জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমাপর্ব- ১১/গৌতম বাড়ই

চিত্র- চন্দ্রিমা ঘোষ 
  
সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ১১
গৌতম বাড়ই

মেঘগর্জনে জীমূতনাদের পিঠে চড়ে ওরা

বঙ্গের রাজধানী ছেড়ে হাওয়ার গতিতে সকাল হওয়ার আগে ক্রোশ ক্রোশ মাইল দূরত্ব এরমধ্যে রচনা করে ফেলেছেন সেনাপতি অনুর । রাজকন্যা সুসীমা মাঝে, আর সামনে ঘোড়ার এপিঠ- ওপিঠ করা ভরতভৃগুর মৃতদেহ ঝুলছে, শক্ত করে বেঁধে নেওয়া হয়েছে, অনুর চলেছেন ঘোড়া ছুটিয়ে উত্তরদিকে আড়াআড়ি ভাবে। এই পথ সোজাসুজি পশ্চিমদিকে যাওয়ার থেকে বেশি বিপদশঙ্কুল , তবে এই মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো বিকল্প আর কিছু নেই। ভোরের আলো উজ্জ্বল হওয়ার আগেই তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে ফেলতে হবে। ডানহাতে গভীর জঙ্গল, রাস্তা উঁচু- নিচু, অনুর হালকা অন্ধকারে শীতল বাতাসে টের পাচ্ছিল,  নদী বেশি দূরে নয় মনে হল। অন্ধকার ক্রমে আরও পাতলা হয়ে এসেছে। জীমূতনাদের ক্ষুরধ্বনিতে হিংস্র পশু বা আদিম বনবাসী জংলীরা হয়ত আড়াল নিয়েছে, বলবান আর তেজস্বী পুরুষের ঘোড়ার পদধ্বনি নাকি দূর থেকেই অনুভব করা যায়, আরও নিকটে এলে কর্ণগোচর হয়, এ সহস্র বছর আগেকার কথা। এক বর্ণ মিথ্যে নয় আজকেও।

সুসীমার দেহের পেছন অংশ এখন সেনাপতি অনুরের বক্ষদেশে লেপ্টে আছে। সেই বিরাট বক্ষদেশে নিজেকে নিক্ষেপ করে বসত যদি সন্মুখে মুখোমুখি হতে পারত। এরকম হাওয়ার গতিবেগে তো তা সম্ভব নয়। তবে রাতের শরীর থেকে যে শীতল বাতাসে দেহ জুড়িয়ে আসছিল, তাতে যেন দু- চোখ সুপ্তিতে জড়িয়ে এলো। তার সামনে সেই ঝুলন্ত নিথর অবয়ব। একদিকে ঘৃণা আর একদিকে চূড়ান্ত দূর্মর এক বন্য প্রাকৃতিক  ভালোবাসার মাঝে দুরন্ত গতির বাহনে সুসীমার সেই দুঃসাহসিক পলায়ন অভিযান, রাজপ্রাসাদের বন্দী জীবন দূরত্ব রচনা করেই চলেছে সময়ের সাথে সাথে। এখন ভোরের আলো ফুটে উঠছে, তবুও সেই জঙ্গলের গভীরে অনুর প্রবেশ করতেই অন্ধকার যেন আবার নতুন করে জন্ম নিল। আরও কিছুটা গিয়ে যেন মনে হল, ভূমিভাগ উঁচু হয়ে উঠছে যেন, নরম মাটি দেখে এবারে ঘোড়া থামিয়ে সেনাপতি অনুর ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল। জীমূতনাদেরও কিছুটা বিশ্রাম প্রয়োজন। পথে বার দুয়েক জলপান করেছে, তবে এবারে জল ও খাবার দুটোই তার দরকার। সামনেই শাদ্বল ভূমি পেয়েছে। তাকে এই মুহূর্তে খাওয়ানোর জন্য বেশ উপযুক্ত। কাপড়ের থলেতে কিছু ছোলারদানা রয়েছে।  তার চেয়েও প্রয়োজন আরও একটি কাজ সেরে ফেলা। ঘোড়ার পিঠে বাঁধা চামড়ার পুঁটলি থেকে অনুর একটি অস্ত্র বের করল, যা দিয়ে নরমমাটি কুপিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা আয়তাকার গর্ত খুঁড়ে ফেলল। অল্প দূরের ঘাস জমিতে বসে সুসীমা সেনাপতি অনুরের সমস্ত কাজকর্ম অবাক চোখে মেলে খেয়াল করছিল। ঘোড়ার পিঠে বাঁধা এধার- ওধার করা ভরতভৃগুর মৃতদেহ। মুণ্ডুটা যেন মাটির দিকে ঝুলে পৃথিবীর আদিম রহস্য আর কুটিলতা বুঝে নিতে চাইছে। অনুর ধীরে ধীরে কাছের জলাশয়ের দিকে এগোল, চোখের ইশারা করল সুসীমাকে হাত ধুয়ে আসছে বলে। এসে দড়ি আর লতাপাতায় বাঁধা ভরতভৃগুর নিস্পন্দ দেহ নামাল জীমূতনাদের পিঠ থেকে, শুইয়ে দিল পাতার সজ্জায়‌ । অরণ্যের গাছগাছালির পাতা সূর্যের ঠিকরে পড়া  আলোয় সবুজ হচ্ছিল। ভরতভৃগুর দিকে খানিকক্ষণ মুখ নিচু করে চেয়ে রইল সেনাপতি অনুর। মুখ তুলে পাথরের নিচে উঁচু ঘাসজমিতে বসা সুসীমার দিকে চেয়ে বলল সে, " গুপ্তচর চিরতরে ঘুমিয়ে থাকবে এই মাটির নিচে চাপা পড়ে। এই ইতর নিচকে যদি জংলী কুকুর আর শৃগালে না ভক্ষণ করে তো, তবে মাটির কীট পোকা মাকড়ে খাবে। ভেবেছিল সেই যেন অন্ধকারে মিশে থাকা ভয়ানক সরীসৃপ, ভাবনাটা ভুল ছিল------ ঘুমিয়ে থাকো হে উচ্চাকাঙ্খী রাজ গুপ্তচর!" আকাশে হাত মুঠো করে উঁচিয়ে ধরে অনুর উদীয়মান সূর্যকে স্পষ্ট প্রতীয়মান না হলেও, প্রণাম করল। ধীর পায়ে হেঁটে গেল সুসীমার দিকে। 

সুসীমার দুই বাহুতে তার দুটো হাত আলতোভাবে লাগল। বলল- " এসো আজ এই ঘৃণ্য মৃতদেহকে মাটি চাপা দিয়ে মৃত্যুর আনন্দ উদযাপন করি। " দুজনেই দ্রুত ভরতভৃগুকে মাটি চাপা দিল। আবার জলাশয়ে গিয়ে চোখেমুখে জল দিল, হাত জল দিয়ে ধুয়ে নিল ভালো করে। সুসীমার অঙ্গে রাজকন্যারই মতন পরিধেয়  বহু মূল্যবান রেশম বস্ত্র, জলের শীতল স্পর্শে তার চোখে মুখে উজ্জ্বলতা ফিরে এল। অনুরের চোখদুটো সরছে না যেন এদিক থেকে, সুসীমা এগিয়ে গেল সেই স্বপ্নের কাঙ্ক্ষিত বাহুবলী পুরুষের দিকে, ঠোঁটে ঠোঁটে আঁকা হয়ে গেল প্রণয়ের অন্য এক ইতিহাস। অনুর সুসীমাকে বিরত করল,- " রাজকন্যা তোমাকে আমায় বঙ্গরাজের ধরাছোঁয়ার বাইরে পৌঁছে দিতে হবে আগে, অতএব আর বিলম্ব নয়।" 

জীমূতনাদের পিঠে আরোহণ করে এবারে দুজনে সেই গভীর জঙ্গলাকীর্ণ স্থান ছেড়ে একটু হালকা আলোয় ফিরতে চাইছিলেন মানুষের চলাচলের সুগম পথে। কিন্তু কোথায় জনমানব? এ তো জনমানব শূন্য , বসতিবিহীন গভীর অরণ্য।  তাদের পৌঁছে যেতে হবে আরও দূরে। আরও নিরাপদে। এ তো সুসীমার বৃহত্তম পলায়ন, তার বন্দী জীবন ছেড়ে। 
🍂

এই অগস্ত্য যাত্রায় সঙ্গী আর কেউ হবেনা রাজকন্যার অবশেষে। অনুর তাকে এ পলায়নে সহায়তা করবে কিছুটা।  তাই সেনাপতি অনুরের বুকেও দুন্দুভি বেজে উঠেছিল, সুসীমা অসীম ধৈর্য্যের বদলে একি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলেন!  নির্ঘাৎ বেঘোরে প্রাণ হারাবে এ মেয়ে এই জঙ্গল প্রদেশে। অল্প বয়সে মানুষ হিতাহিত হয়ে যায় অভিজ্ঞতার অভাবে, ভালো যেমন হয় আবার মন্দও ঘটে তার চেয়ে আরও বেশি। তবে এই দৃঢ়চেতা নারীকে তার সিদ্ধান্ত থেকে হঠানো শুধু মুশকিল নয়, অসম্ভব বটে। অনুরের এই লৌহসদৃশ শরীরের প্রাচীরের তলে, যে তুলতুলে নরম লালরঙের হৃদয়মনপাখি নীল আকাশে উড়তে শুরু করেছিল, সেজন্য সেনাপতির রাজকন্যাকে এই জঙ্গল দেশে ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। তবু তাকে ছেড়ে আসতেই হবে। তাকে আগামীর নাটকের পট সাজাতেই হবে। তার চিরশত্রুর জীবন ইতিহাস চাপা পড়ে থাকবে বঙ্গের জঙ্গলে নরম মাটির তলে। হারিয়ে যাবে বনের গভীরে। সাক্ষী থাকবে এই অরণ্য, টিলা পাহাড়, বনের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা পশু, পাতার আড়ালে বসে থাকা পাখিরা, ঘুমে ঢুলুঢুলু রাতচরা পাখিরা। আর পৃথিবীর সমস্ত ঘটনার আদি ও অনন্ত সাক্ষী এই আকাশ, এই সূর্য, প্রকৃতি, সবুজ ঘাসের মাঠ, পাহাড়।

উঁচুনিচু পাহাড় আর লালমাটির সুবাসে রাঢ় প্রদেশের জঙ্গল শুরু হয়েছে। এখানেও জঙ্গল সুদূর বিস্তৃত, তবে ঘনত্ব কম। হঠাৎ জীমূতনাদ জোরে চিঁ- হি-হি করে উঠল। অনুর ঘোড়া থেকে চকিতে নেমে মাটিতে ঘাসের ওপর কান পাতলো। সুসীমা অজানা ভয়ে আর বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। অনুর এগিয়ে এসে বলল- " সুসীমা তোমায় এবার একলা এগিয়ে যেতেই হবে। দূরের থেকে রাজার প্রেরিত সৈন্যদলের ঘোড়ার ক্ষুরধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তারা এগিয়ে আসছে। আমি তাদের প্রতিহত করে কৌশলে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। আমিও তো ওদের সেনাপতি, আশা করছি খুব একটা বেগ পেতে হবে না। তুমি এগিয়ে যাও সুন্দরী। যদি এই পৃথিবীর ভূমিতে তোমার জীবন্ত অস্তিত্ব থাকে, জানবে আমি রয়েছি তোমার জন্য তখনও। যাও সাবধানে সুন্দরী। আমি এই নিয়ে বেঁচে থাকব সমস্ত যুদ্ধ- বিগ্রহের শেষে , একদিন আমি পৃথিবীর সেরা সুন্দরীর স্পর্শ পেয়েছিলাম আমার শরীরের রক্তধারার মাঝে। যাও সুসীমা, বিদায়, চিরবিদায় বলব না। সুন্দরী যাও ---- তোমার অনন্ত পথে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তুমি সেই ইতিহাস রচনা করবে, যা হারিয়ে গিয়েও হারাবে না, থাকবে এক টুকরো হয়ে। " এরপর সেনাপতি অনুর ঘোড়ার পিঠ থেকে হাত ধরে নামালেন রাজকন্যাকে,  প্রশস্ত বুকের মাঝে টেনে নিলেন রাজকন্যাকে। ওষ্ঠে- ওষ্ঠে রচিত হয় ভালোবাসার স্পন্দন, ছড়িয়ে পড়ে এ ভূ- গোলকে। বনের গাছপালা সব দুলতে থাকে, জীমূতনাদ মাথা নেড়ে এই প্রণয়কে স্বীকৃতি দেয়। সুসীমা অনুভব করে ওরকম লৌহমানবেরও এক তুলতুলে নরম বসন্ত বাতাসের মতন বুক। পৃথিবীর সব শক্ত পাথরের মতন বক্ষও ভালোবাসার আগুনে নরম তুলতুলে হয়ে ওঠে! প্রণয় তবে আগুনও জ্বালায়? যেই আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার মতন এ সময় নয় অনুরের। যদি একদিকে থাকে বিশ্বাস, তবে অন্যদিকে বিশ্বাসঘাতকতা।

এগিয়ে যেতে হবে সুসীমাকে। অনেক দূর থেকে অস্ফূট কিছু শব্দ ভেসে এলো, এবারে সুসীমাও স্পষ্ট শুনল তা। 

" যাও তুমি রাজকন্যা"- এই বলে হাত ধরে এগিয়ে দিল সুসীমাকে সেনাপতি অনুর। হাত তো তার দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ, অনুরের মতন শক্তিশালী যুবারও আজ এই মুহূর্তে শক্তি যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। পলে- পলে শিথিল হল অনুরের মানসিক শক্তিতে। সুসীমার হরিণের মতন স্নিগ্ধ চোখ দুটিতে পাহাড়ি ঝর্ণার ধারা। এ এক নিরুদ্দেশের যাত্রা।

 " সেনাপতি আমাদের আবার দেখা হবেই। তোমার কাছে ঘূর্ণন পথে আবার ফিরে আসব। যে ভাবে চাঁদ ফিরে- ফিরে আসে, সূর্য ফিরে- ফিরে আসে, ঋতু ফিরে আসে এ পৃথিবীর কাছে। " রাজকন্যা সুসীমা এবার দ্রুতপদে দূরত্ব রচনা করছে। অনুর বললে-" আমি অনন্ত অপেক্ষা করে থাকবো সুন্দরী।

সেই জঙ্গলদেশে জীমূতনাদের পৃষ্ঠে আরোহণ করে সেনাপতি অনুর বঙ্গদেশের গন্তব্যে রওনা হল। প্রতিহত নয়, তার সেনাদলকে রাজকন্যার অনুসন্ধানে নিবৃত্ত করে, আবার বঙ্গদেশের রাজপ্রাসাদের  দিকে তাদের নিয়ে হাজির হবে। যে সব ফেলে অজানা উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে,সেই পথে আর ফিরে তাকাতে নেই। প্রেম- প্রণয়ের এই পথ ক্রমে সুদূরে মিলিয়ে যাবে। তবে আর কিন্তু কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। হাতে খোলা তরবারি হাওয়ায় দুলিয়ে অনুর বাতাসের চেয়েও বেগে উল্টোপথে চলতে লাগল। এ দূর পথ তার অচেনা- অজানা। এর আগে তার কোনদিন এখানে তার পদচিহ্ন আঁকা হয়নি। আজ সেখান থেকেই ফিরতে হবে। অনুর সতর্ক ও সাবধানী হয়েই ফিরছে। সেনাপতি অনুরেরও জানা নেই ঠিকমতন কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ বঙ্গদেশের সীমানা। 

রাজকন্যা সুসীমা সন্তর্পণে কখনও দ্রুত, আবার কখনও মন্থর হয়ে জঙ্গল পথে দিক দিশাহীন এগিয়ে যেতে থাকল। সঙ্গে পিঠের ঝোলায় সামান্য কিছু শুকনো খাবার রয়েছে, এ খাদ্যও অনুর এক পল সময়ে রাজকন্যাকে রাজপ্রাসাদের থেকে পলায়ন পর্বের মুহূর্তে জোগাড় করে তার সাথে দিয়েছিল। ঐ সামান্য খাবার খেয়ে হয়ত আরও দু- চারটি দিন বেঁচে থাকতে পারবে! যদি না পথে ভয়ংকর কিছুর কবলে পড়ে, তবে ষোড়শো জনপদের অন্যতম মগধে, তার গন্তব্য ঠিক করে রেখেছে। 

এই দিনের বেলাতেও এক ভয়ঙ্কর তর্জন গর্জন সেই বনের মধ্যে শোনা যেতে লাগলো। সুসীমার হৃদ- স্পন্দন শুরু হয়ে গেল, ভয়ানক রকমের স্পষ্ট সেই শব্দ, এবার আরও কাছে শোনা যেতে লাগলো সেই শব্দ। সুসীমা ত্রস্তপদে এগিয়ে চলল। পেছনের বিপদের সন্মুখে না পড়ে , অগ্রভাগের বিপদ চেখে নেওয়া ভালো। 

সুসীমা এগিয়ে চলল----

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments