বাংলা লেখনী বিষয়ক চর্চা /রাকিবুল হাসান বিশ্বাস

বাংলা লেখনী বিষয়ক চর্চা
রাকিবুল হাসান বিশ্বাস

আমরা জানি যে, যে ভাষায় আমরা নিজেদের মনের ভাবকে ব্যক্ত বা প্রকাশ করে থাকি তা হল মৌখিক ভাষা এবং মনের সেই ভাবগুলিকেই যখন আমরা লেখার মাধ্যমে শব্দবন্ধে সাজিয়ে প্রকাশ করবো, সেটি হবে লিখিত বা লেখ্য ভাষা। লেখার প্রসঙ্গ এলেই ভাষাশিক্ষার প্রসঙ্গও চলে আসে। আমাদের মাতৃভাষা হল বাংলা। আমরা আমাদের জ্ঞান-বোধ সুখ-দুঃখ সহ সকল ধরনের আবেগ আমাদের এই মাতৃভাষা বাংলাতেই প্রকাশ করে থাকি। অর্থাৎ টেকনিক্যাল ভাষায় বলতে গেলে আমাদের ডিফল্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হল বাংলা। তাই অন্য যে-কোনও ভাষাকে অনুবাদের মাধ্যমেই আমাদের বুঝতে হয়। যেমন 'সংখ্যা' বলতে আমরা সংখ্যাই বুঝি। অন্য কোনও শব্দ আমাদের মাথায় সে-সময় আসে না, যেমনটা একজন ইংরেজ 'Digit' বলতে যেটা বোঝে। কিন্তু আমরা যখন Digit শব্দটি শুনি, তখন সেই শব্দটিকে বুঝতে সেটাকে আমাদের অনুবাদ করে নিতে হয়। তার অর্থ যদি আমাদের মেমরি বা স্মৃতিতে স্টোর থাকে তবে সে অটোমেটিক সেটাকে অনুবাদ করে বুঝে নেয়। স্টোর না থাকলে অভিধান বা ডিক্সনারির সাহায্য নিতে হয়। আবার শব্দ যদি নিত্য-নৈমিত্তিক হয়ে পড়ে অর্থাৎ অভ্যাসে পরিণত হয় তাহলে তাকে বুঝতে আর অনুবাদের প্রয়োজন পড়ে না। যেমন 'বিদ্যালয়' বলতে আমরা যা বুঝি 'School' বলতেও আমরা সেটাই বুঝি এবং এক্ষেত্রে মজার ব্যাপার হল School শব্দটিকে বোঝার জন্য অনুবাদ করতে আমাদের মস্তিষ্ককে সেরকম আর দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। তার আর বোঝার প্রয়োজন নেই যে School মানে বিদ্যালয়। অর্থাৎ অনুবাদ ছাড়াই সে এখন শব্দটিকে বুঝতে পারছে। কেননা, শব্দটি তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে নিত্য ব্যবহারের ফলে। 
🍂

তাহলে মোটকথা হল এই যে, আমরা আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করতে এবং অপরের মনের ভাব বুঝতে সাধারণত মাতৃভাষারই আশ্রয় নিয়ে থাকি। আর, যেহেতু বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, সেজন্য তার ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে আমরা অনেক বেশি ওয়াকিবহাল বা দক্ষ। তবে সেই দক্ষতা সাধারণত মৌখিক ভাষার ক্ষেত্রে। লিখিত ভাষার ক্ষেত্রটি একটু আলাদা। কারণ হল, মনের ভাব বা মৌখিক ভাষা এ-দুটিই কিন্তু বিমূর্ত আর লিখিত ভাষা মূর্ত। এবং সে-কারণে ভাষা লিখতে গেলে মৌখিক ভাষার তুলনায় অনেক বেশি শুদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন। অবশ্য এই শুদ্ধতা বলতে আমরা বাক্যের গঠন, শব্দ বিন্যাস, বানান এবং ব্যাকরণগত দিকগুলিকেই বোঝাতে চাইছি। পাশাপাশি মৌখিক ভাষায় কাউকে কোনও মনের ভাব বোঝাতে গেলে আমাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা শারীরিক অঙ্গভঙ্গি অনেকখানি সহায়তা করে। কিন্তু লিখিত ভাষায় সে সুযোগ নেই। তাই লেখককে নানান বিরামচিহ্নের সহায়তা নিতে হয় যা দেখে পাঠক বুঝতে পারে যে, লেখক যদি এটি নিজে আমাকে বলতেন, তাহলে তার মৌখিক ভঙ্গি বা মনের ভাব কেমন হতো। 

আর দরকার অলংকার। লেখক তার মনের ভাবকে কতটা সুন্দরভাবে সরল করে পাঠককে বোঝাতে পারছেন তার উপরও অংশত নির্ভর করে লেখাটির গুরুত্ব; অর্থাৎ, লেখা যদি সাদামাটা হয়, অলংকারহীন হয়, নিরস বর্ণনাই যদি তাতে থাকে তাহলে তা ইতিহাস বা অন্য যে-কোনও বিষয় হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু সাহিত্য হয়ে ওঠে না। সাহিত্যের মুখ্য উদ্দেশ্যই হল সৌন্দর্যকে যতটা সম্ভব মেলে ধরা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এ-প্রসঙ্গে তাঁর 'উত্তর চরিতে' যা বলেছেন তার সারবস্তু হল এই যে, পাঠকের চিত্ত-রঞ্জন বা পাঠককে নীতিশিক্ষা দেওয়া নয়, সৌন্দর্য্যের চরমোৎকর্ষের সৃষ্টিই কাব্যের মুখ্য উদ্দেশ্য। কাব্য বলতে তিনি এখানে সকল ধরনের সাহিত্যকেই বুঝিয়েছেন। তাঁর ভাষায়—"সৌন্দর্যসৃষ্টি কবির সর্বপ্রধান গুণ।" অর্থাৎ, লেখকের প্রধান গুণই হল সৌন্দর্যসৃষ্টি। তিনি সৌন্দর্য সৃষ্টি করবেন, আনন্দ পাবেন এবং পাশাপাশি সেই আনন্দধারায় পাঠকবর্গও সিক্ত হবেন। লেখক সিক্ত করবেন না, যারা প্রকৃত পাঠক—রসিক পাঠক, তারা সেই লেখায় আনন্দ আপনি খুঁজে পাবেন, পাঠক-লেখকের হৃদয় অবিচ্ছেদ্যভাবে মিলিত হবে।— এই হল সাহিত্যসৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য। 

এবার আমাদের লেখাগুলিকে আরও সমৃদ্ধ করার বিষয়ে কিছু কথা। এ-প্রসঙ্গে আবারও আমাদের 'সাহিত্যসম্রাটে'র শরণাপন্ন হতে হবে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন' প্রবন্ধে নতুন লেখকদের উদ্দেশ্যে যে পরামর্শগুলি দিয়েছেন তা আজও প্রাসঙ্গিক এবং অপরিহার্য। এখানে সংক্ষেপে সেগুলি তুলে ধরে এ-আলোচনার ইতি টানব। তিনি বলেছেন,
"১। যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভালো হইবে না। লেখা ভালো হইলে যশ আপনি আসিবে।
২। টাকার জন্য লিখিবেন না। অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে লোক-রঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে।
৩। যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন তবে অবশ্য লিখিবেন।
৪। যাহা অসত্য, ধর্মবিরুদ্ধ, পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য, সে সকল প্রবন্ধ কখনও হিতকর হইতে পারে না। সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য।
৫। যাহা লিখিবেন তাহা হঠাৎ ছাপাবেন না। কিছুকাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছুকাল পরে উহার সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে।
৬। যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই সে বিষয়ে তাহার হস্তক্ষেপন অকর্তব্য।
৭। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করিবেন না। বিদ্যা থাকিলে তাহা আপনিই প্রকাশ পায়, চেষ্টা করিতে হয় না। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা পাঠকের নিকট অতিশয় বিরক্তিকর এবং রচনার পরিপাট্যের বিশেষ হানিজনক।
৮। অলংকার প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টিত হইবেন না। স্থানে স্থানে অলংকার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে; লেখকের ভাণ্ডারে এ সামগ্রী থাকিলে প্রয়োজন মতে আপনিই আসিয়া পৌঁছিবে— ভাণ্ডারে না থাকিলে মাথা কুটিলেও আসিবে না।
৯। সকল অলংকারের শ্রেষ্ঠ অলংকার সরলতা। যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাইতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক।
১০। কাহারও অনুকরণ করিও না। অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত হয়, গুণগুলি হয় না।
১১। যে কথার প্রমাণ দিতে পারিবে না, তাহা লিখিও না। প্রমাণগুলি প্রযুক্ত করা সকল সময়ে প্রয়োজন হয় না, কিন্তু হাতে থাকা চাই।

— এই নিয়মগুলি বাঙ্গালা লেখকদিগের দ্বারা রক্ষিত হইলে, বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে থাকিবে।"

Post a Comment

0 Comments