পর্ব ৯১
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
স্বামীজীর বেদান্ত প্রচার ও গুডউইন
স্বামীজী একথা ঘোষণা করেছিলেন, বুদ্ধের বাণী যেমন প্রাচ্যের জন্য, তাঁর বাণী তেমনই পাশ্চাত্যের জন্য। আর সেই বাণীর যথার্থ ধারক ছিলেন গুডউইন। বোস্টনে স্বামীজীর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর বন্ধু হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন রাইটের। এঁরা সহায়তাতেই শিকাগোতে ধর্মমহাসভার প্রতিনিধি হতে পেরেছিলেন। ১৮৯৬ সালের মার্চ মাসে অধ্যাপক রাইট স্ত্রীকে একটি পত্রে লিখছেন ---'... ( স্বামীজী ) বক্তৃতায় অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছেন। একজন তরুণ শ্রুতিলিপিকার ( গুডউইন ) তাঁর ধর্মোপদেশের প্রেমে পড়েছে। জড়বাদী থেকে রূপান্তরিত হয়েছে বৈদান্তিকে ও ভালবেসে তাঁর কথা লিখে রাখছে, তাঁর অনুগমন করছে শহর থেকে শহরে।’
বস্তুতপক্ষে পাশ্চাত্যে স্বামীজীর ধর্মপ্রচারের কাজ সর্বাধিক সাফল্যের মুখ দেখেছিল ১৮৯৬ সালে। কেননা এই বছর এক পত্রে গুরুভ্রাতা স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে লিখছেন, ‘এ বছর যে কাজ হতে চলেছে তার কথা শুনলে তুমি স্তম্ভিত হয়ে যাবে।’ এই বছরের মার্চ মাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দিলেন স্বামীজী বোস্টনে। হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট ফিলজফিকাল ক্লাবে। এই বিষয়ে বিশিষ্ট মার্কিন গবেষক ও লেখক মেরি লুই বার্ক জানিয়েছেন --‘এই সমিতিতে বক্তৃতা করার জন্য আমন্ত্রিত হওয়ার অর্থ আমেরিকান বুদ্ধিজীবী সমাজের সর্বোচ্চ সম্মান লাভ করা...।’ এই বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন উপস্থিত সকলেই। ‘বেদান্ত দর্শন’ বিষয়ক বক্তৃতাটি শ্রুতিলিপির মাধ্যমে টুকে টাইপ করেছিলেন গুডউইন, যা পরবর্তীকালে পুস্তিকাকারে ছাপা হয়।
গুডউইন অত্যন্ত গুছিয়ে সব কাজ সম্পন্ন করতে পারতেন। এই বিষয়ে পাওয়া একটি বর্ণনা এইরকম -- “গুডউইন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গুছিয়ে সব কাজ করতে পারতেন। তাঁর এই গুণপনার প্রশংসায় স্বামীজী ছিলেন পঞ্চমুখ। গুডউইনের মতামতকেই তিনি খুব মূল্য দিতেন -- রাজনীতির ব্যাপারে না হলেও পাশ্চাত্যে বেদান্ত আন্দোলনের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। স্বামীজীর কথা বলতে গিয়ে মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বেদান্ত প্রচার যে আমেরিকায় স্থায়ী হইবে, এই কথা গুডউইনের মুখ হইতে শুনিয়া স্বামীজী বেশ একটু উৎসাহিত ও আনন্দিত হইলেন।’ বহুবার এমনও হয়েছে, বক্তৃতা শেষ করার পর স্বামীজী বুঝে উঠতে পারেননি তাঁর বক্তৃতা ভাল হয়েছে কি হয়নি। বক্তৃতা দেবার সময় তিনি চেতনার এক তুরীয় অবস্থায় উপনীত হতেন, তাই বক্তৃতা শেষ করার পর তিনি মনেই করতে পারতেন না কি বলছেন অথবা শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়াই বা কি হয়েছে।
🍂
মহেন্দ্রনাথ দত্তর লেখা ‘স্বামী বিবেকানন্দের ক্ষিপ্রলিপিকার জে জে গুডউইন’ পুস্তিকা থেকে জানতে পারছি, এসব ক্ষেত্রে গুডউইন এগিয়ে আসতেন স্বামীজীকে আশ্বস্ত করতে। সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, ‘স্বামীজী! আজ আপনি বড় সুন্দর কথা বলেছেন।’ বালকের মতো তিনি তখন জিজ্ঞাসা করিতেন কি কথা? গুডউইন তখন তাঁহাকে সেইদিনের লেকচারে যাহা বলা হইয়াছিল, তাহা বর্ণনা করিতেন। তিনি অবাক হইয়া বলিতেন --‘এর মানে কি?’ অর্থটা বুঝাইয়া দিলে গুডউইনকে তিনি বলিতেন --‘এসব লিখে রেখে দাও। আমার বেশ লাগছে।” ( আমার গুডউইন, প্রব্রাজিকা ব্রজপ্রাণা, উদ্বোধন কার্যালয়)
প্রকৃতপক্ষে লণ্ডনে থাকাকালীন গুডউইন একাধারে হয়ে উঠেছিলেন স্বামীজীর শ্রুতিলিপিকার ও ডানহাত। স্বামীজী একথা বলেইছিলেন যে --‘গুডউইন আমার ঢের কাজ করে, ও না থাকলে আমার বড় অসুবিধা হয়।’ বিবেকানন্দ অনুজ মহেন্দ্রনাথ দত্ত এই বিষয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করছেন -- “একদিন খেতে বসে স্বামী বিবেকানন্দ গুডউইনকে বললেন, ‘গুডউইন, ডায়েরিটা দেখ তো আজ কোন এনগেজমেন্ট আছে কিনা?’ গুডউইন তাড়াতাড়ি করে ডায়েরিটা খুলে দেখলেন যে, ঠিক সেই সময় পার্ক লেনে এক ডিউকের বাড়িতে নিমন্ত্রণ। নির্ধারিত সময়ের আর মিনিট দশেক বাকি আছে, একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সেই অল্প সময়ের মধ্যে কাপড়, জুতো বদলাতে হবে, গাড়ি ডাকতে হবে। গুডউইন লাট্টুর মতো ঘুরপাক খেতে খেতে একে একে স্বামীজীর জুতোর ফিতে বেঁধে দিলেন, মাথার টুপি, ছড়ি এনে দিলেন, তারপর গাড়ি ডেকে দিতে স্বামীজী নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে রওনা হলেন।” ( লণ্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ, প্রথম খণ্ড, মহেন্দ্রনাথ দত্ত, মহেন্দ্র পাবলিশিং হাউস ) এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন যে, ১৮৯৬ সালের মে মাসে স্বামীজী লণ্ডনে মার্গেসন-এর বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এই বাড়িতেই একই সঙ্গে ছিলেন স্বামী সারদানন্দ, বিবেকানন্দ অনুজ মহেন্দ্রনাথ দত্ত ( আইন পড়তে তিনি লণ্ডনে গিয়েছিলেন এপ্রিল মাসে ), মিস হেনরিয়েটা এবং গুডউইন। সেন্ট জর্জেস রোডের উপর অবস্থিত ছিল এই বাড়িটি। এই ভবনের একেবারে উপর তলায় অর্থাৎ পাঁচতলার চিলেকোঠায় গুডউইন থাকতেন। তাঁর ঘরের চালটাই ছিল বাড়ির ছাদ। শুধুমাত্র ঘরের মাঝখানে গুডউইন ঠিকঠাক সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন। এসব নিয়ে তাঁর অবশ্য তেমন কোনও অসুবিধা বোধ ছিল না। স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গলাভ তাঁকে উচ্চতর বোধের জগতে উত্তীর্ণ করেছিল। বস্তুতপক্ষে বিবেকানন্দ ছিলেন তাঁর ঈশ্বর, যথার্থ ঈশ্বর! সেই ঈশ্বরকে এত কাছাকাছি ঘনিষ্ঠভাবে দেখাশোনার অসীম সৌভাগ্য বহন করেছিলেন গুডউইন। আর ভবিষ্যত বিশ্বের সামনে উপহারস্বরূপ হাজির করেছিলেন বিবেকানন্দের সেইসব বৈদ্যুতিক বাণী -- যা সহস্র বৎসর যাবৎ বহমান থাকবে।
0 Comments