দূরদেশের লোক গল্প—লাওস (এশিয়া)
বউয়ের জন্য উপহার
চিন্ময় দাশ
ছোট্ট একটা গ্রাম। বেশির ভাগ লোকজনই গরীব সেখানে। গ্রামে ঢোকা আর বেরুনো—একটা রাস্তা ধরেই। সে রাস্তা আবার যেমন সরু, তেমনি এবড়ো খেবড়ো। একে তো বেশ দূরের গ্রাম। তার উপর রাস্তার হাল খুবই খারাপ। সেজন্য বাইরের লোকজন বড় একটা আসে না এ গাঁয়ে। না রাজার চৌকিদার, না বাইরের কোন বণিক। তাতে হয় কী, ছোটখাট দরকারেও বাইরে ছুটতে হয় গাঁয়ের লোকজনকে।
নতুন বউকে নিয়ে ঘর করে একটা লোক। যেমন অভাবী, তেমনি সাদাসিধে মানুষ। বনের কাঠ কেটে আনে। পুড়িয়ে কাঠকয়লা বানায়। হাটে গিয়ে তাই বেচে, দু’চার টাকা পায়। তাতেই পেট চলে দুজনের।
কপাল করে বউটাও জুটেছে তার। কোন কিছুতেই তার অভিযোগ নাই। টেনেটুনে সংসার চালিয়ে নেয় বউটা। মুখ বাঁকায় না কখনও। হাসিখুশিতেই থাকে দুটিতে।
একদিন হাটে যাবে বেরিয়েছে লোকটা। দু’দিকে কাঠকয়লা ভর্তি দুটো ঝুড়ি চাপিয়ে, বাঁক ঘাড়ে চাপিয়ে হাটে যায় সে। সেদিন কী মনে হোল লোকটার। বউকে বলল—হাট থেকে তোমার জন্য কী আনব, বলো?
বউ তো শুনে, আহ্লাদে আটখানা। বলল—একটা চিরুনি নিয়ে এসো। আমার খুব শখ।
বউ আহ্লাদ করে বলল—কাঠের চিরুনি নয় কিন্তু।
লোকটা বলল—তবে? আর কিসের চিরুনি?
সেসময় গাঁয়ে-ঘরে কাঠের চিরুনিই চালু ছিল। সেটার কথাই জানে বউটি। বলল—চিরুনির হাতল যেন চকচকে হয়। রাজার বাড়ির মেয়েরা যেমনটা ব্যবহার করে। ঐ যে গো, আকাশের গোল চাঁদের মতো চকচকে।
গ্রাম থেকে হাট অনেকটা দূরের পথ। কাঁধে ভারি বোঝা। খানিক বেলাই হয়ে গেল হাটে পৌঁছাতে। দেশে তো গরীব লোকের অভাব নাই। অভাব নাই বনজঙ্গলে কাঠেরও। অনেকেই কাঠকয়লা বানিয়ে হাটে বেচতে আসে। খদ্দেরের তুলনায় দোকানি যেন একটু বেশিই।
তবে, সেদিন সব কয়লাই বিক্রি হয়ে গেল লোকটার। পয়সাও ভালোই এসেছে হাতে। মনে বেশ আনন্দ। খাবার-দাবার, এটা-ওটা কিনেছে। বাড়ি রওণা দেবার সময় ভাবছে, এতো জিনিষ-পত্তর দেখে বউ নিশ্চয় খুব খুশি হবে।
বউর কথা মনে আসতেই, চমকে গেল লোকটা—হায় ভগবান! বউয়ের জিনিষটা তো কেনা হয়নি!
আবার হাটে ঢুকে পড়ল তাড়াতাড়ি। তখন বিকেল হয়ে গেছে। দোকানিরাও পসরা গোটাতে শুরু করে দিয়েছে। এবার সমস্যা শুরু হোল তার। বউ যে কী নিয়ে যেতে বলেছিল, মনে পড়ছে না এখন। বেমালুম ভুলে গিয়েছে।
হায় ভগবান, কী হবে এখন? না নিয়ে গেলে, মনে কষ্ট হবে বউয়ের। নতুন বউ। এ ঘরে আসা পর্যন্ত, মুখ ফুটে কিছুই চায়নি কোন দিন। এদিকে, কী চেয়েছিল বউ? কিছুতেই মনে করতে পারছে না নামটা। দোকানের পর দোকানে ঢুঁ মারতে লাগল। যদি চোখে পড়লে, মনে এসে যায়—এই ভাবনায়।
কিছুতেই মনে আসছে না। খুব কষে দাড়ি চুলকাতে লাগল। কী যেন বলেছিল? কী যেন বলেছিল? ফিতে দেওয়া চামড়ার চটি কি? না কি, ফার দেওয়া গরম কোট?
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সময় চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। গোল চাঁদ উঠছে আকাশে। চাঁদটা চোখে পড়ে গেল তার। আরে, এটার কথাই তো বলেছিল বউ। এই গোল জিনিষটার মত চকচকে।
দোকানে দোকানে গোল আর চকচকে জিনিষ খোঁজা শুরু হোল তার। এ দোকান, সে দোকান ঘুরে ঘুরে খোঁজা চলছে। এক দোকানি বলল—এখন ঘরে ফেরার তাড়া। কী চাইছ তুমি, মুখ ফুটে বলো দিকিনি?
লোকটা বলল—সেটাই তো মনে নাই গো। তবে, বউ বলেছিল গোল আর চকচকে।
--ওহ, সেই কথাটা বলবে তো? এই নাও। বলে একটা আয়না ধরিয়ে দিল ছেলেটাকে। মনে কী খুশি লোকটার। শেষমেশ পাওয়া গেছে জিনিষটা। তাছাড়া, জিনিষটা দেখতেও ভারি সুন্দর। যেমন গড়ন, তেমনি রূপ।
বাড়ির পথ ধরল আনন্দিত মনে।
একটু রাতই হয়ে গেছে ফিরতে। বউ তো পথ চেয়ে বসে ছিল। স্বামীকে ফিরতে দেখে, চোখ মুখ আলো হয়ে উঠল তার। সে হাত বাড়িয়ে বলল—আমার জিনিষ কোথায়? চিরুণিটা এনেছ তো?
এতক্ষণ যেন হাওয়ায় উড়ে উড়ে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছিল। বউয়ের চাহিদা মতো জিনিষটা শেষ পর্যন্ত আনতে পেরেছে, এই আনন্দে। চিরুণির নাম শুনেইএকেবারে ভড়কে গেল বেচারা। নতুন বউ। একটা মাত্র জিনিষ চেয়েছে মুখ ফুটে। সেটাও ঠিকঠাক আনতে পারলাম না? কপাল চপড়াতে লাগল বেচারা।
আর বউ? কাগজে মোড়ক করা জিনিষটা দেখেই বুঝে গেছে, এটা আর যাই হোক, কোনমতেই চিরুণি নয়। কেননা, চিরুণি কখনও গোল হবে না। কী করা যাবে এই মানুষকে নিয়ে?
তবু মনে কৌতুহল। দেখাই যাক, কী আনতে, কী এনেছে? মোড়ক খুলে, দুটো চোখ গোল গোল। অনেকটা কুঁচকে, ভুরু উঠে গেছে উপর দিকে। মুখ হাঁ। এ কী দেখছি? কাকে দেখছি এর ভিতরে?
আয়নায় নিজের মুখখানা ফুটে উঠেছে তার। বউ তো ভাবতেই পারছে না ব্যাপারটা। আয়না নয়, যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে নিজের হাতে।
হাতে আয়না ধরে ধেই ধেই নাচতে লেগে গিয়েছে মেয়েটা। কী আনন্দ, কী আনন্দ! পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করছে মুখখানা।
লোকটা তো এতক্ষণ লজ্জায় কুঁকড়ে ছিল। ঠিকঠাক জিনিষ না আনতে পারার কী কৈফিয়ত দেবে সে বউকে?
এখন বউয়ের নাচ দেখে,লজ্জাটজ্জা উধাও। বেদম ভড়কে গেল দৃশ্য দেখে। সাধাসিধে মানুষ। একটা ভুল জিনিষ ঘরে আনবার মধ্যে, নৃত্য করবার কী কারণ থাকে, মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই।
0 Comments