জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( ষষ্ঠ বিংশ পর্ব)/ শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী- আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত ( ষষ্ঠ বিংশ পর্ব) 

শ্রীজিৎ জানা

শিলাইয়ের জল মিসমিস করে বাড়ছিল কদিন ধরে।  আকাশের টিপটিপানি থামার কোন লক্ষণ নেই। পশ্চিমে নদীর মুখে গদগদিয়ে বৃষ্টি হয়েছে।  জলাধার থেকে জল ছেড়েছে গতকালই। সেই জলের চাপ আসলে বিপদ একটা ঘটতে বাধ্য। নদী বাঁধের অবস্থা ভালো নয়। ইঁদুর ইগড়া আর শেয়াল গর্তে বাঁধের মাটিকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। বহুদিন নদীর বাঁধে মাটিও পড়ে নি। ভীমতলার ঘাটের কাছে ঘোগ পড়েছে। খাঁ পাড়ার কাছে বাঁধে জল ছাপাতে আর এক দু চাখর বাকি। সেদিকে কাঁসাইয়ের পেট ফুলে থাকায় কাঁকি হয়ে জল যাওয়ারও কোন উপায় নেই। তবে শিলাইয়ের জল বাড়া নিয়ে ঢোলের কোন মাথাব্যাথা নেই। উল্টে এতদিন বান বন্যা আসেনি বলে জগা কত যে খিস্তিখেউড় করেছে তার ইয়ত্তা নেই।
—- কালে কালে কত কি যে দেকতে হবে! পুরা ভাদ্দর মাস ফুরি গেল বান বন্যা নাই! বানের জল যেদি গায়ে না মাখলম,ভিটার গায়ে যেদি না শিলাইয়ের ছোল খেলল, থাইলে কিসের বেরসাকাল! খালে বিলে মাছ পাব কুথা থিকে বল দেথিনি!
পেত্তোবা মওকা পেয়ে জগার কথায় তাল দেয়।
— এগবারে ঠিক বলেচু মাইরি। বন্য না হলে মোটেই ভাল লাগেনি। তাবাদে মেকানের বন্যা এসতে দেরি হয়ঠে বলে মোকে কম খাটতে হল। সেই কালসাবা থিকে মাথায় করে পাটের বজা বইতে হইচে। পুরা স্যাঁকা হই গেছে মোর গতর। বানের জল থাকলে কেমন জলে ভাসিয়ে লি চলে এসতম।
 বন্যা না হলে,শিলাইয়ে জল না বাড়লে বোংশার মন খারাপ হয়ে যায়। কটাল পাড়ার বোংশা। তার মতো সাঁতারু ঢোলে দ্বিতীয় কেউ নাই। উজান স্রোতে তাদের ঘাট থেকে  গঙ্গাতলার ঘাটকে যেতে পারত। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসের দিনে ঘাটাল- নিমতলায় সাঁতার প্রতিযোগিতা হয়। কাতারে কাতারে লোক জমে শিলাইয়ের দুপাড়ে। নিমতলার ঘাট থেকে ভাসাপোল অব্দি সাঁতার প্রতিযোগিতা। নিমতলা গুঁই জমিদারদের এলাকা। নিমতলার রাস দেখতে কতবার গেছে বোংশা। গুঁই জমিদাররা তাদের মেয়েমানুষরা শিলাইয়ের জলে স্নান করবে বলে বড় বড় ঘাট বেঁধেছিল। বোংশা প্রথম যেবার সাঁতারে অংশ নেয়, সেবার সকাল থেকে চলে যায় নিবমতলায়। রাসমঞ্চ,পাকাঘাট,রসিকগঞ্জের ধূপ কারখানা সব ঘুরেঘুরে দেখে। ঘাটের চাতালে বসে মনে মনে ভাবতে থাকে, তাদের ঘরের কাছেও যদি এমন বাঁধানো ঘাট থাকত তাহলে পলিবালি ঘাঁটতে হত না মেইয়ামানুষদের। বোংশার সঙ্গে সেবার লোখা যায় নিমতলায়। লোখাকেই তার মনের কথা বলে বোংশা। পরে লোখা খগেন মাস্টারকে বলেছিল সেকথা। খগেন মাস্টার লোখাকে আরেক কথা শুনায়।
— একটা আশ্চর্যের কথা কি জানু লখি। মোদের শিলাই নিমতলা থিকে ঘাটাল পজ্জন্ত উত্তর মুখা। বইয়ের ভাষায় বলে উত্তর বাহিনী নদী। উমানাথ ঠাকুর বলে শাস্ত্রে আছে নাকি উত্তর বাহিনী নদী খুব পবিত্র হয়। সেইজন্নে জসিবদারা আরো জেদ করে এইসব ঘাট বেঁদেছিল। এখিনে লাইলে গঙ্গা চানের মতো পুন্ন হবে বইলু।
প্রথম বছর সাঁতার প্রতিযোগিতায নেমে কোন স্থান দখল করতে পারনি বোংশা। কিন্তু তার পরের বার থেকে যতবার গেছে একটা না একটা প্রাইজ এনেছে। বিযের পর আর শিরাইযে নামেনি সে। কিন্তু ভরা নদীর এপার ওপার করাটা তার কাছে জলভাত। ইদানীং বয়স হয়েছে তার। সেভাবে জলে আর হাঁপ ধরে রাখতে পারে না। তবে বন্যা মানেই বোংশার পোয়া বার। সারাদিন সে নদীঘাটে বসে থাকে। পাশে পড়ে থাকে ইয়াব্বড় কাছি। উপর থেকে গাছের ডাল,পাটের মাড় ভেসে আসা মানেই বোংশা ঝাঁপ মারবে নদীতে কোমরে থাকবে কাছির এক খুঁট আর এক খুঁট বাঁধা থাকব পাড়ের মোটা তেঁতুল গাছটায়। এবারে বন্যা আসতে দেরি দেখে সেও বিরক্ত হয় মনে মনে।

মাঝ রাত্রি তখন সাঁইসাঁই করছে। হঠাৎ ভীমতলার দিক থেকে চিৎকার ভেসে আসে। গোটা ঢোল হুড়মুড়িযে জেগে ওঠে। গতিক দেখে আগে থেকেই অনেকে আগাম ব্যবস্থা নিয়েই রেখেছিল। ঢোলের অর্ধেক ভিটাবাস্তই অনেক উঁচু। যাদের ভিটা ততটা উঁচু নয় তারা ভিটার উপরে মাচা বাঁধে। আর যাদের মাটের তলায় ঘর তারা আশেপাশের উঁচু ভিটায় ওঠে।পরে বাজারের স্কুলে চলে যায়। গরুবাছুর ছাগল ভেড়া পিচ রাস্তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে। বাজারের পিচ রাস্তার পুব দিকটা কখনো ডুবে না। যত জল ঢোলকে ডু্িয়ে আবার শিলাই হয়েই চলে যায়। কিছুটা জল কাঁসাই টেরনে নেয়। যদি তার পেট খালি থাকে তখন। 
শাঁখ বাজানো সব দিনের নিয়ম। বাঁধ ভাঙলেই পর পর শাঁখ বেজে উঠবে বাস্তু ভিটায়। কোটাল পাড়া থেকে সাঁতরা,দলবেরা, খাঁ,কারফার,দোলই,ছাতিক,কপাট,বড়দোলই,মাল হয়ে ভূঞ্যা সারা গ্রাম। সজাগ হয়ে ওঠে। তবে খুব একটা হুলুস্থুল ব্যাপার চোখে পড়বে না কোন বছরই। বেনোজল তাদের গা সওয়া। শিলাইয়ের পলি মেশা ঘোলাটে জল তাদের বড্ড প্রিয়। ভিটাবাস্তুর গায়ে বেনোজল যখন ঢেউ হয়ে আছাড় খায় তখন ঢোলের মন খলবল করে। জলযানেরা হেলেদুলে ওঠে। যুদ্ধক্ষেত্রে নামার আনন্দে টগবগিয়ে ওঠে। শুধু রাতের ভাঙনের জন্য একটু ফাঁপরে পড়ে যায়। বিকাল থেকে সবাই আশঙ্কা করেছিল ভীমতলার কাছেই হানা পড়বে। কোনরকম বন্যা রোধের ব্যাবস্থা নেয়নি। আসলে মন থেকের চায়না তারা। এখানে আর এক আত্মত্যাগের কাহিনী জুড়ে আছে। কেউ কোনদিন সেই ত্যাগের মহত্বকে বড় করে দেখেনি। বাগদি জাতে গ্রাম যে ঢোল। জাতটা তো আজন্ম লোকের খিদমতগার করেই গেল। জাতকে ছোট বলে নিজেদের বড় প্রতিপন্ন করা মানুষরা তাদের বড় মনটাকে বড় করে দেখাতে চায় না কখনো। চাইলে যে নিজেদের আড়াল করে রাখা কদর্য মনটা বাইরে বেরিয়ে পড়বে। 
ঢোলের পূর্বে দাসপুরের একাশি মৌজা। যার দুইদিকে কাঁসাই শিলাইয়ের জলবেষ্টনি।শিলাইয়ের বাঁধে জলচাপে যদি কোথাও না হানা পড়ে তবে একাশি মৌজার কপালে দুর্ভোগের শেষ থাকবে না। একনকি শিলাই আর আর কাঁসাইকে এক করে দেওয়া কাঁকি খাল এই জলোচ্ছ্বাসে দ্বিগুন ফুলে ফেঁপে ওঠে। কাঁকি খাল আবার খাল নয়। আদর করে তাকে ডাকে সবাই কঙ্কাবতী বলে। বরদা পরগনার রাজা ছিলেন শোভা সিংহ। কেউ বলেন তিনি নাকি বাগদিরাজা। কেউ বলে তিনি বাগদি প্রজার রাজা। সেইনিয়ে বিতর্ক তোলা থাকুক অন্যত্র। ইতিহাসকারগণ বলেন স্বাধীন চেতুয়া বরদা রাজ্যের রাজধানী ছিল রাজনগর। রাজনগর নামটির সাথে জুড়ে আছে চেতুয়া নামটি। চেতুয়া নামটি আরেক ইতিহাস বহন করে। মুসলমান রাজত্বকালে চাকলা বর্ধমানের অধীন সরকার মান্দারনের অন্তর্গত ছিল চেতুয়া পরগনা।বগড়ি রাজবংশের পঞ্চম আচরাজ চিত্র সিংহের সেনাপতি ছিলেন দলেশ সিংহ। বরদারাজকে পরাস্ত করে তিনি নিজ প্রভু চিত্র সিংহের স্মরণে অধিকৃত এলাকার নাম রাখলেন চেতুয়া। সেই থেকে চেতুয়া রাজনগর। অনুমান করা হয় বরদা রাজ্যের রাজা রঘুনাথ সিংহ রাজনগরে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। রঘুনাথ সিংহের পুত্র ছিলেন কানাই সিংহ। দুর্জ্জয় সিংহ হলেন রঘুনাথ সিংহের পৌত্র। এই দুর্জ্জয় সিংহের পুত্র শোভা সিংহ ছিলেন বরদা রাজ্যের বিখ্যাত রাজা। যিনি সেইসময়  দিল্লীর বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। শোভা সিংহ তার রাজধানী রক্ষার জন্য বাগদীদের এনে বসালেন রাজনগর গ্রামে অধুনা ঢোলে। ঢোলের বাগদিরা হল রাজার লেঠেল,পাইক,বরকন্দাজ। এমনকি রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সুগম করতেই শোভা সিংহ কাঁসাই থেকে খাল কেটে শিলাইয়ের সঙ্গে যোগ করে দিলেন। কাটাই থেকে কাঁসাই, পরে কাঁকি হয়েছে। এই কাঁকির তীরেই রাজধানী রাজার নগর রাজনগর। একটু দূরেই রাজার গড় আনন্দগড়। কাঁকি  নদীর তীরের রাজনগর সেইকালে একটি উল্লেখযোগ্য জনপদ রূপে খ্যাতি লাভ করে। আজ সেই রাজধানীর কোন চিহ্ন নেই। কালের অতলে তলিয়ে গেছে সেদিনকার ইতিহাস।  অনতিদূরেরও গড়ের কোন চিহ্ন নেই। শুধুমাত্র ইতিবহাসের পাতায় আর লোকশ্রুতিতে বেঁচে আছে শোভা সিংের রাজধানীর কথা। আর বেঁচে কঙ্কাবতী নদীর বয়ে চলা স্রোতের ভিতর বাগদীরাজার পদধ্বনি। তবে কাঁসাই তীরের রাজধানীতে  সেই সময় বানিজ্য যে রমরমা চলত তার একটু আভাস মিলবে নদী তীরের জনবসিতর মধ্যে। আজও কঙ্কাবতীর তীরে কামার কুমোর তাঁতি,গোয়ালা জেলে জাতির বসবাস চোখে পড়ার মতো।
নিজের গ্রাম ভেসে গেলেও চিন্তা নেই। ছেলেপুলে নিয়ে কোথায় মাথা গুঁজবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। অথচ কাঁকি খালের পাহারা দিতে ছুটে আসে ঢোলের বাগদিরাই। কেউ কেউ হয়তো নিছক শাসানির স্বরে নিজেদের মধ্যেই বলে উঠে,
— কেনে সব বচ্ছর মোদের দিকে ডুবতে হবে বল দিখি! চ দিখি,রাতে অদের উপারে একটা হানা দি দেই। মোরু শালা গুলান ডুবে। মাগ ছেনা লিয়ে একটু হাবুডুবু খাউ অরা। তবে বুজতে পারবে বানবন্যায কি কষ্ট!
— তা যা বলেচু। মোদেরকে ডুবতে হবে জলে আর অরা থাকবে সিঙার ডাঙায়। নেতাফেতারা অদের বাঁদ বাঁচানার জন্নে ত এগবারে এলি পড়বে। মোেদের বেলায় লড়ে ডুম পড়েনি।
—- ভোটের বেলায় তখন চ ঢোলবাহিনী লড়াই কত্তে আর বানবন্যার সময় মর শালারা ডুবে।
—- অরা যে চেতার লোক। বাবু লোক। অফিস আদালত আছে নি। মোদের ডুবে মল্লেও খতি নাই। অরা মল্লেই নেতাদের বুকে চড়চড়ানি শুরু হইযাবে।
—- তার উবরে বন্যার সময় যেদি অদের পার থিকে কিছু এনে ফেলু দেকবি কেমন ঝাঁজ। 
—- ঠিক বলেচু মাইরি। উ বছরে একটা ভেলার জন্নে অদের পারকে বিচাকলার গাছ কাটতে গেইলম,মোকে এই মারে কি সেই মারে। মোর হাতেও কাঠারি ছিল। গায়ে হাতটা যেদি দিত অদের একটা না একটার বাজু ধাসি দিতস।
—- তবে যাই বলে দোষ মোদেরই। মোদের চোখ খুলবেনি কুনুদিন। নেতাছাতাদের পুষা কুত্তা হয়েই মোদের থাকা স্বভাব হই হেছে। আতু বলে ডাকলেই চলে যাই ত সব।
🍂

ভোরের আলো ফুটতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বন্যার বহর। গোটা ঢোল শিলাইয়ের ঘোলা জলের তলায়। কালসাবার মাঠে জল থইথই করছে। ভিটাবাস্তুর গা ঘেঁষে বয়ে যাচ্ছে স্রোত। সবার কাছে গতিক ভালো ঠেকছে না এবারের জল দেখে। লোখা তার জোড়াডোঙা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অত ভোরেই। ডোঙা বেয়ে হাজির হয় ভগীখুড়াদের পাড়ায়। ভিটার গায়ে বাবলা গাছে ডোঙাটা বেঁধে ভগীরথ খুড়ার উঠানে গিয়ে হাঁক দেয়,
— কি গ খুড়া উঠেছ। আমি লোখা এসচি।
— অনেকখন উঠেচি। গৈলের গরু গুলানকে দেকতে গেইলম। অবলা জন্তু অদের কি করে ৰিযাব কুথা বল দিখি! তাবাদে বল দিখি তুই এই বানবন্যায বেরিচু কেনে।
— বলিঠি কি জল দেখে বি বুজঠ। গকিক ভাল নয় বল খুড়া
—- সেই পঁচাশির অত বড় বন্যায়ও জল একদিনে এত বাড়েনি। আমিও ভয় পাইঠি ছেনাপেনা লিয়ে, তোর খুড়িবকে লিয়ে অবলা জন্তু গুলানকে ফেলি রেখে কুথাকে যাব! তবে তোদের যা খাড়াই ভিটা হতাকে জল উঠবেনি। যেদি উঠে থাইলে ঢোলের কাদেরও ঘরদর থাকবেনি
— মোদের ভিটকে পালি চল। গরুগুলান থাউ এখিনে। মাজেসাজে এসে খেতে দি'যাবে খন।
—- দেখি আর দুফুর পজ্জন্ত।
লোখার বাপের হাতে তৈরী ডোঙা। প্রথমে ছিল একুটা ডোঙা। পরে জোড়া ডোঙা করে। বন্যার সময় লোখাই ডোঙা চালায় বেশি। লগি ঠেলে লোখা এবার সোজা পিয়নের বাস্তর গায়ে ডোঙা বাঁধে। সুবল পিয়নের উঠানে তখন জল লেগে গেছে। লোখা দেখেই সুবল ছুটে আসে।
—- এত সকালে তোখে পেই যাব বলে ভাবতেই পারি নি।  মোদের ভিটাটা ত অত উঁচুি নয়। দেখুঠু ত জল লেগে গেছে। ঘরে জড়া মেইছেনা। কখন কি ঘটবে। তোদের ভিটাকে অদের মা ঝিবকে লিয়ে যা না। আমি তার পরে দেখিঠি বেলা বাড়লে কি করা যায়। নিশ্চই সরকারি লৌকা দিবে। তখন অদের কে লিয়ে বাজরের স্কুলে রেখে এসব। তেমন হলে অকে পাঠি দুব শ্বশুর ঘর। 
লোখার এদিকে আসার কারন আসলে মাধু। সাদাসিধে মন লোখার। মাধুকে গর্ভবতী অবস্থায় দেখার পর থেকে রাগটা অনেকটাই ম্রিয়মান হয়ে গেছে। এই বন্যায় যাতে না কোন বিপদ হয় সেই কারনেই তার আগমা। কোন কথা না বাড়িয়ে বলে,
— থাইলে চলে এস। দু একটা জিনিস লি'লাউ। তবে একজনের বেশি ত চাপবেনি। চিন্তা নাই আমি দুখেপ দি দুব। আগে কে যাবে এষ।
— মাধু তুই আগে যা। 
সুবল পিয়নকে মেয়ের জন্য উদ্বিগ্ন দেখায়। পিয়নের বউয়ের মুখেও সামান্য চিন্তার আভাস চোখে পড়ে। ধীর পায়ে মাধু উঠে পড়ে ডোঙায়। লোখা বলে,
— ভয় করিসিনি। চুপ মেরে বোস। এখুনি মোদের ভিটাবে চলে যাব। লোড়বিনি। তবে জড়াডঙা আছে কিছু হবে নি।
মাধু কোন উত্তর করে না। চুপ করে বসে থাকে ডোঙার হাঁড়ার দিকে। লোখা লগি ঠেলে ডোঙা বাইতে থাকে। ভিটার বাঁক ঘুরেই মুখ খুলে মাধু,
—- উ কেমন আছে,জানু?
—- কার কথা জানতে চাউঠু, বল?
—-- তরা সবাই মোকে খুব খারাব ভাবু, জানি। ভাবারই কথা। আমি অর সঙে যেরকম বেবহার করেচি,মোকে ভগমানও কুনু দিন খমা কোরবেনি!
—- কেনে কল্লি থাইলে, বল? তোকে ত সেই ছেনেটা মনপান দিয়ে ভালবাসত। তোর ত কুনুদিন খতি চাইনি। থাইলে তাকে কেনে তুই ওরকম করে গটা গেরামের সামনে ছোট কল্লি। অদের পরিবারটাকে ছোট কল্লি। এখনো ওব্দি ছেনাটা গেরামে মুখ তুলে তাকাতে পারেনি কারো সামনে। গেরামকে ভাল এসতেও চায়নি।অথচ তুই ত জানু উ গেরামকে কত ভালবাসে।
মাধুর দু'চোখ দিয়ে তখন শ্রাবনের অঝোর বারিধারা। ধারা পাতের কঁকিয়ে ওঠা শব্দে লোখা অপ্রস্তু হয়ে পড়ে। মাধু গর্ভবতী। বন্যার জলস্রোতের উপর ছোট্ট ডোঙায় পরম ভরসায় নিশ্চিন্তে তুলে দিয়েছে তার মা- বাপ। যদি এখুনি কিছু হয় তবে লোখা নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না কোন দিন। মুখ দেখাতে পারবে না কারু কাছে। লোখা নিজেকে সংযত করে। স্বান্তনার স্বরে বলে,
—কেনে কাঁদুঠু মাধু! তোকে হয়তো এসব বলা এখন মোর ঠিক হয়নি। আসলে ছেনাটার সেদিন গুলানের কথা মনে পড়লে খুম কষ্ট হয় রে। মাঝে মাঝে মোকে বোলত,উ কেনে মোকে ভালবাসেনি,যেদি এগবার বলে যেত,থাইলে মোর কুনু কষ্ট থাকত নি। সেই জন্নেই তোকে আজগে একা পেয়ে….।
আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে মাধু বলে,
—-ঠিক বলেছে জানু।অকে বোলতে পারিনি কেনে সেদিন মুখ ফিরি লিইছিলম। উ পড়াশুনায় কত্ত ভাল ত জানু। চাইতম উ পড়াশুনা করে বোড়ো হউ। তাবাদে মোর মাকে দেখে ইসব ভাল লাগেনি। মোর বাপটা সাদাসিদা লোক সবদিন। ছোটবেলা থিকে দেখতম বঙ্কা কাকার সঙে মায়ের মিলামিশা। একদিন বাবো ঘরে না থাকা অবস্থায় বঙ্কা কাকার সঙে মাকে ঘরের ভিতরে নংরা ভাবে দেখে ফেলি। সেই লোজ্জার কথা কাউকে বোলতে পারিনি।
লোখা হাঁ করে মাধুর মুখের দিকে চেয়ে থাকে। লগি ঠেলার গতি অজান্তেই কখন তার মন্থর হয়ে গেছে। ওইটুকু বলে মাধুকে চুপ করে যেতে দেখে লোখা বলে,
—সুদু এই জন্নে তুই অকে ছেড়ে দিউলু?
—- না রে! আমি দেখেছিলম বলে মা জানতে পেরে যায়। একদিন রাতের বেলা মোকে ঘরে লিয়ে জিয়ে শাসায়।বলে যেদি কাকেউ কিছু বোলু,আর মোর কথামত না চলু তবে তোর বাপের ভাতে বিষ মিশিয়ে মেরে দুব। সেই ভয়ে…। একে মা মরা মেইছেনা। তার উবরে বাপটাও যেদি চলে যায় মোর জন্নে। লোকে আগে বোলত মা খাকি। তারপরে বোলবে বাপ খাকি। বাপকে ছেড়ে অই মায়ের কাছে আমি থাকতে পত্তম নি রে।
—--তুই আগে ইসব কেনে বোলুনু মোকে। তোর মা আর ওই বঙ্কা সাঁতের নাম লুকি দিতম এগবারে। 
—- মেইছেনাদের কষ্টের কথা কেউ বুজেনি রে জানু ত। তারা ত সব কথা মুখ ফুটে বোলতে পারেনি,সেইজন্নে সবদিন তারাই সব দোষের ভাগিদার হয়। অর কাছে চিরকাল মাধু অপরাধীই থাকবে। উ বোড়ো হউ। খুব বড় চাগরি পাউ এই পাত্থনা করি ভগমানের কাছে।
—- তুই আগের মত আর নাউ রে । কত বুজদার হোই গেছু। আমরা তোখে সুদুমুদু ভুল বুজচি রে। তুই ভাল থাকবি, জানু। অকে ঠিক সময় বুজে সব বোলবো একদিন। চল,তাড়াতাড়ি তোখে ভিটায় তুলে দিই।
বলেই লোখা দ্রুত লগি ঠেলতে থাকে। তাদের ভিটার পিছন দিকে অর্জুন আর তাল গাছের মাঝখানে ডোঙাটাকে ধীরে থামায়। লগিটাকে সোজা দাঁড় করিয়ে ডোঙার গা ঘেঁষে মাটিতে পুঁতে দেয়।যাতে ডোঙাটা সরে না যায়। আর হাত দিয়ে অর্জুন গাছের ঝুঁকে পড়া ডালটা শক্ত করে ধরে বলে,
— এইবার নাম রে তুই। সাবধানে নাম। পা টিপে টিপে নামবি। ভিটায় উঠ। তোকে ঘরে দিয়ে এসে তারপর তোর মাকে আনতে যাব। মাধু ডোঙা থেকে ধীর পায়ে নামে। ভিটায় নেমে ডোঙার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
— তোর সঙে ইসব লিয়ে আর হয়তো কুনুদিন কথা হবে নি।অকে বুজিয়ে বোলবি,জানু। খমা না করে কোরু কিছু মনে কোরবোনি। তুই ত কিত্তন গান কত্তে যাউ শুনেচি। রাধার সঙে কিষ্ণের ত কুনু দিন বিয়া হয়নি। দূরে থেকেও ত তারা দুজন দুজনে ভালবেসেচে। সেটাই ত আসল ভালবাসা,তুই কি বোলু? ভালবাসা মানে কি দুজনকে কাছেই থাকতে হবে! তরা ত মোর চেয়ে বেশি জানবি। অকে বোলবি তার মত ত পড়াশুনা কোরিনি। তবে মাধু জীবনে এইটাই বুজেচে।
লোখার মুখ দিয়ে কোন কথা সরে না। বিস্মিত হয়ে ভাবে,এই কী সেই মাধু!

Post a Comment

0 Comments