জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২১ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২১ / সালেহা খাতুন 

উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের পর শুরু হলো নতুন পথে চলা। পিওর সায়েন্সে অনার্স পেলাম না। মানুদা, তপনবাবু, শ্যামবাবু, কুদ্দুসবাবু, বিজনবাবু, রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাজেদ মোল্লা, অর্চনা ম্যাডাম সবার এতো যত্ন সত্ত্বেও অঙ্কে রয়ে গেলাম কাঁচা। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতে অত্যন্ত পুওর মার্কস দেওয়ায় ফার্স্ট ডিভিশন হলো না, ফলে পড়া হলো না BHMS. পরীক্ষা ভালোই হয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম।

 উলুবেড়িয়া কলেজে বায়ো সায়েন্সের সবগুলি বিভাগ এবং বাংলা ইংরেজিতে অনার্স পড়ার সুযোগ পেয়েও বিজনবাবুর পরামর্শ মতো চলে এলাম প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে। ভর্তি হলাম বাংলা অনার্স নিয়ে। রেজাল্ট বেরোনো থেকে শুরু করে বাংলা অনার্সে ভর্তি হওয়া এই যে দীর্ঘ সময় আমি নীরবে অশ্রুপাত করে কাটিয়েছি, পড়ার ঘরের একটি জানালা জানে আমার এই ক্রন্দনের কথা। বিজনবাবু আর বাবা জুগিয়েছেন সাহস। বিজনবাবু জানতেন আমি অ্যাকচুয়ালি সায়েন্সের স্টুডেন্ট নই, আর বাবা বুঝেছিলেন সায়েন্স দিলে টিউশন পড়ার জন্য ছোটাছুটির ধকল আমি নিতে পারবো না আর তিনিও রাতের অন্ধকারে হ্যারিকেন নিয়ে স্টেশনের পথে অপেক্ষা করতে পারবেন না।
আর মামাতো দাদা আলোদা রেজাল্টটাকে ভোলার মন্ত্রণা দিল। বললো ‘আঘাত  নতুন পথের সন্ধান দেয়’। স্বপ্ন দেখালো বাংলাকে অবলম্বন করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে ক্লাস শুরু হতে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পেলাম। প্রেরণাদাতা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. পরিতোষ সরকার। তিনি প্রথম দিন ক্লাসে যে কথাগুলি বলেছিলেন আমিও আমার ছাত্রছাত্রীদের সেই একই কথা বলি। তিনি বলেছিলেন, 
“দেখো বাংলা পড়ে আমি যখন কিছু করে খেতে পারছি তখন তোমরাও পারবে”। তাঁর জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা, বাইরের নানা রকম অভিজ্ঞতা, নৈতিক চরিত্র গঠন সম্বন্ধীয় উপদেশ, পড়াবার স্টাইল আমার মন জয় করে নেয়। উনি মনে করতেন “ আমি যা জানি আমার ছাত্রছাত্রীরাও তা জানে।” যদি কোনো সময় আমরা ক্লাসে ভুল উত্তরও দিয়ে থাকি, তাহলেও উনি বলতেন, “ হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ।” তারপর এমনভাবে বুঝিয়ে দিতেন যে তখন আমরা ধরতে পারতাম আমাদের উত্তরটা কতখানি অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে।
🍂

 পড়ার(সিলেবাসের) বই ছাড়াও বাইরের আরো নানান ধরনের বই পড়তে উপদেশ দিতেন। তিনি সত্যিই বড়ো কোমলপ্রাণ। পড়ার বিষয়ের বিভিন্ন চরিত্রের দুঃখে কাতর হয়ে পড়তেন। কণ্ঠস্বরের এমন পরিবর্তন হতো যে আমরা ভাবতাম উনি বুঝি কাঁদছেন। আবার তিনি প্রফুল্ল হৃদয়ও বটে। কোনো হাসির কারণে এতো হাসতেন যে দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তো। তিনি আশাবাদী ছিলেন। তিনি আশা করতেন আমাদের দ্বারা অর্থাৎ তাঁর ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা অনেক কিছু সম্ভব। তাঁর মতো উদারমনোভাবাপন্ন ব্যক্তি প্রায় বিরল। কাউকে ছোটো করেন না। শ্রদ্ধায় আপনি মাথা নুয়ে আসে। আবার দারুণ অভিমানীও বটে। ওঁর পড়ানো মনোযোগ সহকারে শুনতে হবে।

কলেজের বার্ষিক পরীক্ষায় আমার বাংলার খাতা দেখে তিনি অবাক হন। কাঁধ শক্ত রাখতে বলেন। বলা যায় তিনি আমাকে আবিষ্কার করেন। ওই যে উচ্চমাধ্যমিকের খারাপ রেজাল্ট, তা থেকে মুক্তি পেতে সঞ্চয়িতায় মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম। প্রতিটি কবিতা তন্নতন্ন করে পাঠ করে নিজের ভাষায় সারমর্ম লিখে ফেলেছিলাম। সেটাই আমাকে করে তুললো সাহিত্য বোদ্ধা। যখন কিছু ভালো লাগতো না সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে বসতাম আর মন উৎফুল্ল থাকলে কবিতা পাঠ করতাম। প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে(১৯৯১-১৯৯৪) আমার ক্লাসে রোল নম্বর ছিল ৫৩। রোল কলের সময় স্যারের ক্লাসে কোনো কোনো দিন সাড়া দিতে ভুলে গেলে স্যার নিজেই অ্যাটেন্ডেন্স দিয়ে দিতেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি আমাদের সমস্যা- সংকট অনুধাবন করতেন অত্যন্ত আন্তরিকভাবে। 

বহুদিন পর্যন্ত জানতাম না স্যার শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের অনুজ। ২০১৪-১৫ তে প্রকাশিত স্যারের আত্মজীবনী “নকশিকাঁথার জীবন” (দু খণ্ড) পড়ে জানতে পেরেছি সেকথা। জেনেছি তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের বিলোনিয়া সরকারি মহাবিদ্যালয়ে প্রায় চোদ্দো বছর পড়ানোর পর প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে পড়াতে আসেন।এখানেও প্রায় বারো বছর পড়ানোর পর অধ্যক্ষ হিসেবে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার সুশীল কর কলেজে সাত বছর কর্ম সম্পাদন করেন।গল্প উপন্যাসও লিখেছেন। তাঁর গল্প সংকলন “গান্ধীনগর” ছাত্রজীবন থেকেই আমার সংগ্রহে আছে। 
স্যারের আত্মজীবনীর ব্লার্বে আছে, “ হওয়ার কথা ছিল বাদামবিক্রেতা-আখবিক্রেতা-তালশাঁসবিক্রেতা, রিক্সাচালক। ব্যবসায় হাতেখড়ি সাইকেল রিক্সা সারাই। হওয়ার কথা ছিল প্রভু জগদ্বন্ধু আশ্রমের দীক্ষিত সাধু, রেলকারখানার মেকানিক, মিলিটারি বিভাগের ওয়ারলেস অপারেটর। হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বিড়িশ্রমিক কিংবা গায়ক-অভিনেতা-সাহিত্যিক। কৈশোরেই জীবনযন্ত্রণায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে আত্মীয়স্বজনের প্রতি অভিমানে ফাঁসির দড়ি গলায় ঝুলিয়ে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। রাজনীতির হাটে দোকান সাজিয়ে নেতা হওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ কম ছিল না।
কিন্তু এত সব মহার্ঘ সম্ভাবনার পদস্খলন। লোভ মোহ অক্ষমতার পাশ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত জীবনতরণী নির্দিষ্ট এক ঘাটে এসে ভিড়ল। যার একদিন স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার দুস্তর বাধা ছিল, তার পক্ষে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার হওয়া তো এক অলীক স্বপ্ন!একদিন সে স্বপ্নও কেমন বাস্তবে ঘটে গেল!” 

আমার স্যার এমনই। তাঁর জীবনকথা আজকের হতাশাগ্রস্ত  ছাত্রসমাজকে,  লড়াকু ছাত্র সমাজকে প্রেরণা জোগাবেই এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি “নান্দীকার”এর সদস্য-অভিনেতাও ছিলেন। এখনো তিনি লেখালেখি করছেন।
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments