জ্বলদর্চি

ঘট ওলানো /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৯০
ঘট ওলানো

ভাস্করব্রত পতি

'ঘট' হল আবাহিত দেবতার অধিষ্ঠানভূত মৃত্তিকাদির কলস। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে পাই, 'আমা সনে করি হঠ, চরণে লঙ্ঘিল ঘট'। কাশীবিলাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'দুর্গাপঞ্চরাত্রি'তে আছে, 'ঘট জন্যে স্বর্ণঘট নিল'! 

'ওলা' (√উলা> √ওলা) অর্থে অবতীর্ণ করানো, অবরোহন করানো বা নামানো বোঝায়। 
ওলাহ / ওলাহা -- নামাও
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আছে, 'ওলাহা রাধা, মাথার চুপড়ী'। শ্রীকৃষ্ণমঙ্গলতে আছে, 'দুগ্ধ ওলাইয়া, যশোদা আসিয়া পুত্রকর্ম্ম দেখি হাসে'। এখানেই আছে, 'গাছ হতে অগ্রে আনি ওলাইয়া কর্পূরে'। বিষ অধঃপ্রবাহিত করা বা ক্ষত মুখে আনাকেও বলা হয় 'ওলান' বা 'নামান'। আমাদের আলোচিত লৌকিক উৎসব হল 'ঘট অলানো' বা 'ঘট ওলানো'। 

গ্রাম বাংলার শীতলা পূজার সাথে সম্পৃক্ত একটি অন্যতম লৌকিক উৎসব হল 'ঘট ওলানো'। এটি এক ধরনের লৌকিক উৎসবই বলা চলে। একসময় শীতলা পূজার সময় কোনও চাঁদা তোলা হতনা। তখন এখনকার মতো এটি সার্বজনীন ছিল না। সেসময় শীতলা পূজার খরচ তোলার জন্য গ্রামগুলিতে গৃহস্থের বাড়িতে গিয়ে দান, সাহায্য আদায় করা হত চেয়ে চিন্তে। কিন্তু এই চাওয়ার মধ্যে ছিল এক ভিন্ন ধরনের লৌকিকতা। যে রীতিতে গ্রামীণ মহিলারা সেসময় শীতলা পূজার আয়োজন করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজটি করতেন, সেটাই "ঘট ওলানো"! কামিনী কুমার রায় লিখেছেন, "পশ্চিমবঙ্গের বহু অঞ্চলে বারোয়ারি শীতলাপূজা উপলক্ষে মেয়েরা কুলার উপর শীতলার ঘট স্থাপন করিয়া বাড়ি বাড়ি যায় এবং গোবরজলে নিকানো উঠানে ঘট কুলা নামাইয়া হাততালি দিতে দিতে উহার চারিদিকে ঘুরে। গৃহকর্ত্রী তখন চাল পয়সা, ফলমূল মাগন দিয়া তাহাদিগকে বিদায় করেন। এই প্রথার নাম ঘট ওলানো"। 
এর উপচার একটু অন্যরকম। পূজার আগের দিন গ্রামের এয়োস্ত্রীরা একটি নতুন কেনা কুলোর ওপর একটি জলভরা ঘটি স্থাপন করে বাড়ি বাড়ি মাগন করতে বেরোয়। প্রতিটি গেরস্থের বাড়িতে তাঁরা যায় এই কুলো সহ ঘট নিয়ে। আর এই মাগন দেওয়ার জন্য প্রতিটি পরিবার উন্মুখ হয়ে থাকে। তাঁরা তাঁদের বাড়ির ছামুদুয়ার গোবর গোলা জল দিয়ে ভালো করে নিকিয়ে রাখে। একটা পবিত্রতা বিরাজ করে সর্বত্র। যখন এয়োস্ত্রীরা বাড়ি বাড়ি মাগনে যায় তখন তাঁরা তাঁদের হাতের কুলো ঐ নিকোনো স্থানে রাখে। এরপর ঐ কুলোকে ঘিরে হাততালি দিতে দিতে ঘুরতে থাকে। কামিনী কুমার রায় জানিয়েছেন, "পূর্বে এই উপলক্ষে গীত ও নৃত্য হইত, বর্তমানে এই প্রথা প্রায় উঠিয়া গিয়াছে"। যাইহোক, পুরো প্রথাটিই প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আর নৃত্য গীতাদিও বহুকাল আগেই বন্ধ। যেহেতু এয়োস্ত্রীরা এইভাবে কুলো নামিয়ে শীতলার জন্য মাগন করে থাকে, তাই এই লৌকিক উপচার ও উৎসবের নাম 'কুলো নামানো'। মেদিনীপুরের গবেষক চিন্ময় দাশ এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, "মেদিনীপুর জেলার পূর্ব এবং দক্ষিণ অংশে 'নামানো' এই ক্রিয়াপদে সমার্থক হিসেবে 'অলানো' শব্দের ব্যাপক ব্যবহার আছে"। 

এই কুলা সহ শীতলার ঘট অত্যন্ত শ্রদ্ধার এবং সমীহ করবার উৎসব। হয়তো কোনও ক্ষেত্রে শীতলার মূর্তি স্থাপন করে পূজা করা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটস্থাপন করে বাড়ি বাড়ি যাওয়ার মাধ্যমেই পূজা হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, শীতলার কিন্তু বিসর্জন হয়না। তাই মূর্তি গড়া হলেও তা জলে বিসর্জন দেওয়ার প্রথা নেই। তাই অনেকে গাছতলায় রেখে আসে। শীতলার যে চার ধরনের মূর্তি দেবীজ্ঞানে পূজিত হয় সেগুলি হল ঘট, পাথরের মূর্তি, ধাতুর মুণ্ড মূর্তি এবং মৃত্তিকা মূর্তি। এগুলির মধ্যে ঘটস্থাপন করে পূজা করা সবচেয়ে সহজ এবং কম ব্যয়সাপেক্ষ। তাই একসময় যখন সর্বজনীন পূজার প্রচলন তেমন একটা হয়নি, তখন এই 'ঘট ওলানো'র মাধ্যমেই বিভিন্ন অঞ্চলে শীতলার পূজা করা হত। যা এখন আর দেখা যায়না বললেই চলে।
🍂


Post a Comment

0 Comments