জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( ত্রিংশতি পর্ব )/ শ্রীজিৎ জানা


বাগদি চরিত ( ত্রিংশতি পর্ব ) 

শ্রীজিৎ জানা
 
বানবন্যার জল নেমে গেছে। কালসাবা মাঠ জুড়ে এখন শুধুই ব্যানাঘাসের বন। জলে ডুবে থেকে ব্যানাঝাড়ের গায়ে কালো আস্তরন পড়েছে। কতদিন শ্বাস নিতে না পেরে দম আটকে ঝিমিয়ে গেছে ঘাসেদের শরীর। ধীরে ধীর শিশিরে ভিজে,হাওয়ার যত্নে আবার সতেজ হচ্ছে ক্রমশ। জমির উপরে দলা দলা মরা শ্যাওলা, মড়ার কাঠ,গাছের ভাঙা ডাল, বাঁশের শূলা,বাতা আরো কত ভিরকুটি চবরাচাটি। সারা মাঠ জুড়ে ছড়া- ছত্তিরি হয়ে পড়ে আছে। তার উপরে হাড়,খুলি, জাল ছ্যাঁড়া, ভাঙা তোবড়ানা বাসনকোসন,ভাঙা মাটির কলসি ইত্যাদি দেখে শেষ করা যাবে না। সব বানের জলে ভেসে এসে কালসাবার মাটে জমা হয়েছে।তবে মাটির রস না শুকালে ঢোলের কোন চাষীই মাঠে পা দেয় না সহজে। রোদে মাটি তেতে ফুটিফাটা হলে মাঠে নামবে সব্বাই। তখন নিজের নিজের জমি পরিস্কার করতে থুড়িলাফ খাবে সব। কোথায় কি মড়ার কাঠ আর  খুঁচন লাঠি কোন কিছুই বাছ বিচার থাকে না তখন। গোটা কালসাবায় চাষ করা যায় না ঠিকই। শ্যালো পাম্প কিম্বা মিনির জলের ব্যবস্থা নেই পুরো মাঠে। কালসাবার খালবিলের জলে সব্জি চাষ হয়। শিলাইয়ের জলও অনেকটা যোগান দেয়। তবে মাঝের মাঠ অব্দি নিয়ে যাওয়া যায় না। তাবাদে অত জলও থাকে না। আগে ত ডোঙা আর সেমনি দিয়ে জল ছিঁচা হত।
এই সময় কালসাবায় চাষ বলতে লঙ্কা, উচ্ছা, কুমড়া, আর ভুঁ-শশা। সেই শীতের শেষ পর্যন্ত হাট চলবে এইসব সব্জি আনাচ বেচাকেনা। আর শুয়ে বসে কাটানোর জো থাকবে না মেইয়া- পুরুষদের। সন্ধ্যা অব্দি মাঠে থাকবে অনেকেই। এই ফসল অনেকের হাতে দুটো কাঁচা টাকা এনে দেয়। খরাকির চালটুকু থাকলেই ত আর চলবে না। নুন তেল কেনার জোগাড় টুকুও করতে হয় তাদের।
ঢোলের অনেকেই ভাগ চাষী। এক একজন বহুদিন ধরে পূর্বের মনিবদের জমি চাষ করছে। এখন আর বর্গা আইন নেই। এক সময় বর্গা আইন বলবৎ ছিল। প্রাণকিষ্ট প্যোড়া, অভয় দোলই,রামকিষ্ট সাঁতরা সেই আসলে ঘোষেদের জমি বর্গা করে নেয়। লোখার বাপকেও তারা যুক্তি দিয়েছিল শক্তি মন্ডলদের জমি বর্গা করার জন্য,লোখার বাপ রাজি হয় নি। বলে,
— মনিবরা বিশ্বাস করে মোকে চাষ কত্তে দিচে, বেইমানি কত্তে পারবোনি। মোর কপালে খেতলখ্যি নাই। ভগমান পরের জমিনে খেটেলুটে খাবার ভাগ্য দিচে। তাই কোরেই বালবাচ্চাদের মানুষ কোরব। তবু নিমখারামি কোরবো নি। যেদি পারি গতর খেটে নিজে দুকাঠা কিনব।
পানকিষ্ট কটাশের মতো ঘোলা চোখে তির্যক চাউনি চেয়ে বলে,
—ওরে মোর সাধু পরুষ রে। কিসের নিমখারামি - বল দিখি? কটা পেট তোর মোনিবদের? তোর- মোর কটা পেট? অদের জমিজিরাত কবিঘা? আর তোর -মোর কত? অদের জমিয়েই কি সারা জীবন গতর ফেলি রাকব। ঘাড়ে করে ফসল তুলে দি এসব অদের খামারে। আর মোদের কপালে মুঠাচাটি!
অভা দোলই থেমে থাকতে পারে না। লোখার বাপের কথাটা তারও গায়ে লেগেছে। সেও দু'কথা শুনাতে ছাড়ে না লোখার বাপকে-
—ভগমান কি জন্ম থিকেই অদের কপালেই জমিজমা লিখে দিছে। শালা খাটব আমরা আর পায়ের উবরে পা দুলিয়ে লুটবে অরা। পেট হিসাবে জমির হিসাব হবা উচিত?
—- ক্যানে পেট হিসাবে হবে? তুই পেট বাড়াবি আর সরকার তোর পেট চালাবে!
— তা ক্যানে,থাইলেও জমির নাজ্জ বিলি বন্টন কত্তে হবে সরকারকে।
—- তা ত বোলবিই। অই ত সুধাকর গয়লা তোদের মাথায় ঢুকি দিছে বর্গার ভূত। অই ভূত তোদের মাথা থিকে কুনু গুনীনেও নামাতে পারবেনি।
— তোর মাথায় চাপেনি ত,থাইলেই হবে। তুই ধম্ম পথে থেকে সগ্গে যাবি। মোদের নাইলে নরগে ঠাঁই হবে। তা হউ। কিন্তু তোর ভগমানের সংসারে কেউ পেট পুরে খাবে আর কেউ পেটে গামছা বেঁদে ঘুরবে ইটা ক্যামন ভগমানে বিচার জিগাস করবি দিখি। সরকার ঠিক কচ্চে জমির সমান ভাগ হবে। গতর যার, জমি তার।
রামকিষ্টও থেমে থাকতে পারে না। বেশ জোর গলায় বলে,
— সগ্গ -নরক ধম্ম-অধম্ম বুজিনি। যেই জমিয়ে মোদের গতর খাটাতে হয় বচ্ছরের পর বচ্ছর,তায়ে মোদের অধিকার জন্মাবে। তাবাদে সরকারও তো সপোট করে আইন করেছে ত,চিন্তা কিসের?
—-একে বলে পায়ে পা তুলে বিবাদ করা বুজলু। তোদের দিকে ত বর্গা কত্তে আমি বারণ করিনি মোর বিবেকে সায় দেয়নি। সেইজন্নে উ সব ঝুট ঝামেলায় যাইনি। বাপের যেটুকু আছে তাতেই দুমুঠা চাষবাস করে ছেনাপেনাদের মানুষ করব।
লোখার বাপ আর কোন উত্তর না করে সরে যায়। অজা দোলই কাঁধের গামছাটা বার কয়েক ঝটকিয়ে আবার কাঁধেই রেখে দেয়। পানকিষ্টর দিকে ঘুরে ম্যাটালি সাপের মত হাত দুটাকে আঁকিয়ে বাঁকিয়ে বলে,
— লাউ এবার বুজ ঠেলা। অ্যাকে বলে মেগে ঠকর খাবা। উ কোরবেনি ত কোরবেনি ছেঁড়া গেল মোদের। ক্যানে অকে বোলতে গেলে বল দিখি। এখন নিজে সাধু সেজে মোদের নামে কত কথা মনিব ঘরে লাগি বেড়াবে দেখবে খন।
—- ছাড় দিখি। আমারো ছেঁড়া গেল বোল্লে। পেটে খিদা মুখে লাজ! ক ছটাক ধান পায় উ। 
—শুনি ত উ নিজে মোটা ধান রেখে মনিবকে সরু ধান দিতে হয়। অত তেল জগিয়ে থাকা মোর দ্বারায় হবে নি।
—-যা বোলেচু! বেশি ধম্ম পথে থাকলেনি অই বেদাশালা গুলান চুষে খেই লিবে। নিজেদের হক জোর করে ছিনি লিতে হবে। শালা খাটব আমরা আর অদের ভোরবে কোরই -হামার। মেকানের কথা আর কি! 
— খিদার কাছে, পেটের জ্বালার কাছে কিসের আবার ধম্ম মারায়ঠে উ!


নাহ্,কারো কথার ফাঁদে পড়েনি লোখার বাপ। গতর খাটিয়েছে সে। অসুরের মত পরিশ্রম করেছে দিনরাত। কিন্তু বউ ছেনা প্রতিপালনেই তার সব রোজগার ফুরিয়ে গেছে। এক আধ কাঠা মাটি তার কেনা হয় নি জীবনে। বাপের রেখে যাওয়া জমিটুকুই তার সম্বল থেকেছে। তাকে সে খোয়াতে দেয়নি কিছুতেই। লোখাদের আমলে সেই বাপ ঠাকুর্দার জমি টুকরো টুকরো হয়েছে। যেটুকু লোখার প্রাপ্য তাতেই চাষবাস করে। সামান্য কিছু ভাগেও করে। দাদাদের অংশও চাষ করে লোখা। উঁচু নদী বাঁধের ধারে লঙ্কা,উচ্ছার চরার তলা ফেলে ঢোলের সকলে। বর্ষার পরে কালসাবায় কুমড়া লঙ্কা উচ্ছা শশা চাষ হবে। বিলের জল মরতে মরতে চাষের ফসলও ফুরিয়ে আসবে। এই মরসুমে বেশিরভাগ মেয়েমদ্দ মাঠেই থাকে। বাঁক ঘাড়ে নিয়ে মাটির কলসি ভরে চারার মাদায় জল দিতে হয়। তারপর সব্জি ফলতে শুরু করলে আরেক খাটুনি। লঙ্কা তোলা হয় বিকেলে। শশা উচ্ছা ভোরে তুলে হাটকে ছুটতে হয়। বাবুর হাট,কলোড়া,টালিভাটার হাট গেলে একটু বেশি দাম পাওয়া যায়। সাইকেলের পিছনে ঝাঁকা বেঁধে অনেকেই কাকভোরে রওনা দেয়। তবে ইদানীং সামনাসামনি আড়ত বসতে শুরু করেছে। চাষের সময় আরো এক উটকা ঝামেলা থাকে। 
ঢোলের ভগলা একটা পাঁড় মাতাল। দিনরাত মালেই ডুবে থাকে। এদিকে সেদিকে পড়ে থাকে। বেটা বউ ওই জ্বালায় সেভাবে দেখে না ভগলাকে।সব্জির সিজিনে ভগলার একটাই কাজ, রাতে যার তার জমি থেকে আনাজ তুলে সকালে হাটে বিক্রি করে দেওয়া। আর যেটুকু টাকা পেল তাতে মাল খাওয়া। অনেকবার হাতে নাতে ধরাও পড়েছে সে। মারধোর খেয়েছে রীতিমতো বহুবার।  কিন্তু শুধরায়নি কিছুতেই। ভগলার জ্বালায় অনেকেই রাতে জমিতে চক্কর দিয়ে আসে মাঝেমধ্যে। লোখা এদিক থেকে কিছুটা নিশ্চিন্তই থাকে। ভগলা একমাত্র লোখার কথা শুনে। তার কারণও আছে যথেষ্ট। অন্যদের মতো লোখা ভগলাকে দূর্ দূর্ করে না। দু'পাঁচ টাকা নিজে থেকেই ভগলার হাতে গুঁজে দেয়। লোখার বড্ড মায়া ভগলার উপরে। খগেন মাস্টারকে লোখা আগে প্রায়শই বলত,
— মাস্টার এত তত লোককে তুমি ভালমন্দ বুজাওঠ,ভগলাকেও ত একটু বুজাতে পার। ছেনাটা মাল ত খায়ঠে তার উবরে চুরিচামারি করেঠে। কবে কে মেরে দিবে রাগের তালে।
— কেনে তোর ত স্যাঙাৎ।  খুব ত পীরিত অর সঙে। থাইলে তুইও ত বুজাতে পারু অকে।
—- তুমি কর মনে কর বুজাইনি। বেদাশালা বেগদাচদা। মাল খেয়ে মাথাটা অর কেলি গেছে। এক কান দিয়ে সঁদায় ত আরেকটা দিয়ে বেরি যাই।
— থাইলে মোর কথা যে শুনবে তার গেরান্টি আছে!
— তুমি মেস্টার লোক, তমার কথায় অনেক জোর আছে। মোর কথাকে উ তেমন কেটায় নি। আসলে কি জান মেস্টার, জাতে বাগদি তার উবরে মোদা মাতাল,তার উবরে যেদি কেউ চোর বলে সেটা খুম গায়ে লাগে। যত হোক জাত ভাই ত। বাজারের লোগ ছেনাটাকে লিয়ে যাইতাই বলে। শুনতে ভালো লাগেনি। তাই বোলছিলম আর কি…।
—- ভগলাকে এখন দেকচু তাতেই তোর এত কষ্ট। থাইলে আগে মোদের জাতের কত লোক চুরি ডাকাতি করে সংসার চালাত জানু? সুদু মোদের জাতের লোক বলিঠি কেনে বাসুন সদগোপ মাহিষ্য জাতের বড়বড় ডাকাত ছিল। আরো শুনবি? আগে জমিদাররা ডাকাতের দল করে রাকত। তারা চুরি করতে পাঠাত।
—- ইসব কি বলঠ গো মেস্টার!
— তাবাদে একটু ভেবে দেক,ডাকাতির জিনিসপাতি কিনত কারা? কাদের দিকে বিক্রি কল্লে কেউ জানতে পারত নি? সেই সময় কাদের কিনার সামর্থ্য ছিল? অনেক বড়লোক  জমিদারদের সঙে ডাকাতদের সাটা থাকত।
—- লোকে বলে শুনি কেউ চুরি করে অভাবে আবার কেউ করে স্বভাবে। মোদের জাতের লোকেরা নিশ্চই অভাবেই কত্ত তখন। ভগলার মত হেনেছ্যারা ছিঁচকামি কোত্ত নি?
— চুরি ডাকাতির কথা বল্লে ত অনেক কথা রে। জমিদারের আমলে জমিদারদের যেমন পোষ্য ডাকাত দল থাকত। তেমনি মোদের দেশ যখন পরাধীন তখন বোলত স্বদেশী ডাকাত। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্নে টাকাপয়সা ত লাগত। অত টাকা এসবে কুথা থিকে। উংরেজদের চামচাগিরি করা জমিদার বড়লোকদের ঘর লুট করে আনত ডাকাতদল।
—- থাইলে উটাকে কখনোই খারাব বোলতে পারা যাবে নি। শালারা টাকাও দিবেনি,তার উবরে চামচাগিরি করবে,অদের লুট কোরবেনি ত কাদের কোরবে। অকে আমি একশ পারসেন সমর্থন করি। কিন্তু তাবাদে বামুন সদগোপদের ডাকাতির কথা কি বোলছিলে,সেটা আগে বল দিখি।
—-মোদের ঘাটাল চন্দকোনা এলাকায় এককালে নামকরা সব ডাকাত ছিল। তাদের ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপত সকলে। তারা নাকি চিঠি দিয়ে জানিয়ে চুরি কত্তে যেত। ব্যাঙরালের নামকরা ডাকাত ছিল নাকি যাদব মিশ্র। চন্দকোনার মতি ডাকাত,সাগর ডাকাত। এরা সবাই মোদের জাতের লোক
— অরেব্বাস! বাগদি নাইলে ডাকাত, বুজলম। কিন্তুবেমনা ডাকাত। বামুন ঠাকুদের আতব চাল খাওয়া ত শরীল। তাতেই এত সাহস।
—- কেনে তুই ত বইয়ে পোড়েছিলু বঙ্কিম চন্দ্রের ভবানী পাঠকের গল্প। সেও ত বামুন ছিল।
— সেটা বইয়ের গল্প। কিন্তু ই যে বলঠ এগবারে মোদের ঘরের পাশের ডাকাতদের নাম। শুনিঠি আর তাজ্জব হয়ে যাইঠি। তারপরে বল!
—-চাঁদুরের অটল রায়ের নাম শুনুনু?  তখনকার আমলের নামকরা ডাকাত। সে ত জাতে ছিল নাকি চাষা। অটল রায়ের নামে দূরদূরান্তের জসিদররা আতঙ্কে বেঁোপে উঠত। বিশাল তার ডাকাত বাহিনী ছিল। রণপা চড়ে চোখের নিমিষে অদৃশ্য যেতে পারত সে। লাঠি খেলায় নাকি অস্তাদ ছিল। বোম বাঁধতে পাত্ত। শুনেচি লাঠির ডগে ভর দিয়ে লাফিয়ে দশফুট বারফুট পাচিরের দেয়াল টপকিয়ে ঢুকে পড়তে পারত। অনেক সময় অটল রায় নাকি চিঠি দিয়ে জানি দিত যে,উমুক দিন তোদের ঘরে চুরি ক্তে যাব। ভয়ে তারা ডাকাত এসার আগেই সোনাদানা বাসনকোসন ঘরের বাইরে রেখে দিত অটল রায়ের দলের জন্নে।
— ই ত শুনাওঠ বামুন আর চাষা ডাকাতের গল্প। কিন্তু মোদের জাতের ডাকাতদের কথা বল দিখি শুনি।
— কেশপুরের দিকে মধুপুর গ্রামের দু'ভাই ডাকাতি কোত্ত। তার নাম তুইও শুনেচু বোদ হয়। অনা দিগার বড় ভাই আর মনা দিগার ছোট ভাই। মোদের জাতের লোক তারা। অনেকে বলে অরা নাকি অটল রায়ের কাছ থিকেই শিকেছিল। রগা ছিপছিপা চেহারার অনা। মাথায় গুয়াথুবি চুল। চোক সবসময় লাল ঘরঘট্টা থাকত। তার ভয়ে অনেকের গলা নাকি শুকি যেত। ছোট ছেনাদের তার নাম বলে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াত। 
অনা ডাকাত বাস্তুয়ে ডাকাতকালীর মন্দির পোতিষ্টা করে। সেখিনে পুজা করে নাকি চুরি কত্তে বেরাত দুভাইয়ে। এগবার চুরি করে ফিরবার সময় লোকজন পিছু ধাওয়া করে। অদের দল বোম চাজ্ কত্তে কত্তে পিছি এসতে থাকে।  কিন্তু জোরে পালানোর সময় রাতে বুজতে না পেরে পানা পুকুরে পড়ে যায় ছোটভাই মনা দিগার। ব্যাস,বাগে পেয়ে তিনচার খেনা গেরামের লোক পুকুরেই বাড্ডি বাড্ডি তাকে মেরে দেয়। অনা দিগার পরে ডাকাতি ছেড়ে পাটিয়ে ডুকে। তখন কেশপুরে লাল পার্টির রমরমা। তাদের দলে হমড়াচমড়া নেতা হই যায় অনা দিগার। কিন্তু শেষে দিকে যখন সেই কেশপুরে খুম পার্টিয়ে পার্টিয়ে মারপিট হচ্চে সেই সময়ে একদিন অনা দিগারকে ঘিরে ফেলে। বাসে করে মেদনীপুর যাচ্ছিল সে। সেই বাস থিকে টেনে নামিয়ে তাকে সেখিনেই বহু লোকজন মিলে মেরে দেয়। দুচারদিন পর তার বডি পেইছিল ঘরের লোকরা।
—-অই ঘটনাটা শুনেছিল বোদায় কারো মুখে। আসলে ডাকাতির পাপের ফল ত ভোগ কত্তে হবে বল মেস্টার।
—- তবে জেনে রাক অনা দিগার ডাকাতির জন্য সেদিন মরেনি। মরেচে রাজনীতির লড়াইয়ের জন্ন। কিন্তু মানুষটা যেমন ডাকাতি করে এনেচে বড়লোকদের ঘর থিকে তেমনি কত মেইছেনার যে বিয়া দিয়েচে তার ঠিক নাই। অনেক গরীব-দুঃখীদের  দুহাত ভরে সাহায্য করেচে, যখনই শুনেচে।
🍂

—- বল কি গো মেস্টার! লোকটার থাইলে মনও ছিল বোলতে হবে!
— সব চোর ডাকাতকে অনেকের সাথে গুৰি ফেলিসিনি। দুজনেই ত পড়েছিলম ভবানী ডাকাতের গল্প,দেবী চৌধুরানীর গল্প। তারাও ত ডাকাত ছিল নাকি। তবে জানু,ভেবে দেকেছি মোদের জাতের যারা ডাকাতি কোত্ত তাদের অনেকেরই পেটের দায় ছিল। তার উবরে অনেকেই বাবু লোকদের পরোচনায় ডাকাতি কোত্ত।
— লোকে উসকালেই ডাকাতি কোত্তে হবে! ইটা তোমার মানতে পাল্লম নি মেস্টার।
—- জানু কি তুই পরের ঘাড়ে বোন্দুক রেখে শিকার কাকে বলে? বোড়োলোকেরা নিজেদের মধ্য কুঁদুল কোত্ত আর রাগের ঝাল মিটাতে মোদের জাতের ওইসব দলের লোকদের লেলি দিত। চুরিডাকাতির মাল ওই বোড়োলোকরাই ঝাপসি লিয়ে হাত ঝাড়াপুঁছা করে টুকিটাকি ফিকে দিত। সেইকারণে দেখবি বহু ডাকাতের বংশধররা আজও ব আছে। কিন্তু তাদের দৈন্যদশা দেকলে চোখে জল এসবে। 
— সেটা তুমি ঠিকই বোলেচ মেস্টার। মোর বাপের মুখে শুনেছিলম কালু ডাকাতের কথা। কালু ঘাঁটির ঘর সীতা কুন্ডুয়ে। তার ছেনারা ত দেখি এখন খেতে পাইনি। কালু ঘাঁটিও শেষ বয়সে পেরালাইসিসে পড়ে গুমুত ঘেঁটে মোল্ল।
—তোকে আরো পমান দুব দেকবি। চাঁদপুরের যে চাঁদদিঘি,তার পাড়ে মোদের জাতের বাস। ওই গেরামের সেনেদের যে কালীঠাকুর,সেই মা ত ডাকাতকালী। সেনেরা মানতে চাইবেনি কিছুতে।  কারণ তাতে পেস্টিজ চলে যাবে।  কিন্তু তুই শুনে রাক,আজও দিঘির পাড়ের  মোদের জাতের দোলইরা আখ চুরি করে এনে দিলে সেই আখে মায়ের চক্ষুদান হয়। ইবার বল দিখি কেন দোলইদের দিকে  আখ চুরি করে এনে দিতে হয়? একটু মাথা খাটালেই বুজতে পারবি।
—- বুজতে পেরেচি মেস্টার। কাদের দোষ কাদের ঘাড়ে উঠে গেছে। শালা জাতটা চিরদিন মেড়াই রয়ে গেল।
– সেই জন্নেই ত যে ডাকাত রনপায়ে দৌড়েছে ঘোড়ার মতো,যার লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে গেছে শয়ে শয়ে যাদের ভয়ে কেঁপে গেছে রাজাজমিদার তারাই কিনা মাথা নুইয়ে থেকে গেল চিরকাল। গায়ের জোরে নয় বুদ্ধির জোরে সমাজকে কাবু কত্তে হয় সেটা বুজলোনি জাতটা কুনুদিন। আরভগলার মতো চোরকে মেরে ধরে কি লাভ বল দিখি। করে ত দুচার কেজি আনাজ চুরি। উ ত একটা মোদো মাতাল। আর যারা লেখাপড়া জানা নেতা ছাতা হয়ে লাখ লাখ চুরি করেঠে তাদের জিয়ে ধর দেখি,দেখব কত বিচির জোর তোদের।
খগেন মাস্টারের মুখে শেষের জোরালো কথাগুলো শুনে কিছুটা থতমত খেয়ে যায় লোকা। আর কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে মাস্টারের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

Post a Comment

0 Comments