শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২৩
সালেহা খাতুন
চিরকাল আবেগের দ্বারাই চালিত হচ্ছি। মস্তিষ্কের কাছে হৃদয় মাথা নোয়াবে না কিছুতেই। তবুও বাস্তবকে মানতেই হয়। নির্বাচিত কলামের উত্তেজনা কেটে গেল ‘লজ্জা’ পড়ে। আমি তো সাহিত্যের ভক্ত। সাহিত্যগুণ যথার্থ ভাবে না থাকলে সে বই যত আকর্ষণীয়ই হোক পড়তে ইচ্ছা করে না। কাজের জন্য, জানার জন্য, খবরাখবর রাখার জন্য, গবেষণার জন্য হয়তো পড়ি কিন্তু মন টানে না।
মনকে টেনে রাখা আচ্ছন্ন করে রাখার মতো বই একটা সেসময় পড়েছিলাম। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘সত্যাসত্য’। ছটি খণ্ডে লেখা বই। বইটি পড়ে বিস্ময় ও আনন্দে ভরে যায় আমার মন। এমন অভাবনীয় ভাবের আখ্যানও রচিত হয়েছে! চরিত্রগুলির সঙ্গে একাত্ম হয়ে মনে হতো যদি সুধী হতাম, আঃ যদি বাদল হতাম, নানা যদি উজ্জয়িনী হতাম—সবকটা চরিত্রই আকর্ষণীয়। বাদলকে প্রথম প্রথম গ্রহণ করতে পারিনি আর সবটা পড়ে বাদলই প্রিয় হয়ে উঠল আমার কাছে। এই বইটা পড়ে পনেরো দিন আমি বাড়ির বাইরে যাইনি। অজ্ঞাতবাস অংশ পড়ে বাইরের জগত থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখি।
জগত বড়ো জটিল জায়গা। ভালোর কথাই বলে চলেছি। জীবনের উনিশটা বসন্ত,উনিশটা শরৎ,উনিশটা বছর ধরে মন্দ কি কিছুই দেখিনি? তাহলে মন কেন দূরে বহুদূরে চলে যেতে চাইতো? হ্যাঁ দেখেছি সংসারী মানুষের দীর্ঘশ্বাস, বাবা-মার কলহ, শিশুর নিরাপত্তাহীনতা, ভায়ে ভায়ে দ্বন্দ্ব,বধূহত্যা, অর্থের জন্য প্রিয়জনকে হত্যা,পুত্র কর্তৃক বিতাড়িত নিরাশ্রয় বৃদ্ধ, পুত্রবধূর নিপীড়নে শাশুড়ির ক্রন্দন, অবিবাহিত বোনের অনাদর, শাসন না মানা বেয়াদব পুত্র। পালাবার পথ নেই। সমাজ বদলাবার জন্য বিপ্লব করার শক্তি নেই। তাই অপটু হাতে শব্দ সাজানোর চেষ্টা করতাম। মনের ভার কিছুটা হলেও কমতো---
দূরে দূরে আরও বহুদূরে
মন তুমি যাও সেই অজানা তীরে
যেথায় এমন বীভৎসতা নেই কারো শিরে।
শান্ত স্নিগ্ধ মধুর পরিবেশ করো সৃজন
সেথায় থাকবো সবে হয়ে আপনজন।
আপনজনও পর হয়ে যায়। এই বিরানব্বইয়ের ডিসেম্বরেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়। সত্যিই বিচিত্র এ মানব সম্প্রদায়। যেখানে দুবেলা দুমুঠো আহারের চিন্তায় দেশের বেশিরভাগ মানুষ কৃশ সেখানে ধর্ম নিয়ে কেন এতো মাতামাতি? আশ্চর্য মন্দির মসজিদ নিয়ে কেন এতো মারামারি-কাটাকাটি-হানাহানি? মানুষ কেন এতো সংকীর্ণ মনোভাবাপন্ন? মানুষ যতো আধুনিক হচ্ছে তাদের আদিম প্রবৃত্তি হিংসা যেন বেড়েই চলেছে। তারা কি উদার হতে পারে না? সে সময় মসজিদ ভাঙা নিয়ে কতো কিছু ঘটেছিল - বাংলা বনধ, ভারত বনধ । খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল। কালোবাজারিদের হাত মজবুত হয়ে গিয়েছিল। এখানে ওখানে কার্ফু জারি হয়েছিল। দূর গ্রামে থেকেও মানুষের উৎকণ্ঠা উদ্বিগ্নতা দেখেছি।
🍂
উনিশশো বিরানব্বইয়ের দশ ডিসেম্বর ডায়েরিতে লিখেছিলাম – অপেক্ষায় আছি কবে আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটছে। এখনকার সভ্যতা কি রক্তের নেশায় আসক্ত হয়েছে? মানুষ ভুলে গেছে তার আসল পরিচয় যে সে একজন মানুষ। এখন তাদের পরিচয় – কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান। মানুষের এতোদিনের সম্পর্ক কোথায় গেল? মসজিদ মসজিদ করে বিপুল জনতার এতো যে শোক – বেশিরভাগ মুসলমান তো নামাজই পড়ে না। মানুষ এখন বড্ড বেশি সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেছে। স্বয়ং রামচন্দ্রও নিশ্চয়ই এধরনের ঘটনার সমর্থন করতেন না। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ। সেই আদর্শকে নিয়ে কেন এতো বিভেদ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা? আশ্চর্যান্বিত হতে হয়। এই দাঙ্গাতে মনে হয় ঈশ্বর তাঁর আসন মন্দির-মসজিদ থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। ঈশ্বর মনে হয় তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের উদ্দেশ্য হাঁক দিয়েছেন –
তোল রে তোল
আসন মম হেথা হতে তোল
হেথায় সব মানুষগুলির
মাথার বিষম গণ্ডগোল।
(ক্রমশ)
0 Comments