভিটামিন ইত্যাদি পুষ্টিকর খাদ্য দ্রব্য খাওয়ার প্রয়োজন। সামান্য আহারের পুঁজি নেই যেখানে সেখানে পুষ্টিকর খাদ্যের চিন্তা অকল্পনীয়। তারওপর বেকারত্ব এনেছে অর্থ সংকট।সরকার থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও প্রয়োজন তাতে সম্পূর্ণ মেটে না।  জীবনের খেলাঘরে হঠাৎ খেলা অসমাপ্ত রেখে মানুষ চলেছে অগস্ত্য যাত্রায়।রঙীন স্বপ্নের ফানুস উড়ে যায় দেশ কাল গন্ডির বাঁধা ডিঙিয়ে অচেনা কোন রূপ কথার রাজ প্রাসাদের কফিন বক্সের মর্মান্তিক শীতল শয্যায়।  
                                                                                     তবু এমন সঙ্কটে মানবতা জেগেছে অনন্তের আশীর্বাদে। শক্ত হাতে অকাল মৃত্যু কে ফাঁকি দিতে অমৃতের সন্ধানে মরিয়া হয়েছে প্রাণের স্পন্দন। টীকা আবিষ্কারের জন্য চলছে অনলস পরিশ্রম। মানুষের বুদ্ধিমত্তা ধী শক্তির প্রয়াস একদিন ঠিক এই কাল ব্যাধিকে রোধ করে জয়ের মালা পরিয়ে দেবে। মৃত্যু তখন থমকে দাঁড়াবে ,লোলুপ দৃষ্টি মেলে ওঁৎ পেতে থাকবেনা আর্তের শিয়রে। যেমন করে ঐ একশ বছর আগে ১৯১৮--২০ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সমবেত চেষ্টায় সেই গ্রেট ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী স্প্যানিশ ফ্লু কে রুখেছিল। তৎকালীন সময়ে আনুমানিক পাঁচ কোটির ও বেশী মানুষ বা বিশ্ব জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই ভাইরাসে। বিশ্ব ইতিহাসের খাতায় এমন বহু মহামারির ঘটনার নিদর্শন নথিভুক্ত আছে যে গুলো খুব দ্রুত কোনও জনগোষ্ঠী বা দেশ থেকে দেশান্তরে প্রবল আকার ধারণ করেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনহানির কারণ হয়েছিল প্লেগ রোগের পান্ডামিকে। স্বীয় সত্ত্বাকে তুচ্ছ করে সেই প্লেগের মত মহামারীর প্রতিরোধে সচেষ্ট হয়েছে মানুষ। তখন চিকিৎসা বিজ্ঞান আজকের মত এতো উন্নত ,পরিশীলিত ছিল না। তবু মানুষেরই চেষ্টায় প্রতিষেধক আবিষ্কারের ফলে সে রোগের করাল ছোবল থেকে মৃত্যুর ভয় কে এড়িয়ে জনজীবন রেহাই পেয়েছিল। গোটা বিশ্ব দেখেছে বিজ্ঞানের মহাদম্ভে সভ্যতার অহংকারে রোগ ব্যাধি কে পরাস্ত করে জীবন এগিয়ে গিয়েছে কালের যাত্রায়।  

        পোল্যান্ডের কুলকির বাড়িতে ইয়াম ভিডিও কল করেছিল--  রক্ত শূন্য চোখ ,রোগ জর্জরিত সাদা ফ্যাকাশে চামড়ার  বিবর্ণ মুখে রীয়াম রোগ শয্যায় ,ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মৃত্যুর  শীতল ছায়া দেখেছি ওর সারা শরীর জুড়ে। জীবনী শক্তি বিন্দু মাত্র নেই ,কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে ,ওর নীরব শরীরী ভাষা যেন বলছে সময় ফুরালো --দাও বিদায়।  মনে হলো যেন যমরাজ শিয়রে সমন নিয়ে হাজির , প্রহর গুনছে। ইয়ামের কষ্ট ,ও কথা রাখতে পারলো না। সেদিন ও দেখেছিলাম ,গভীর স্নেহে ছোট্ট বোন টিকে বলেছিল , অফিস ট্যুরের থেকে ফিরেই ছুটির এপ্লাই করবে অন্ততঃ দু সপ্তাহ। ভারী বড়ো মুখ করে বলেছিল '' আসছি আমি ,এবারে ব্লাড ট্র্যান্সফারের সময় হস্পিটালে তোর পাশে আমি থাকবোই। রীয়মের অসহায় পিতৃমাতৃ হৃদয় দেখেছিল ক্ষীণ আশার আলো। মিস্টার ব্রাইস,ও মিসেস শেলিনার বড়ো মেয়ের ওপরে অগাধ ভরসা , ইয়াম যে বলেছে খুব শিগ্গিরই আমি আসছি। রীয়াম ও ভারী খুশী,পূর্ণিমা রাতের আকাশের আধ খানা চাঁদের মত ওর মৃদু  হাসি উপচে পড়ছিল শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটের কোণে।             
🍂

     ইতিমধ্যে কোভিড ১৯ লকডাউন যে সব পথ এমন বন্ধ করবে কে জানতো ? কথা না রাখতে পারার মর্ম যন্ত্রনা ইয়াম কে পাগলের মত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ও বলে পৃথিবীর এতো বড়ো অসুখ একদিন সেরে যাবে। কিন্তু এই অসহনীয় দুর্বিপাকে রীয়াম একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে আর এক অজানা বিশ্বলোকে। সব দ্বার রুদ্ধ , ফেরার পথ নেই। অসহায়ের হাহাকার বেজে চলেছে ইয়মের বুকে ,ব্রাইসদের পিতৃমাতৃ হৃদয়ে। করোনার প্রকোপে ব্লাড ক্যান্সার, ক্যান্সার ,হার্ট ডিজিজ ,কিডনী ফেলিওর ,আরো এমন জটিল কঠিন অসুখে ভোগা মানুষ গুলোর কি হবে ? কিভাবে পরিত্রাণ পাবে তারা ? হাউজ ফিজিশিয়ান রীয়ম কে দেখে শেষ জবাব দিয়ে গিয়েছেন । God Jesas Christ কে স্মরণ করতে বলেছেন।   ইয়াম কে একরকম জোর করেই ওর এপার্টমেন্ট থেকে তুলে নিয়ে এলাম লস্গাটসের বাড়িতে। একলা ঘরের কোণে বসে মন খারাপ করে কাঁদতে বন্ধুরা ওকে কিছুতেই দেবে না। 
                                                                                   শ্রাবণের ধারার মত ইয়ামের  দু চোখ বেঁয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। মনে উথাল পাথাল ঝড় বইছে। এখন পারভীন ও এখানে নেই কে বোঝাবে ,কে শান্ত করবে ওকে ? ভাবছে যদি উপায় থাকতো ছুটে চলে যেত পোল্যান্ডের  কুলকি ভিলেজের শেষ প্রান্তের  খামার বাড়িতে শেষ বারের মতো একবারটি দেখা হতো প্রাণ প্রিয় ছোট বোন কাম বন্ধু রীয়মের সাথে। মাত্র ২১ টি বসন্ত ওর পার হলো না ,ও যে চলে যাচ্ছে চিরতরে। কলোরাডো বেড়ানোর পথে কত গল্প শুনেছি রীয়মের আর ওদের ভিলেজের ছোট্ট সোনালী ফসলের ক্ষেত টুকুর।চার পাঁচ হাত লম্বা সবুজ ভুট্টার গাছ গুলো যেখানে সর্বদা হাওয়ায় হিল্লোল তুলে মাথা দোলায়। গ্রামের ছোট্ট জলাশয় গুলোতে সাদা ধবধবে রাজহাঁস গ্রীবা উঁচু করে সার বেঁধে সদর্পে ঘুরে বেড়ায়। সারাদিন তাদের কলকন্ঠের ডাক শোনার জন্য কান উতলা হয়ে ওঠে। ক্ষেতে সুইট কর্ন ,বেবী কর্ন পাকলে কাঁচা সোনার আলোয় চতুর্দিক ভরে ওঠে। সবুজ কোমল ঘাসে ভরা প্রান্তর যেখানে যত্ন করে ছড়ানো হয়েছিল রোজমারির বীজ,বৃষ্টির জলে নব বর্ষার ধারায় হয়তো ঢাল বেঁয়ে নামছে তার বিচিত্র সবুজের সমারোহ। সিজিন ফ্লাওয়ারের বিচিত্র রঙের বাহারে বাগান ভরা জিনিয়া ,এজিলিয়া ডেইজি সানফ্লাওয়ারের অপরূপ শোভা। রীয়মের ভারী শখ টিউলিপের। গতবারে বায়না করে  চাষের ক্ষেতের এক কোণ দিয়ে ওর ফুলের বাগান , লাইন ধরে লম্বা করে লাগিয়েছিল সাদা লাল আর হলদে টিউলিপ। এবারের বসন্তে টানা ১৫ দিন  টিউলিপ একরাশ হাসি নিয়ে এক সাথে বাগান আলো করে ফুটেছিল। অসুস্থ শরীরেও রীয়মের বাগানে পরিচর্যা,ফুলের যত্ন করতে কোনো ক্লান্তি লাগতো না। 

          সেই কুলকি গ্রামের স্নিগ্ধ ছায়ায় স্নেহের আদরের রীয়ম রোগ শয্যায় শায়িত হয়ে আছে। সেখানে ক্ষেতের জমির ফসল ফলাতে উদয় অস্ত পরিশ্রমের দিনযাপনে বাবা মার আর  বোন কে নিয়ে সংসার। আমেরিকার সান্হোসের সিলিকন ভ্যালির আইটি সেক্টরে ইয়ম চাকরী পাওয়ার পর পারিবারিক আর্থিক সঙ্কট কাটলেও রীয়মের ব্লাড ক্যানসারের চিকিৎসা খরচ চালাতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। ওর ইচ্ছে হয় --যদি পরীর মত দুটো ডানা থাকতো তাহলে পাখা মেলে এখনই দিগন্তে পাড়ি দিয়ে নিমেষে পোল্যান্ডের পৈতৃক গ্রামে পৌঁছে যাওয়া যেত। আমরা মূক বধিরের মত বসে আছি , একটা শব্দ ও সহানুভূতি বা সান্ত্বনা হয়ে বেরিয়ে আসেনা।মিথ্যা স্তোক বাক্য দিতে ও মন চায় না। 
                                                                                       মানুষের জীবন টা যেন নতুন এক অপঠিত উপন্যাসের পাতার মত। কেউ জানে না পরের পাতায়  কি লেখা থাকবে ? তবুও ঘটনার ঘন ঘটায় পাঠক অনুমান করে পাতা উল্টে চলে কখোনো হয়তো মিলেও যায়। আজকের সারাদিন মেঘাবৃত ঘন ঘোর ছায়ায় ঢাকা ছিল হঠাৎ দেখি আকাশ ময় হঠাৎ আলোর ঝলকানি তে কে বলবে এখন সন্ধ্যে সাড়ে সাত টা। ঝরঝরে সূর্যের আলো। ভেবেছিলাম অসময়ে আজ ঘোর আঁধার নামবে। তার বদলে এমন উজ্জ্বল সংকেত ! সারাটা দিন আতঙ্কে কাটলেও একটা দিন বুঝি পার হলো ভেবে নিশ্চিন্তে ছিলাম। রাতের অন্ধকার নামলো সাড়ে নটার পর।ডিনারের আয়োজনে টেবিল সাজাতে ব্যস্ত ছিলাম , তখন ই খবর এলো সব লড়াই শেষ করে জীবনের লেনা দেনা  চুকিয়ে দিয়ে রীয়ম চলে গিয়েছে না ফেরার দেশে। শোকস্তব্ধ ইয়াম ! যেন বিশাল এক ঘূর্ণি ঝড়ের পর সব তছনছ হয়ে যাওয়া শান্ত প্রকৃতির মত। এখন আর ওর চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে না। ধীর স্থির অভাবনীয় শান্ত যেমন শোক স্তব্ধ,পাথর হয়ে গিয়েছে  রীয়মের মা শেলিনা। 
                                                           
আমার মনের মাঝে বদ্ধমূল এক ধারণা দৃঢ় ছিল যে পাশ্চাত্য সভ্যতায় এই বিদেশী মানুষ গুলো নিজেকে ছাড়া আর কিছুই বোঝেনা ,কাউকে চেনেনা। ওরা আবেগ হীন বড্ড নির্মম কঠোর বাস্তববাদী। নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী চলে বেশ অহংকারী  ,উদ্ধত অবশ্যই  ব্যাক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সামাজিক বা পারিবারিক বন্ধন বলতে এদের তেমন কিছু নেই। কিন্তু পারভীন ইয়াম এম্প্রেস এবং ওদের যত বন্ধু বান্ধব দের সংস্পর্শে এসেছি বেশ বুঝতে পারি আমি এক অদ্ভুত ভ্রান্ত ধারণা মনের মধ্যে পোষণ করে রেখেছিলাম। সবাই কে এক ছাঁচে ঢেলে বিচারে বসলে চলবে না। রীয়াম কে আমি কখোনো দেখিনি শুধুই ইয়ামের কাছ থেকে ওর পারিবারিক গল্প শুনে ওকে যতটুকু জেনেছিলাম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমি যেন কত কাছের একজন খুব চেনা আপন জন কে অসময়ে হারিয়ে ফেললাম।বড্ড মন খারাপ লাগছে ,সারা রাত সবাই মিলে নিশব্দে বাইরের ঘরে বসে রইলাম। ডেকের ওপর বুড়ো এঞ্জেলওক আর সিডারের ডালে বাতাসের ছোঁয়া লেগে পাতা ঝরার খস খস শব্দ। ঝাঁকড়া ইনল্যান্ড রেডউডের মগ ডালে বাসা বাঁধা পাখিদের ডানার ঝাপ্টানি চলে ওদের আশঙ্কা হাওয়ায় বাসাটা নড়ছে নীচে পড়ে যাবে না তো ?  কিছু সময় পরে আবার সব স্থির নীরব। ধীরে ধীরে রেডউডের জঙ্গলের মাথাছুঁয়ে  পূবের দিকে খাড়া পাহাড়ের মাথার ওপর সূর্য্যদেব তাঁর রাজপাট সামলাতে এসে বসলেন।পাখিরা ও নিয়ম মত ভোরের আকাশে তাদের ডানা মেলে দিয়েছে কর্ম ব্যাস্ত জীবনে নিজেকে বিলিয়ে দিতে । 
 
 আজকাল স্মার্ট ফোন খুলে হোয়াটসআপ আর ফেসবুক দেখতে রীতিমত ভয় লাগে। এর মধ্যে কত যে খারাপ খবর পেয়েছি তার ঠিকনেই। কলকাতা থেকে সদ্য খবর পেলাম আমার বন্ধু পরাগ কভিড ১৯ এ আক্রান্ত হওয়ায় বাড়ির লোক সরকারী হস্পিটালে জায়গা না পেয়ে প্রাইভেট হস্পিটালে ভর্তিকরে দিয়েছিল। লকডাউনে এমনিতেই বেকার হয়ে গিয়েছিল পরাগ। ও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলে কি হবে প্রাইভেট হস্পিটালের সাড়ে সাত লাখ টাকা বিল মিটিয়ে ওর অভাবের সংসারের বোঝা বিশাল ভারী হয়ে যাওয়ায় বেচারা গভীর ডিপ্রেশানে চলে গিয়েছিল। আজ সকাল বেলা বাড়ির  চিলেকোঠায় ওর নিঃসাড় ঝুলন্ত দেহ পাওয়া গিয়েছে। অবাক হয়ে ভাবি মানুষের দুঃসময়ের সুযোগ নিয়ে প্রাইভেট নার্সিংহোম গুলো এতো নির্দয় পাষন্ডের মত আচরণ করলো কি করে ? এমন বেহিসেবী কালোবাজারী অর্থ উপার্জনের ধান্দা আমাদের দেশেই সম্ভব। এদের মনুষত্ব কোন তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে ? ভাবতেও বেশ লজ্জা বোধহয়। পরাগের মত এমন যে কত খবর ছড়িয়ে আছে তার ঠিক নেই। এ কেমন সুযোগ সন্ধানীর দল! কারো পৌষ মাস তো কারো সর্বনাশ । 
গত মাসের শেষ সপ্তাহে আমাদের পড়শি রুনি লিজা কে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে জানিনা। মিষ্টার অলিভ হস্পিটাল থেকে ফিরে আসার আর সুযোগ পেলেন না। রুনি লিজা শেষ বারের মত চোখের দেখাও দেখতে পায়নি।  অতনুও ব্রতীন  কে রুনি ডেকেছিল ভারী জিনিস পত্র ট্রাকে তোলার সময় একটু সাহায্য করার জন্য। তখনি জানিয়েছিল, একার আয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার মত কস্টলী সিটিতে থাকা সম্ভব নয়। লস্গাটসের এই লাক্সারি দামী বাড়ি তে ও আর থাকতে পারবেনা ,খরচ বিশাল তাই আপাতত সংসার গুটিয়ে বাড়ি বিক্রি ছাড়া গতি ছিল না। এখন ডাউনটাউনে সস্তায় কোনো এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছে। মা মেয়ের তাতে দিব্যি চলে যাবে। সবচেয়ে আশ্চর্য্য লাগে লীজা যেন সেই চেরীর বাগানে দোল খাওয়া ফুল কুড়োনো ছোট্টো হাসিখুশি মেয়েটি আর নেই ,হঠাৎ কত বড়ো হয়ে গিয়েছে ভারী গম্ভীর ,আত্মগোপন করে থাকতে চায়। ওর বালিকা মনে পিতার মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। কোভিড যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত এই পরিবার টাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। লিজা সবসময় কিছু ভাবছে। প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলে না।    
  
     ডেকের ওপর এসে রোজ সকাল দুপুর বিকেল হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি ,যদি একটা ও প্লেন চলে। আকাশের পথে সাদা দাগ কেটে অনেক উঁচুতে কখনো বা দুই একটা জেট সরকারী কাজে এপার ওপার করে। আমার মনে আশার আলো জাগে এই বুঝি যাতায়াত শুরু হলো। ব্রতীন বলে আগামী তিন মাসে লকডাউন ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই মা। তাই প্লেন চলাচলের ও কোনো আশা নেই। রীতিমত এখোনো অচল পৃথিবী। লস্গাটসে দেখতে দেখতে সাত মাস কেটে গেল। অবস্থার বিশেষ উন্নতি দেখি নি। ইতিমধ্যে আমাদের ভিসা শেষ আগামী নভেম্বরে পাসপোর্ট ও ইনভ্যালিড হয়ে যাবে। মানসিক দুশ্চিন্তায় ঘুম কবেই চোখ থেকে বিদায় নিয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এ যাত্রায় আর হয়তো ঘরে ফেরা হলো না। যতই দেশে বিদেশে ঘুরে পথে পথে বেড়াতে ভালবাসি ,নতুন জায়গা উদার প্রকৃতির ভাষাহারা সৌন্দর্য্যে আত্মনিয়োগ করি।  কিন্তু  নিজের দেশ নিজের শহর নিজের পাড়া ও বাড়ি টির চার দেওয়াল ,দক্ষিণের বারান্দা ,উঠোন দালানের সাথে ছোট্ট আটপৌরে বাগান টি যে কতো আপন এখন প্রতি মুহূর্তে তা অনুভব করছি। মন হাওয়ার থেকেও দুরন্ত গতিতে ছুটে বেড়ায় তারই আনাচে কানাচে।           (ক্রমশঃ)

Post a Comment

0 Comments