জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব- ১৫/গৌতম বাড়ই

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ১৫
গৌতম বাড়ই


উত্তর দিকে  যে হিমালয় পাহাড় , যেখানে সবাই অল্প বেশি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, আমাদের এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তাদের বাস, যাদের মর্জিমাফিক এই পৃথিবীর সমস্ত ভালোমন্দ পরিচালিত হয়, সাধারণ লোকে যেখানে যেতেই পারে না, তারা হয়ত  অক্ষম সেখানে যেতে। তাদের সেই অসীম শক্তি নেই। সেই পাহাড় আর তা পেরিয়ে চৈনিক বণিকদের দেশ। বছরের পর বছর , হাজার হাজার বছর ধরে তারা সেই গিরিখাত পেরিয়ে নিজেদের ব্যাবসার প্রয়োজনে তৈরি করা পথে মহা-ভারতবর্ষে ব্যাবসা করতে এসেছেন। তাদের কিংশুক বস্ত্রের বিপুল চাহিদা এই দেশের ধনীদের মধ্যে। বিনিময়ে তারা ঘি, মধু, মহার্ঘ্য ধন- সম্পদ এ দেশ থেকে নিয়ে ফেরে নিজেদের দেশে। এক পক্ষকাল বা তার থেকেও বেশি সময় ধরে সুদূর সেই তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে মুগ্ধ নগরীর দিকে রওয়ানা হয়েছেন। এর মধ্যে আকাশে বড় গোলাকার চাঁদ উঠেছে, আলোয় ভেসেছে পুরো পৃথিবী, আবার অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে এ ধরিত্রী। আবার আকাশে আলোমাখা চাঁদ একটুকরো থেকে প্রতিদিন স্ফীত হচ্ছে। মাসখানেক হতেই চলল তাহলে। এই বণিক দলে একজন বয়স্ক বণিক রয়েছেন। একদম বৃদ্ধ তাকে হয়ত বলা যাবে না। তাঁর অভিজ্ঞতা তরুণ বণিকদের এই বাণিজ্যপথে ভীষণ প্রয়োজন। 

এক জলে ভরা বিস্তীর্ণ নদীর দু-পারের অপরূপ দৃশ্যাবলী ও তার পাড়ের সমৃদ্ধশালী অঞ্চলগুলির পর তারা লোকবসতি হীন অনুর্বর, লালমাটির, নুড়ি কাঁকড়ের এক ভূপ্রাকৃতিক স্থানের মধ্যে দিয়ে লোক- লস্কর নিয়ে সেই ভিনদেশী বণিকেরা আজ কয়েকদিন হল চলেছেন। জঙ্গলাকীর্ণ পথ। তবে ঘনত্ব কম উর্বর স্থানের মতন। এর আগে স্থানে- স্থানে সমৃদ্ধ গ্রামাঞ্চলের উপর দিয়ে তারা এসেছেন, অধিবাসীদের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল কৃষিসম্পদে তারা প্রায় প্রত্যেকেই যথেষ্ট সম্পদশালী। ধীরে- ধীরে রাঢ় অঞ্চলে প্রবেশ করবার পর তাদের নজরে আগের থেকে অনেক বৈপরীত্য ধরা পড়ল। এর মধ্যে এই দূর্গম অঞ্চলের রাস্তাঘাট চিনিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আরও জনাবিশেক স্থানীয় বাসিন্দা তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। সেইসব পুরুষদের অগ্রিম হিসেবে কিছু খাদ্যদ্রব্য, বিনিময় সম্পদ তুলে দিতে হয়েছে এইসব বণিকদের। অগ্রিম হিসেবে পাওয়া সেইসব জিনিস পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন তারা। যাতে দীর্ঘদিন তাদের অনুপস্থিতিতে পরিবারের কোনও অসুবিধা না হয়। ক্ষুন্নিবৃত্তি এবং জীবন নির্বাহের জন্য। রাঢ়ের সেইসব লোকজনের জন্য এই বণিকদের আরও লোকবল বেড়েছে। তারা সেই বয়স্ক বণিকের মুখ থেকে শুনেছে, এই অঞ্চলে প্রতি মুহূর্তে বিপদের আশঙ্কা আছে। লুঠেরা আর আদিম হিংস্র প্রজাতির কিছু আদিবাসী এখনও এই অঞ্চলের জঙ্গলে বাস করে। তাদের অতর্কিত আক্রমণে জীবনহানিও হতে পারে, এইসব পথের কাহিনী তাদের জানা আছে। সেজন্য রাঢ়ের এইসব লোকজনকে , যাকে এখন বলে গাইড হিসেবে ও রক্ষী হিসেবে নেওয়া। তারা চলেছেন মগধ নগরীর দিকে। এখন দুপুর ছাড়িয়ে, বিকেলের দিকে গড়াচ্ছে বেলা। সামনে কোথাও নদী আর রাতের আস্তানা গাড়বার পরিষ্কার জায়গা পেলেই আজকের দিনের মতন যাত্রা তারা সাঙ্গ করবে। সঙ্গের সেইসব স্থানীয় লোকজন যখন বলছেন, আর কিছু সময় পরেই তারা রাতের ঘাঁটি গাড়বার জায়গা আর একটা নদীরই কাছাকাছি থাকবার উপযুক্ত ফাঁকা জমি পেয়ে যাবে। তারা চলেছেন একটু জোরেই, এমন সময় সুসীমা 
তাদের মাঝে এসে পড়ল। 
🍂

বণিকদল নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, এই নারীকে আগে পরখ করে নাও, সে কুহকিনী বা মায়াবী কিছু নয়  তো? তারা শুনেছে, এই দেশও তাদের দেশের মতন বহু প্রাচীন। জাদু, মায়া, রহস্য, অদৃষ্টবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই পুরুষদলের মাঝে এই নারী নিজেকে সবার সাথে মানিয়ে নেবেন কী করে? মুটের দল আর রক্ষীরা ভালো করে রাজকন্যা সুসীমার দিকে তাকিয়ে দেখল, এ মেয়ের আলাদা এক দীপ্তি রয়েছে চেহারার মধ্যে, যতই শ্রান্ত আর ক্লান্ত হোক না কেন! তবে মুখের প্রতিটি রেখায় এখন অভুক্ত থাকবার ছাপ। একে ভালো মতন বাঁচিয়ে রাখতে গেলে এই মুহূর্তে ওকে কিছু খাদ্য আর পানীয় জল দেওয়া দরকার। 

সুসীমা ভয়ার্ত চোখে পিছন ফিরে চাইছিল বারবার। বণিকদলের পালোয়ান লোকজন তা দেখতে পেয়ে তাকে আশ্বস্ত করল- " মাতা জননী আপনি বিপদে পড়ে আমাদের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। আপনি নিশ্চিন্তে আগে কিছু সাময়িক খাদ্যদ্রব্য খেয়ে নিজের শরীরে বলবান হন। আপনায় আমরা সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করব। ভয় পাবেন না। আজ আমরা কিছুমাত্র দূরত্ব গমন করেই আজকের মতন যাত্রা বিরতি ঘটাবো। রাতের অস্থায়ী আস্তানা গাড়ব। আপনি খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করুন। "

যব আর ভুট্টার ছাতু, ফলমূল এক পাত্রের মধ্যে এনে, সঙ্গে পানীয় জল দিল তাকে। সেইসব বণিকদলের লোকেরা। সুসীমার সত্যি এবার শারীরিক বল ফিরে এলো। বণিকদল কিছুটা সময় এখানে পার করে আবার ওদের গন্তব্য অভিমুখে রওনা হল। সুসীমার মনে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ হতে লাগল। মুটের দল গান জুড়েছে। একটি ঘোড়ার পিঠে সুসীমাকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এ ঘোড়া তাদের রাজমহলের ঘোড়ার মতন তেজী, বলবান বা দীর্ঘাকৃতি নয়। তবে তার  হাঁটার কষ্ট তো লাঘব হয়েছে। একজন সুন্দরী নারীর আগমনে এই বণিকদলের মাঝে যেন আনন্দ ঝরনা বয়ে গেল। চাঁদের আলোতেই তো বিরাট এই পৃথিবীর প্রকৃতি- চরাচর কেমন হেসে ওঠে, তাই না! তারা গাইছে মাটিতে, পাখিরা ফিরছে সুদূর থেকে তাদের আপন আস্তানায় গাছে- গাছে। তারাও গান গাইছে। এ ঘরে ফেরার গান। আর এইখানে সুদূরে গমনের গান। পৃথিবীর হাসি ঝরে পড়ছে আশপাশের প্রকৃতিতে। সুসীমা চলেছে অজানা এক পথে, তবে এরমধ্যেই জেনেছে এই বণিকদলের মগধ নগরীতে ব্যাবসায় উপলক্ষে এই মাত্রার কথা। সুসীমার দিকে তারা যেন অপলক তাকিয়ে আছে প্রত্যেকে সবাই। সুসীমাও তাদের তার মিষ্টি হাসিতে প্রত্যূত্তর দিচ্ছে।

আরও কিছুটা যাওয়ার পর বণিকদলের আজকের মতন যাত্রা বিরতি হল। সুসীমার জন্য মুহূর্তে এক কাপড় দিয়ে ঘেরা জায়গা তৈরি করে দিল। এইসব লোকজন যে পেশাদারী তা তাদের দ্রুত কাজকর্ম সারা দেখে বোঝা যাচ্ছে, এই জঙ্গলমহলে অন্ধকার ঘনিয়ে আসবার আগেই অনেক মশাল জ্বলে উঠলো। রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল, রাত শুরুর সঙ্গে - সঙ্গে সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়বে। তবে সবাই একসাথে ঘুমোবে না। পালা করে তারা পাহারায় থাকবে কিছু লোকজন। বলা তো যায় না, এই জঙ্গলে হিংস্র জন্তু- জানোয়ার, সরীসৃপ বা নৃশংস দস্যুদলের আক্রমণও যে কোনও সময় হতে পারে। রাত কিছুটা হতেই দলবলের চঞ্চলতা কমে এল। সারাদিনের পথচলার ক্লান্তিতে অনেকেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাচক আর সাহায্যকারীরা নিকটের নদী থেকে হাড়ি- পাতিল- বাসনপত্তর সব ধুয়েমুছে এনেছে। সুসীমা তার ঘেরা অঞ্চলের ভেতর থেকে সবই টের পাচ্ছে। তবে এত ভালোমানুষের ভিতরে যে দু-একজন খারাপ মানুষ থাকতেই পারে  , তা ভেবে সতর্কেও আছে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই। ভোরের আলো ফুটে উঠতেই, পাখিদের কিচিরমিচির আর লোকজনের হইচই হট্টগোলে ঘুম ভাঙলো তার। ধড়মড় করে উঠে বসলো।  একজন বয়স্ক মুটেকে তার কাছে ডেকে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলো। এরপর সেই বয়স্ক লোকটির সাথে দলবলের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে নদীর পাড়ে জঙ্গলে চলে গেল। সেই লোকটি দূর থেকেই চেঁচিয়ে বলল- " মা বেশিদূর যেও না। আমি এখানে পাহারায় রয়েছি। অসুবিধে হলেই চেঁচাবে। " 

বণিকেরা সবাই এই সকালবেলায় যেন এক সদ্যফোটা গোলাপের দর্শনে প্রীত হয়ে উঠলো। তাদের ভিনদেশী ভাষায় কী যেন চুংটুং গান গেয়ে উঠল। এভাবেও কেউ প্রেম ঢেলে দেয় সব মনে, পুরুষ মাত্রই জানে এ মধুর ভাবের মানে। মগধ যাত্রার আবার শুরুয়াত হল। এই দলে লোকজনের সাথে একজন ঘোষকও রয়েছেন। তিনি ঘোষণা করলেন- "আজ দুপুর নাগাদ , পশ্চিমে যতটা পারি এগিয়ে গিয়ে আমরা খাবার গ্রহণ করব। এখনই আমাদের যাত্রা শুরু হবে। "

বণিকেরা বঙ্গের যে কৃষিপ্রধান সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো পার করে এসেছেন, সেখানে সাময়িক সময়ের বিরতিতে কিছুটা বাণিজ্য করেও নিয়েছেন। তবে তেমন ভাবে কোনও বড়নগরী চোখে না পড়লেও, লোকবসতির ঘনত্ব বলে দিচ্ছিল, এ অঞ্চল মানুষের বসবাসের উপযোগী ও উপযুক্ত। এই রাঢ় প্রদেশের মতন পান্ডববর্জিত এ জায়গা  নয়। 

সবে যখন তারা যাত্রা শুরু করেছে, এমন সময় দূর থেকে কিছু মানুষের আগমনের বার্তা পাওয়া গেল। তারা পদব্রজে দ্রুত এদিকে ছুটে আসছে। আর হাত দুটো তুলে কী যেন ইশারা করছেন পেছনে। ক্রমে সেই কালো মাথাগুলি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগলো। তারা বিপদসূচক আর্ত চিৎকার করছে আর সাবধান- সাবধান করছেন। বণিকদলের লোকেরা এবার সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। এই বণিকদলের ভেতরে রাঢ়ের নিযুক্ত লোকজনেরা প্রথমেই অগ্রভাগে ছুটে গেল। সুসীমা এই দলের ঘেরাটোপের মধ্যেই রয়েছে। তবুও কী এক অজানা আশঙ্কায় তার বুকও দুরুদুরু করে উঠল। 

তবে এরা কারা ??
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments