ভূতেদের চালাকি
মিলি ঘোষ
প্রতিবছর অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন রুমিকে ভূতে ধরে। বাবা, মা সব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রুমি মাথার চুলগুলো সামনে দিয়ে বসে থাকে। আর চুলের ফাঁক দিয়ে সব দেখে। সঙ্গে একটা লাঠি রাখে। সেটা এদিক ওদিক ঘোরাতে থাকে। আর মাঝেমাঝে বলে, যে আমার সামনে আসবি লাঠির বাড়ি খাবি। রাজু একবার সাহস করে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছিল দিদির ঘরে। দেখে দিদি মোবাইল ঘাটছে। চুলের ফাঁক দিয়ে রাজুকে দেখতে পেয়েই লাঠি নিয়ে তেড়ে এল। কোনওরকমে প্রাণ হাতে করে বাইরে পালিয়ে এল রাজু। বাইরে থেকেও শুনতে শুনতে পেল দিদি বলে যাচ্ছে, "আজ তোর ঘাড় মটকাবোই। একবার ঢুকে দেখ, কী করি।"
রাজুকে তীর বেগে ছুটে আসতে দেখে মা'ও তড়িঘড়ি রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
রাজু কিছু বলার আগেই বললেন, "ঢুকেছিলি কেন দিদির ঘরে ? এই সময়ে একদম যাবি না। মেরে টেরে দিলে আর এক বিপদ।"
"দরজা ভেতর থেকে আটকায়নি দেখে একবার ঢুকেছিলাম। কী করে দিদি, সারাদিন চুল সামনে দিয়ে বসে ?"
"ওসব জেনে তোর কাজ নেই। সন্ধে হয়ে গেল। যা পড়তে বস গিয়ে। কাল ইতিহাস পরীক্ষা না ?"
"দিদিরও তো কাল অঙ্ক পরীক্ষা।"
মা তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে ছেলের মুখ চেপে ধরলেন।
এদিক ওদিক তাকিয়ে গলার স্বর একদম নামিয়ে বললেন, "ভর সন্ধেবেলা এসব কথা বলতে নেই।"
রাজু পড়তে বসে গেলে মা রুমির ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে জোর হাত করে প্রণাম করলেন। প্রণাম করছেন আর বিড়বিড় করছেন। সম্রাট আকবরের জীবনপঞ্জি সামনে খুলেও কান ছিল রাজুর মায়ের মুখ নাড়ার দিকে। কিন্তু মা ছিলেন আরও সচেতন। কোনও শব্দই রাজুর কান পর্যন্ত পৌঁছল না। তবে কানের সঙ্গে রাজুর চোখটাও খোলা থাকে। কারণ, এই দিন দিদিকে মা বেশ ভালো ভালো খাবার দেন। সকালে রাজু দেখেছে, দিদির জন্য গোটা পাঁচেক ফুলকো লুচি, বাটিতে তরকারি আর দুটো বড়ো বড়ো সন্দেশ গেছে। মা দিদির ঘরের দরজা আলতো করে খুলে হাত বাড়িয়ে খাবারের থালা রেখে আবার দরজা বন্ধ করে দেন। এক দিক থেকে ভালো। দিদির দৌলতে আজ বাড়িতে লুচি হলো। কিন্তু রাজুর প্লেটে মিষ্টি ছিল না। একটু দুঃখ হলেও মেনে নিয়েছে রাজু। লুচি তরকারিই বা মন্দ কী!
🍂
তাই রাজু এমন জায়গায় বসে যেখান থেকে কোনাকুনি রান্না ঘরের দরজা দেখা যায়। মানে, রান্না ঘরের দরজা, রুমির ঘর আর রাজুর পড়তে বসার জায়গা একটা সমকোণী ত্রিভুজের তিনটি কৌনিক বিন্দু। রান্না ঘরের দরজা থেকে রাজুর বসার জায়গাটিকে যে সরল রেখা যুক্ত করেছে, সেটি হলো সমকোণী ত্রিভুজটির অতিভুজ। ওখান থেকে নজরদারি সহজ। কিন্তু একটা ব্যপার রাজু বুঝে উঠতে পারে না, প্রতিবার অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিনই কেন দিদিকে ভূতে ধরে। এবারে ঠিক ওই দিনই পড়ল রাজুর ইতিহাস পরীক্ষা। এই ইতিহাস নিয়ে রাজুর যত সমস্যা। বংশের পর বংশ, সালের পর সাল। কে অত মনে রাখবে ? কার সঙ্গে কার যুদ্ধ হলো, তা দিয়ে রাজুর কী! রাজু ঠিক করেই রেখেছে, বাছা বাছা কয়েকটা জায়গা পড়ে যাবে। তাতে কমন পেলে ভালো। না হলে যা মনে আসে লিখে খাতা জমা দিয়ে চলে আসবে। ইতিহাসে ফেল করলে ক্লাসে ওঠা আটকায় না। কিন্তু অঙ্কের কথা আলাদা। দিদি তাহলে ওই কারণেই প্রতিবার একই নাটক করে যাচ্ছে।
পরদিন বিকেল বেলায় রুমি ভূত থেকে আবার মানুষ হয়ে গেল। তখন 'ভাই ... ভাই' করে একেবারে গেল। অথচ এই দু'দিন ভাইকে দেখলেই লাঠি নিয়ে তাড়া করছিল রুমি।
আগের বার জিজ্ঞাসা করেছিল রাজু, রুমিকে, "এই দু'দিন তোর কী হয় ? আমাকে চিনতেই পারিস না। দেখলেই তাড়া করিস।"
রুমি তখন স্বঘোষিত স্বাভাবিক। ভাইয়ের কথা শুনে একদম আকাশ থেকে পড়ল।
"আমি ? আমি তোকে তাড়া করি ? মাথা খারাপ না কি তোর ?"
তা ঠিক। মাথা তো রাজুরই খারাপ। কারণ, বাবা-মা দু'জনেই দিদিকে সমর্থন করছেন।
রাজুর মনে ঘনীভূত হতে থাকা রহস্য এখন উদ্ঘাটনের পথেই। দিদির কর্মকাণ্ড ওর গা সওয়া হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ।
কিন্তু নিজে অঙ্ক পরীক্ষা না দিয়ে উল্টে রাজুকেই যখন রুমি জিজ্ঞাসা করল, "কী রে, পরীক্ষা কেমন দিলি ? পাশ করবি তো সব বিষয়ে ?"
রাজুর মেজাজ গেল খারাপ হয়ে।
গলা তুলেই বলল, "কেন করব না ? আমি তো আর তোর মতো নাটক করি না।"
ব্যাস। আর যায় কোথায়। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করল রুমি।
"আমি নাটক করি! কী বলতে চাস তুই ?"
রাজু জানে, দিদি বড়ো তাই পার পেয়ে যাবে। হলোও তাই। কিন্তু দিদির প্ল্যান বানচাল করার জন্য ও উঠে পড়ে লাগল।
ইতিমধ্যে এলো একটি সুখবর। রুমির স্কুলের বড়দি ওর বাবার পরিচিত। বাবার সহকর্মীর স্ত্রী তিনি। সেই সূত্রে মা'র সঙ্গেও সম্পর্ক খুবই ভালো। তাই অঙ্ক পরীক্ষা না দিলেও এতদিন কিছু বলেননি তিনি। আর রুমি অঙ্ক বাদে বাকি সব বিষয়ে ভালোর দিকেই। তবে সন্দেহ বড়দির আগেই হয়েছিল। তাই এবছর তিনি শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন, এবারে রুমির ক্লাস এইট। এখন অঙ্ক পরীক্ষা না দিলে তিনি ক্লাসে তুলতে পারবেন না। সেই থেকে চিন্তার শেষ নেই রুমির। আবার চেষ্টারও শেষ নেই। নতুন কী উপায়ে অঙ্ক পরীক্ষাটা আটকানো যায়।
বাবাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার বড়দির বাড়ি পাঠিয়েছে রুমি। ছাত্রীর বাবার আগমনের হেতু বুঝতে অসুবিধা হয়নি প্রধান শিক্ষিকার।
সুশান্তবাবু বিশেষ ভূমিকা না করে সরাসরি প্রসঙ্গে গেলেন।
"কী করি বলুন তো ম্যাডাম ? আবার যদি অঙ্ক পরীক্ষার দিনই রুমির ঘাড়ে ভূত চাপে ?"
প্রধান শিক্ষিকা তৎক্ষণাৎ বললেন, "আমারও সেটাই প্রশ্ন, ঠিক অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিনই কেন এরকম বারবার হচ্ছে। পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে।"
"না, না। অঙ্কে ওর ভয় নেই। মাথা খুব পরিষ্কার মেয়ের।"
"হ্যাঁ, মাথা তো খুবই পরিষ্কার। বুঝতেই পারছি।"
সুশান্তবাবু শান্ত প্রকৃতির মানুষ। সহজ সরল বলেই লোকে জানে। তাই বলে বড়দির খোঁচাটা বুঝবেন না, তা তো নয়।
গলার স্বর নামিয়ে বললেন, "এ আমাদের পরিবারের বৈশিষ্ট্য। বংশ পরম্পরায় হয়ে আসছে। আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না ম্যাডাম। আমার পিসিরও হতো। তাঁর বিয়ের পর কাকাকে ভূতে ভর করত। কাকা কিছুটা পড়াশুনা করলেও, পিসি তো কিছুই করেনি। এর কী ব্যাখ্যা আছে বলুন তো ম্যাডাম।"
বড়দি বললেন, "একজন হেড মিস্ট্রেস হিসেবে আমাকে তো কিছু রুল মেইনটেইন করতেই হয়। রুমিকে আপনি ডাক্তার দেখান। আর অঙ্কের জন্য আলাদা করে কেয়ার নিন।"
সুশান্তবাবু পড়লেন মহা বিপদে। একদিকে পরিবারের সম্মান। ভূতে পাওয়া পরিবারের সমাজে বাড়তি খাতির থাকে। অন্যদিকে প্রধান শিক্ষিকার ফতোয়া জারি। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করলেন।
মেয়েকেও ডেকে বললেন, "এবার থেকে অঙ্ক পরীক্ষা না দিলে ক্লাসে তোলা হবে না। বড়জোর আলাদা ঘরে ব্যবস্থা করার অনুরোধ করতে পারি। কিন্তু পরীক্ষা দিতেই হবে।"
রুমির মনে হলো বাবা যদি পিঠে দু'ঘা কিল বসাত সেও ভালো ছিল।
এদিকে সম্পূর্ণ আলোচনা কান পেতে শুনল রাজু।
রুমির এখন ক্লাস এইট আর আর রাজুর সিক্স। এ বছর হাফ ইয়ারলি পরীক্ষাতে রুমির যেদিন অঙ্ক পরীক্ষা পড়ল, তার একদিন পরে রাজুর ইতিহাস পরীক্ষা। নিরুপায় রুমি অঙ্কের বই খাতা খুলে ঘষামাজার চেষ্টা শুরু করল। অদ্ভুত ব্যপার, এ বছর রুমিকে ভূতে ভর করল না। সবার মাঝে বসে পরীক্ষাও দিয়ে এল। পরীক্ষার খাতায় কী হিসেব নিকেশ করল, সে প্রসঙ্গ না আনাই ভালো। কিন্তু পরীক্ষার পরে বাড়ি ফিরে রুমি একেবারে তাজ্জব। রাজু ওর ঘরে ভূত সেজে লাঠি ঘোরাচ্ছে। দিদির মতো বড়ো চুল নেই বলে চুলগুলো সামনে দিতে পারেনি। যতটা পেরেছে এলোমেলো করেছে চুলটাকে। দরজার ফাঁক দিয়ে পুরো ব্যপারটা লক্ষ করে দাঁত কিড়মিড় করল রুমি। শুধু তাই নয় রাতের মেনুতে ভাইয়ের জন্য গেল ফ্রাইড রাইস আর একবাটি ভর্তি চিলি চিকেন। রুমিও তাই পেল। তবে চিকেনের পরিমাণ ভাইয়ের থেকে কম ছিল। বাবা মায়ের খুশি খুশি ভাবটাও দৃষ্টি এড়াল না রুমির। রাগে অপমানে পুরো খাবার না খেয়েই উঠে পড়ল রুমি। আশা ছিল, মা হয়তো ডাকবেন। কিন্তু মা সেভাবে কিছুই বললেন না।
থালার খাবার সরিয়ে নিয়ে একবার নিজের মনেই যেন বললেন, "ওমা! খেলি না পুরোটা।"
ওই সময়ে বাবা রান্না ঘরে ঢুকে মা'কে বলে গেলেন, "কাল দুধ দিতে এলে এক প্যাকেট বেশি দিতে বোলো। ছেলেটাকে সকালে এক গ্লাস দিও।"
রুমির রাগ গেল আরও বেড়ে। দুধ রুমির কোনোদিনই ভালো লাগে না। কিন্তু রাজুকে নিয়ে মা বাবার মাতামাতিটা অসহ্য লাগছিল। রাজুর ঘরের জানলায় একটা ফাঁক আছে। সেটা দিয়ে দেখে এসেছে রুমি, রাজু মোবাইল গেম খেলছে। তবু রাজুকে ঘাটাতে সাহস পেল না রুমি। ওর ঘরে পা দিলে কপালে লাঠির বাড়ি তো আছেই। আরও কত কী যে বলে বসবে রাজু তার ঠিক নেই। এখন বাবা মাও ওকেই সমর্থন করবেন।
পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোতে দেখা গেল, রুমি সব বিষয়েই সত্তর পঁচাত্তর করে পেয়েছে। শুধু ফিজিক্যাল সায়েন্সে পেয়েছে চল্লিশ আর অঙ্কে বারো। প্রধান শিক্ষিকা সুশান্তবাবুকে ডেকে পাঠালেন।
বললেন, "রুমির অঙ্কের জন্য আলাদা কেয়ার নিতে হবে। দেখবেন, পরের বার ও ভালোই করবে।"
কাকে বলছেন তিনি ? ছাত্রীর বাবার তো কোনও হেলদোল নেই। যত চিন্তা যেন স্কুলের বড়দিরই। মেয়ের ওই নম্বর দেখে এতটুকুও বিচলিত মনে হলো না সুশান্তবাবুকে।
বেশ হাসি মুখেই বললেন, "চিন্তা করবেন না, ম্যাডাম। আমাদের পরিবারে অমঙ্গল কিছু হতেই পারে না। রুমিকে ছেড়ে এখন আমার ছেলের ঘাড়ে ভূত চাপে। পরিবারের ঐতিহ্য বলে কথা!"
"পরিবারের ঐতিহ্য ?"
বড়দির হাঁ মুখটা বন্ধই হলো না।
"তবে আর বলছি কী। সে অনেক ইতিহাস। পরে একদিন সময় করে আপনার বাড়িতে গিয়ে বলব। শুনে গায় কাঁটা দেবে ম্যাডাম।"
প্রধান শিক্ষিকা হাত জোর করে বললেন, "আমার এখনই গায় কাঁটা দিচ্ছে। পুরো ইতিহাস শুনলে হয়তো অজ্ঞান হয়ে যেতে পারি। আপনাদের অগ্রগতি কে আটকায়!"
বড়দি হাতটা নমস্কারের ভঙ্গিতে জোর করে আছেন দেখে সুশান্তবাবু উঠে দাঁড়ালেন এবং এক মুখ হাসি নিয়েই বিদায় নিলেন।
সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪
0 Comments