জ্বলদর্চি

রানী শিরোমণি ও চুয়াড় বিদ্রোহ /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৯১

রানী শিরোমণি ও চুয়াড় বিদ্রোহ

সূর্যকান্ত মাহাতো


১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে স্বামী অজিত সিংহের মৃত্যুর পর ১৭৫৬ থেকে ১৮১২ পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৫৬ বছর ধরে 'রানী শিরোমণি'  কর্ণগড় রাজবংশে রাজত্ব করেন। 'পলাশীর যুদ্ধ' থেকে 'চুয়াড় বিদ্রোহ' সবকিছুই দেখেছেন তিনি। তাকে 'মেদিনীপুরের লক্ষীবাঈ'ও বলা হয়ে থাকে। ইংরেজ শাসকের হাতে বন্দীও হয়েছিলেন চুয়াড় বিদ্রোহে জড়িত থাকার সন্দেহে। ব্রিটিশ আমলে তিনিই ছিলেন প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী।(স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর, বসন্ত রঞ্জন দাস, পৃষ্ঠা- ৪৯) এখানে প্রশ্ন উঠে আসে, 'সন্দেহ' কেন? তবে কি তিনি এই বিদ্রোহে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না? তাহলে 'লক্ষ্মীবাঈ' এর সঙ্গে তুলনায় বা কেন? যেখানে লক্ষীবাঈ সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন?

এমন ব্যাখায় যাওয়ার আগে রানী শিরোমণি চুয়াড় বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন লেখকেরা যে 'সন্দেহের' কথা বলেছেন, সেগুলো সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। 'বিনয় ঘোষ' তার "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি" (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থে বলেছেন, "বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ শাসকদের হাতে রানী শিরোমণিকেও যথেষ্ট লাঞ্ছিত হতে হয় যেহেতু ইংরেজদের সন্দেহ হয়, যে বিদ্রোহীদের সঙ্গে রানীও গোপন চক্রান্তে লিপ্ত।" (পৃষ্ঠা- ৪৮)

'যোগেশচন্দ্র বসু' তার "মেদিনীপুরের ইতিহাস" গ্রন্থে বলেছেন, "কর্ণগড় ও আবাসগড় আক্রমণ করা হইল এবং চুয়াড়দিগের সহকারিতা সন্দেহ হেতু কর্ণগড়ের জমিদার রানী শিরোমণিকে বন্দিনী করিয়া ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ই এপ্রিল তারিখে মেদিনীপুরে আনা হইল।" (পৃষ্ঠা- ২৪৬)

জে.সি. প্রাইসের লেখা "চুয়াড় রেবেলিয়ন" গ্রন্থের তথ্যসূত্র ধরে লেখা "স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলা" গ্রন্থে 'অধ্যাপক নরহরি কবিরাজ' উল্লেখ করেছেন, "জেলার কালেক্টর সন্দেহ করলেন যে মেদিনীপুরের জমিদার রানী শিরোমনি এবং নাড়াজোলের রাজার আত্মীয় চুনীলাল খাঁ চোয়াড়দের উৎসাহ দিচ্ছেন।" (পৃষ্ঠা- ৪১)

সুপ্রকাশ রায়ও জে.সি. প্রাইসের তথ্যসূত্র নিয়ে লেখা "ভারতের কৃষক বিদ্রোহ" গ্রন্থে রানিকে সন্দেহ করার কথাই উল্লেখ করেছেন।

সুতরাং দেখা গেল বিভিন্ন লেখকেরা চুয়ার বিদ্রোহে রানী যুক্ত ছিলেন কিনা সেটাকে 'সন্দেহ' আকারেই প্রকাশ করেছেন। চুয়াড় বিদ্রোহের সঙ্গে রানী সরাসরি যুক্ত ছিলেন বা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এমন কথা এদের কেউ বলেননি। তবে কি রাণী সরাসরি যুক্ত ছিলেন না? কারণ সুপ্রকাশ রায়ও তার "ভারতের কৃষক বিদ্রোহ" গ্রন্থের এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন,"... তাহারা (শাসকগণ) বহু চেষ্টা করিয়াও বিদ্রোহীদের প্রতি জমিদারগনের সমর্থন প্রমাণ করিতে পারেন নাই।" (পৃষ্ঠা- ১৫১) এই জমিদারগনের মধ্যে রানী শিরোমণিও ছিলেন। তবে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে রানী জড়িত ছিলেন নিশ্চয়ই। না হলে তাকে গ্রেপ্তার করা হত না। কিংবা সন্দেহের চোখে দেখা হত না। ব্রিটিশ শাসকদের হাতে এমন কিছু তথ্য ছিল যাতে রানীকে সন্দেহ করা যায়। সেই সন্দেহ নিশ্চয়ই অমূলক কিছু ছিল না! এ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে।
🍂
জে. সি. প্রাইস তার "চুয়ার রেবেলিয়ন অফ ১৭৯৯" গ্রন্থে রানীকে সন্দেহ করার একটি জোরালো প্রমাণের কথা উল্লেখ করেছেন। লেখক 'সুপ্রকাশ রায়' তার "ভারতের কৃষক বিদ্রোহ" গ্রন্থে সেই কারনটি বর্ণনা করেছেন এইভাবে---"বিদ্রোহীরা জেলার সকল জমিদার, তহসিলদার, ইজারাদার ও বিশেষত বনিয়াদের পত্রদ্বারা সতর্ক করিয়া দেয় যে, যদি কেহ ইংরেজ পক্ষের সৈন্যদের খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করে তবে তাহাকে হত্যা করা হইবে। বিদ্রোহীরা ইহাকে রানী শিরোমণির নির্দেশ বলিয়া প্রচার করে।"(পৃষ্ঠা- ১৫১) সুতরাং 'রানী শিরোমনির' নাম নিয়ে জমিদারদের ভয় দেখানোটা ইংরেজদের পক্ষে রানীকে সন্দেহ করার পক্ষে বেশ জোরালো একটা প্রমাণ ছিল।

দ্বিতীয়তঃ মেদিনীপুর জেলার কালেক্টরও সন্দেহ করেছিলেন যে রানী এই বিদ্রোহে উস্কানি বা ইন্ধন যোগাচ্ছেন। তার কারণ হিসেবে দুটি উদ্দেশ্যের কথাও তিনি বলেছিলেন, এক) রানী পাইকান জমি গুলো ফিরে পেতে চান। দুই) তিনি ভাবছেন হয়তো এই বিদ্রোহের ফলে কোম্পানি শিক্ষা পাবে এবং কম খাজনায় জমিদারি বন্দোবস্ত করবে। (স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলা, নরহরি কবিরাজ, পৃষ্ঠা- ৪১)

তৃতীয়ত, রানী শিরোমণির সঙ্গে ইংরেজদের মধ্যে একটি গলযোগ তৈরি হয়েছিল। রানীর জমিদারিতে রতন সিং, রাম সিং, রঞ্জিত মহাপাত্র সহ বেশ কয়েকজন সর্দার তহশীলদারকে ইংরেজরা বরখাস্ত করেছিল এবং তাদের জমি বন্দোবস্ত দিতেও নাকি অস্বীকার করা হয়েছিল। (জঙ্গলমহাল ও মেদিনীপুরের গণবিক্ষোভ, বিনোদ শংকর দাশ, পৃষ্ঠা- ৪৭) সুতরাং রানীর খুবই প্রিয়পাত্র দুই তহশীলদারদের বরখাস্ত করাটা রানী খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। এই বিষয়টাও শাসকদের মাথায় ছিল। তার উপর রানীর দুই দেওয়ান বাঞ্ছারাম বক্সী ও সীতারাম খানকেও বন্দী করা হয়েছিল। এমনকি রানীর নিষ্কর জমির নিলাম ডাকা শুরু হলে কোন মহাজন ভয়ে সেই ডাক নেওয়ার সাহস দেখায়নি। (পৃষ্ঠা- ৫১) সেটাও একটা কারণ ছিল।

চতুর্থত, ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে কর্ণগড়ের রানী শিরোমনি ও তার কর্মচারীরা ইংরেজদের প্রতি ভালো ব্যবহার করছে না এই অজুহাতে কালেক্টর রানীর রাজ্য বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। (স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর, বসন্ত রঞ্জন দাস, পৃষ্ঠা- ৪৯) যার কারনে রানী বেশ ক্ষুন্ন হয়েছিলেন। 

যে রানী শিরোমনি একসময় চুয়াড় বিদ্রোহের নেতা গোবর্ধন দিকপতির আক্রমণে 'কর্ণগড়' ছেড়ে নাড়াজোলে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এবং একসময় ইংরেজদের বিদ্রোহ দমনে ফার্গুসনকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে পরবর্তীকালে সেই রানীর কী এমন ঘটেছিল যে তাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যেতে হয়েছিল?  লেখক 'আমিনুল ইসলাম' রানীর সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল তার বেশ কিছু নতুন তথ্য উপস্থাপন করেছেন। যেমন ব্রিটিশ সেনাপতি ফার্গুসন বিদ্রোহ দমনের সময়কালে বা অভিযানে রানীর কাছে সৈন্য সামন্তের সাহায্য চেয়েছিলেন। রানী সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন, তবে তার পরিবর্তে টাকা দাবি করেছিলেন। 'ফার্গুসন' টাকা দিতে অস্বীকার করলে রানীর সঙ্গে তার একটা মনোমালিন্য তৈরি হয়েছিল। (ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অপ্রকাশিত ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ৬০) এই ঘটনাও রানীকে সন্দেহ করার একটা কারন ছিল।

বিদ্রোহের গতিপ্রকৃতি এবং সেই বিদ্রোহে রানীর সমর্থন ইংরেজরা ভালো চোখে দেখেননি। আবার রানীর প্রভাবও তাদের মাথাব্যথার কারণ ছিল। লেখক 'আমিনুল ইসলাম' তার 'ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অপ্রকাশিত ইতিহাসে' একটি উদাহরণও দিয়েছেন। "১৭৯৪ সালে রামগড়ের কালেক্টর অভিযোগ তুলল রানী শিরোমনি ও তার আত্মীয়বর্গ প্রজা সাধারণ কেউই ইংরেজদের সাথে যথাযথ ও আশানুরূপ ব্যবহার করছে না। তাদের ব্যবসার ভীষণ ক্ষতি করছে।"(পৃষ্ঠা- ৬০) আসলে ইংরেজরা রানীর জমি হস্তগত করার নানান অজুহাত তৈরি করেছিল সে সময়। তাই এই অজুহাতে ১৭৯৪ সালের ১৮ই জানুয়ারি রানীর জমিদারি পরিচালন ব্যবস্থার কর্তৃত্বও নিয়ে নিয়েছিল।

রানীর ইংরেজ বিদ্বেষী হওয়ার বেশ কিছু কারণের কথাও লেখক 'আমিনুল ইসলাম' জানিয়েছেন। যেমন, ১৭৮৪ সালের ৮ই জুলাই কর্ণগড়ে একটি কৃষক বিদ্রোহ গড়ে উঠেছিল। সীতারাম খান ও বাঞ্ছারাম বক্সি ঐ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। রানী বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিলেন। ইংরেজ তখন সেই বিদ্রোহে শঙ্কিত হয়ে ঐ দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করে মেদিনীপুরের ফৌজদারি কোর্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবং রানীকে সাবধান করে বলেছিলেন, ফের রানী এমন বিদ্রোহে সহযোগিতা করলে তার প্রাণদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। (পৃষ্ঠা- ৬১) আবার ১৭৯০ সালে ১১৯৫ টাকা খাজনা বকেয়া থাকায় রানীর নানকর জমিও ক্রোক করে দিয়েছিল ইংরেজরা।

রানী শিরোমনির বিদ্রোহী হয়ে ওঠার পিছনে বেশ কতগুলো কারণের কথা উল্লেখ করেছেন "ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অপ্রকাশিত ইতিহাস" গ্রন্থের লেখক। এক) ১৭৯৪ সালে জমিদারি ম্যানেজমেন্ট ইংরেজরা কেড়ে নেওয়ায় রানী অপমানিত বোধ করেছিলেন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন।

দুই) রানীর সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সঙ্গে ইংরেজরা বেশ মাখামাখি শুরু করেছিল যেটা রানীকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। অর্থাৎ শত্রুর শত্রু যে মিত্র এমন নীতির আশ্রয় নিয়েছিল ইংরেজরা।

তিন) রানী দেখেছিলেন বিপুল জনসমর্থন এবং পার্শ্ববর্তী জমিদারদের সহযোগিতা ছাড়া বিদ্রোহ একরকম অসম্ভব। তাই একদিকে প্রজাদের সমর্থন লাভ, পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী জমিদারদের নিয়ে একটি গোপন বৈঠক ডেকেছিলেন। সেখানে তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন কেন ইংরেজরা সকলের শত্রু।(ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অপ্রকাশিত ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ৬১)

ইংরেজদের রানীকে সন্দেহ করার আরো যে দুটো বড় কারণের কথা জানা যায়, তা হল, এক) কর্ণগড়ের চারিদিকে বিদ্রোহীদের আস্তানা গড়ে উঠেছিল। দুই) রানীর নায়েব যুগলচরণের বিশ্বাসঘাতকতা। তিনি কর্ণগড় রাজ্যের অধিকার পাওয়ার লোভে রানীর সব গোপন উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ ইংরেজদের কাছে প্রকাশ করে দিতেন। ফলে ইংরেজরা রানীর বিষয়ে অনেক কিছুই জেনে গিয়েছিলেন এবং তাদের সন্দেহ যে সত্যি সেটা প্রমাণিত হয়েছিল।

অবশেষে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে আবাসগড় দখল করা হয়েছিল। তারপর রানী, চুনিলাল খাঁ, এবং নরনারায়ন বক্সীর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল তাদের গ্রেপ্তার করে মেদিনীপুর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে বিচারে যদিও রানী মুক্ত হয়েছিলেন তবে আর কর্ণগড়ে ফিরে আসেননি। আবাস গড়েই মৃত্যুর শেষ কয়েকটা বছর কাটিয়েছিলেন। রানীর মৃত্যু নিয়েও নানান জনশ্রুতি শোনা যায়, জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা, নাকি গুম খুন, নাকি অসুখে মৃত্যু এরকম একাধিক মতের কথাও উঠে এসেছিল।

তথ্যসূত্র: ১) মেদিনীপুরের ইতিহাস/ যোগেশচন্দ্র বসু
২) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি(দ্বিতীয় খণ্ড)/ বিনয় ঘোষ
৩) স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলা/ নরহরি কবিরাজ
৪) স্বাধীনতার সংগ্রামে মেদিনীপুর/ বসন্তরঞ্জন দাস
৫) ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক ইতিহাস/ সুপ্রকাশ রায়
৬) ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অপ্রকাশিত ইতিহাস/ আমিনুল ইসলাম
৭) মেদিনীপুর/ তরুনদেব ভট্টাচার্য

Post a Comment

0 Comments