রাজনারায়ণ বসু ও মেদিনীপুর ব্রাহ্ম সমাজ /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৮৯
রাজনারায়ণ বসু ও মেদিনীপুর ব্রাহ্ম সমাজ

সূর্যকান্ত মাহাতো


মেদিনীপুরে ব্রাহ্মসমাজকে নতুন করে সংস্থাপন এবং তার প্রভূত উন্নতি সাধন ঘটিয়েছিলেন 'রাজনারায়ণ বসু'। যদিও মেদিনীপুরে ব্রাহ্মসমাজের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা তিনি ছিলেন না। প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তৎকালীন মেদিনীপুরের ডেপুটি কালেক্টর 'শিবচন্দ্র দেব'। ১৮৪১ সালে তিনি মেদিনীপুরে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 'রাজনারায়ণ বসু' প্রথম মেদিনীপুরে আসেন ১৮৫১ সালে। অর্থাৎ তার মেদিনীপুরে আসার দশ বছর আগেই এখানে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 'আত্মচরিতে' রাজনারায়ণ বসু নিজেই সে কথা জানিয়েছেন, "আমি ইংরাজি ১৮৫১ সালের প্রথমে মেদিনীপুরে যাই। তাহার প্রায় দশ বৎসর পূর্বে কোন্নগর নিবাসী প্রসিদ্ধ ব্রাহ্ম এবং সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ভূতপূর্ব সভাপতি শ্রীযুক্তবাবু শিবচন্দ্র দেব দ্বারা (মেদিনীপুর সমাজ) স্থাপিত হয়। (আত্মচরিত, পৃষ্ঠা ৫২, উৎস: রাজনারায়ণ বসু রচনা সংগ্রহ, সম্পাদনা- বারিদবরণ ঘোষ।)

মূলত শিক্ষকতার পেশাগত কারণে রাজনারায়ণবাবু মেদিনীপুরে এসেছিলেন। 'সংস্কৃত কলেজ' থেকে বদলি হয়ে ১৮৫১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মেদিনীপুর জেলা স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগদান করেছিলেন। দীর্ঘ পনেরো বছর তেরো দিন পর্যন্ত অর্থাৎ১৮৬৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি এই পদে যুক্ত ছিলেন। মেদিনীপুরে এই দীর্ঘ সময় যাপন কালে তিনি যে মহান কর্মগুলি করেছিলেন তার একটি তালিকাও তিনি বর্ণনা করেছেন তার আত্মচরিতে। সেগুলি হল---
১) মেদিনীপুর জেলা স্কুলের উন্নতি সাধন।
২) মেদিনীপুর ব্রাহ্ম সমাজের পুনঃ সংশোধন ও উন্নতি সাধন
৩) জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা সংস্থাপন
৪) সুরা পান নিবারণী সভা সংস্থাপন
৫) বালিকা বিদ্যালয় সংস্থাপন
৬) বক্তৃতা, ধর্মতত্ত্বদীপিকা ও ব্রাহ্মধর্ম সাধনা
৭) 'ডিফেন্স অফ ব্রাহ্মইজম অ্যান্ড দি ব্রাহ্মসমাজ' নামক বক্তৃতা প্রদান

'শিবচন্দ্র দেব' তখনকার দিনে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করলেও কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না। অজস্র গালমন্দ ও সমালোচনা তাকে সহ্য করতে হয়েছিল। রাজনারায়ণ বসু তার একটা উদাহরণও দিয়েছেন। আসলে 'মেদিনীপুর ব্রাহ্মসমাজ' নিজেকে আদিব্রাহ্মসমাজের শাখা বলে পরিচয় দিত। তাই জনৈক পত্র লেখক 'প্রভাকর' পত্রিকায় মেদিনীপুর ব্রাহ্মসমাজকে 'ক্ষীন শাখা' বলে শ্লেষ প্রকাশও করেছিলেন। (আত্মচরিত, পৃষ্ঠা- ৫৩) রাজনারায়ণবাবু তার আত্মচরিতে বলেছেন, ১৮৫২ সালের প্রথম দিকে মেদিনীপুরে ব্রাহ্মসমাজ পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ সে অর্থে প্রকৃত সমাজ বলতে তখন সেরকম কিছু ছিল না। কেবল বলাগড় নিবাসী শিবচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের বাড়িতে উপাসনা হত। তারপর তা উঠে আসে রাজনারায়ণবাবুর মেদিনীপুরের স্কুল বাড়িতে। এর কয়েক বছর পর চাঁদা তুলে 'সমাজগৃহ' নির্মিত হয়েছিল। ব্রাহ্মসমাজ এর অন্যতম ব্যক্তিত্ব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একাই নাকি আটশ টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন।

রাজনারায়ণবাবুর ঘর থেকে উপাসনার স্থান 'সমাজ গৃহে' নিয়ে যাওয়ার দিনটি বেশ সমারোহের সঙ্গে পালিত হয়েছিল। ঐদিন কাঙাল ভোজনের আয়োজনও করা হয়েছিল। সেখানে নাকি হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও যোগ দিয়েছিলেন। মেদিনীপুরে ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব এত বেশি পড়েছিল যে নবীনচন্দ্র নাগ, অখিল চন্দ্র দত্ত এবং নীলকমল দের মতো ব্রাহ্মরা পর্যন্ত গার্হস্থ‍্য ক্রিয়াকর্মে পৌত্তলিকতা বর্জন করেছিলেন। এই অখিল চন্দ্র ব্রাহ্মসমাজের একজন প্রচারক হবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। পাশাপাশি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ঘুরেছিলেন এ বিষয়ে তার কাছ থেকে কিছু উপদেশ লাভের জন্য। পরবর্তীকালে মেদিনীপুরের বিখ্যাত সংবাদপত্র 'মেদিনী'-র সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি।
🍂

রাজনারায়ণ বসু তার ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ 'ধর্মতত্ত্বদীপিকা' মেদিনীপুর বসবাসকালেই রচনা করেছিলেন। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে এই গ্রন্থকে শ্রেষ্ঠ বলার কারণ হল, তিনি নিজে এই গ্রন্থকে গ্রন্থের ভূমিকা অংশে 'মানসকন্যা' বলে উল্লেখ করেছিলেন। আবার তিনি তার স্বাস্থ্য হানির জন্যও ঐ গ্রন্থকে দায়ী করেছেন। উপহাস করে বলেছেন, "ঐ বেটি আমাকে খেলে।" কারণ এই গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে তাকে বিস্তর চিন্তা ও মানসিক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে,অর্থাৎ ১৮৫৩ সাল থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থ সম্পর্কে তার নিজের কথায়, "এই ধর্মতত্ত্বদীপিকা প্রণয়নই আমার স্বাস্থ্যনাশের প্রধান কারণ। উক্ত গ্রন্থ প্রণয়নে আমাকে অনেক চিন্তা করিতে হইয়াছিল।" (আত্মচরিত, পৃষ্ঠা- ৫৪)

মেদিনীপুরে ধর্মোৎসাহ নিয়ে সে সময় দারুণ একটা উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল। রাজনারায়ণ বসুর প্রভাব ও অবদান ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি বহু জনকে ব্রাহ্ম করেছিলেন। তার মধ্যে ব্রজেন্দ্রনারায়ন দেব ছিলেন উল্লেখযোগ্য। যিনি আবার মেদিনীপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। শুধু তাই নয়, রাজনারায়ণবাবুর ব্রাহ্ম ধর্মের লক্ষণ বিষয়ক বক্তৃতা পাঠ করেই নাকি কেশববাবু ব্রাহ্ম হয়েছিলেন।(আত্মচরিত, পৃষ্ঠা- ৫৪) মেদিনীপুর ব্রাহ্ম ধর্মের দুটি ভাগ ছিল। একটি 'মধুর' ভাগ অন্যটি 'কঠোর' ভাগ। 'মধুর' ভাগটি ছিল 'ব্রাহ্ম সংগীত'। চুঁচুড়ার প্রেমচাঁদ গুপ্ত ব্রম্ভ সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। তবে এই সঙ্গীত নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করতেন। এই সঙ্গীত নিয়ে কেউ একজন নাকি মন্তব্য করে বলেছিলেন, "ঐ পাড়ায় মাতালের গ উঠেছে।" ব্রাহ্ম ধর্মের 'কঠোর' ভাগটি ছিল 'ধর্মীয় অনুষ্ঠান।' মেদিনীপুরেই প্রথম 'ধর্মীয় অনুষ্ঠান'-টি অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাজনারায়ণবাবুর মেয়ের বিবাহ উপলক্ষ্যে। ব্রাহ্ম মতেই ঐ বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। ব্রাহ্মসমাজ এর মধ্যে তখনো মতবিরোধ গড়ে ওঠেনি বলে দেবেন্দ্রনাথবাবু ও কেশববাবু উভয়ই মেদিনীপুরের ঐ বিবাহ অনুষ্ঠানের যোগ দিয়েছিলেন।

রাজনারায়ণ বসু মেদিনীপুরের ব্রহ্ম ধর্ম গ্রহণকারীদের মধ্যে একটি নতুন প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। সে সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, "সে প্রথা নৈসর্গিক শোভায় শোভিত সুরাম্যস্থানে কখন কখন উপাসনা।" সেইজন্য বসন্তকালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে মেদিনীপুরের গোপ-গিরিতে প্রতিবছর এই ব্রাহ্ম বসন্ত উৎসব পালন করা হত।

১৭৭৫ শকের ২৩শে মাঘ রাজনারায়ণ বসু ব্রাহ্ম ধর্মের লক্ষণ বিষয়ক তার শ্রেষ্ঠ বক্তৃতাটি মেদিনীপুর ব্রাহ্ম সমাজে পাঠ করেছিলেন। সেখানে তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের আটটি লক্ষণের কথা বলেছিলেন। "একমেবাদ্বিতীয়ং" নামে ব্রাহ্ম সমাজের বক্তৃতামালার ৯৫ থেকে ৯৮ পৃষ্ঠায় সেই লক্ষণগুলি বর্ণিত হয়েছে। অতি সংক্ষেপে সেই আটটি লক্ষণ হল---

প্রথম লক্ষণ হল, এই ধর্মে কোন জাতিগত নিয়ম নেই। সব জাতির মানুষেরই এ ধর্মে অধিকার আছে।

দ্বিতীয় লক্ষণ হল, এই ধর্মের উপাসনায় দেশ কালের কোন নিয়ম নেই। যে স্থানে এবং যে সময়ে  চিত্তের একাগ্রতা হবে সে সময় সেই স্থানে ঈশ্বরে মন রাখা যাবে।

তৃতীয় লক্ষণ হল, এ ধর্মে কোন গ্রন্থেরও নিয়ম নেই। ব্রহ্ম প্রতিপাদক বাক্য যে  গ্রন্থে পাওয়া যাবে সেটাই গ্রহণীয়।

চতুর্থ লক্ষণ হল, এই ধর্ম কোনরকম কৃচ্ছ্র সাধন সাপেক্ষ নয়।

পঞ্চম লক্ষণ হল, এই ধর্মে সংসার পরিত্যাগ করা বিধেয় নয়। যে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,"কামাদি রিপু যাহার বশীভূত হয় নাই সে ব্যক্তি সংসার ত্যাগ করিয়া অরণ্যবাসী হইলে তাহার অত্যন্ত বিপদ; আর যে সাধকের কামাদি রিপু বশীভূত হইয়াছে, তাহার আর সংসার ত্যাগ করিবার প্রয়োজন কী?"(একমেবাদ্বিতীয়ং/ রাজনারায়ণ বসু, পৃষ্ঠা- ৯৭)

ষষ্ঠ লক্ষণ হল, এ ধর্মের সঙ্গে বাহ্য আড়ম্বরের কোন সম্বন্ধ নেই।

সপ্তম লক্ষণ হল, এ ধর্মে তীর্থের কোন নিয়ম নেই। যে কোন স্থানই তীর্থ।

অষ্টম লক্ষণ হল, এ ধর্মে প্রায়শ্চিত্ত বলে কিছু নেই। অনুতাপই হল প্রায়শ্চিত্ত।

কেবল মেদিনীপুর নয়, মেদিনীপুরের পাশাপাশি লক্ষ্মণনাথ, জলেশ্বর এর মতো একাধিক জায়গায় রাজনারায়ণবাবু এই ধর্মের প্রচারে যেতেন। যে সময়টুকু তিনি মেদিনীপুরে ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তার মেদিনীপুর থেকে গমনের পরই ধীরে ধীরে এই ধর্মের প্রভাব ক্রমশ কমতে শুরু করেছিল। তার দীর্ঘ বক্তৃতাগুলোর বেশির ভাগই মেদিনীপুরে দেওয়া। সুতরাং মেদিনীপুর ছিল একসময় ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম পীঠস্থান।

তথ্যসূত্র: ১) রাজনারায়ণ বসু রচনা সংগ্ৰহ/ বারিদবরণ ঘোষ ২) একমেবাদ্বিতীয়ং/ রাজনারায়ণ বসু

Post a Comment

0 Comments