বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী
নির্মল বর্মন
প্রাবন্ধিক কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছেন। কাজী সাহেব ধর্ম-সমাজ শিল্প-সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে বহু উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ লিখে দুই বঙ্গে ও আন্তর্জাতিক বাজারে সুনাম অর্জন করেছেন।প্রাবন্ধিক মোতাহার হোসেনের পৈতৃক নিবাস ফরিদপুর । কিন্তু জন্ম কুষ্ঠিয়ার লক্ষ্মীপুরে মামালয়। ১৯১৯-সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স সহ বি.এ. পাশ এবং ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সাফল্যের সঙ্গে লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিত শাস্ত্রে এম.এ. করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পি এইচ.ডি লাভ করেন । কাজী মোতাহার হোসেন সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন ও পরে এমেরিটাস প্রফেসার হিসেবে সুযশের অধিকারী।
প্রাবন্ধিক কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী মহোদয় একাধিক নামে পত্রিকার পাতায় লেখালেখি করতেন। পিতৃদত্ত নাম সৈয়দ মোতাহের হোসেন চৌধুরী।
প্রাবন্ধিক কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব। কাজী মোতাহার ও কাজী আবদুল ওদুদ মিলেমিশে মুসলিম সাহিত্য সমাজ' প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়েছিলেন। ১৯২৭-শিখা' পত্রিকার সম্পাদনার কাজেও কাজী সাহেব ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৬ সাল।"বাংলা একাডেমি পুরস্কার" এ ভূষিত হলেন। কাজী সাহেব ১৯৭৫-এ জাতীয় শিক্ষক হন এবং বিশ্ববাসীর মন জয় করেন।
সাহিত্যিক মোতাহার হোসেন চৌধুরী রচিত গ্রন্থগুলি হল :- ' নজরুল কাব্য পরিচিতি, ‘সেই পথ লক্ষ্য করে', 'সিম্পোজিয়াম', ‘গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস', 'আলোকবিজ্ঞান' ইত্যাদি।
প্রাবন্ধিক গবেষক মোতাহার সাহেব র 'মূল্যবোধ ও যুক্তি বিচার' প্রবন্ধ বিষয়টি 'সংস্কৃতি-কথা' (১৯৬৭) গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য রচনা।
প্রবন্ধটির উল্লেখযোগ্য দিক হল :
১.এথেন্স, ইটালি, ফরাসি দেশের সভ্যতাকে দুভাগে ভাগ করেছেন—
মূল্যবোধ এবং যুক্তিবিচারের প্রভুত্ব। মূল্যবোধ বলতে বুঝিয়েছেন:-
“নিকটবর্তী স্থুল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সূক্ষ্ম সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে আনন্দপদ সুকুমার বিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ জানা এবং তাদের জন্য প্রতীক্ষা ও ক্ষতি স্বীকার করতে শেখা।” অন্যদিকে যুক্তিবিচারের প্রভুত্ব হল 'জীবনের সকল ব্যাপারকে বিচারবুদ্ধির কষ্টি পাথরে যাচাই করে নেবার প্রবণতা"।
২. প্রাবন্ধিক মোতাহার সভ্যতা ও বর্বরতার পার্থক্য যুক্তিনিষ্ঠ ভাবে করেছেন -
“সংকীর্ণবুদ্ধি তথা যুক্তি-তর্ক নয়, উদারবুদ্ধি তথা যুক্তিবিচার সভ্যতা, আর তার অভাবই বর্বরতা। তাই বুদ্ধিকে নিজের কাজে না লাগিয়ে নিজেকে বুদ্ধির কাজে লাগান দরকার। নইলে বুদ্ধির শুভ্রতা নষ্ট হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেরও অবনতি ঘটে। প্রয়োগভেদে বুদ্ধির মূল্যভেদ হয়ে থাকে। একই বুদ্ধি সৌন্দর্য, প্রেম, আনন্দ ইত্যাদি সুকুমার বৃত্তির সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করে মনীষার উচ্চস্তরে উন্নীত হয়, আবার মদ মাৎসর্য, লোভ ইত্যাদি অসুন্দর বৃত্তির সংস্পর্শে এসে চালাকির নিম্নস্তরে নেমে আসে।”
৩.প্রাবন্ধিক চৌধুরীর ভাবনায় --
“বুদ্ধির সংস্কার মানে মূল্যবোধ সম্বন্ধে সচেতনতা, আর সৌন্দর্য, আনন্দ, প্রেম প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তির সংস্পর্শে এসেই মূল্যবোধের উন্মেষ হয়।” (ঘ) “মূল্যবোধ ও যুক্তিবিচারের প্রভুত্ব সামাজিক নিরাপত্তার উপর নির্ভরশীল। নিরাপত্তার অভাবহেতু অসভ্যদের ভেবে চিন্তে চলার সময় নেই। ... যেখানে নিরাপত্তা নেই সেখানে মূল্যবোধ ও বিচারশীলতা নেই, আর মূল্যবোধ ও বিচারশীলতার অভাব মানে সুসভ্যতার অভাব।”
৪. সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন যথার্থ সভ্যতার মূল্যায়ন করেছেন এভাবে --
“যা দিয়ে বাঁচা যায় তা সভ্যতা নয়, যার জন্য বাঁচা হয়, তা-ই সভ্যতা। তাই ভাত-কাপড়ের জোগাড়কে সভ্যতা না বলে সৌন্দর্য ও আনন্দের আয়োজনকেই সভ্যতা বলা সঙ্গত।”
৫. প্রাবন্ধিক ও সমাজমনস্ক গবেষক মোতাহার আনন্দ ও আরাম যে পৃথক জিনিস তারও সঠিক ব্যাখ্যা করেছেন । উদাহরণ-
“আনন্দ মানসিক ব্যাপার, আরাম শারীরিক । ... আনন্দ একান্তভাবেই বস্তুনির্ভর নয়, আরাম একান্তভাবে বস্তুনির্ভর। আর বস্তুর জন্যই যুদ্ধ। তাই পৃথিবীকে যুদ্ধমুক্ত করতে হলে আরামের চেয়ে আনন্দ তথা শরীরের চেয়ে মনকে বড়ো করে তোলা দরকার। নইলে যুদ্ধ বিরতির সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। দৃষ্টিভঙ্গিই ইষ্টানিষ্টের মূল।”
🍂
৬.সাহিত্যিক মশাই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে যে সমাজের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে তা জানিয়েছেন --
"মূল্যবোধের অভাবের দরুন আমরা আসলকে নকল, নকলকে আসল, লক্ষ্যকে উপায়, উপায়কে লক্ষ্য মনে করছি। তাতে আমাদের বিশেষ ক্ষতি হচ্ছে। কোন জিনিসের উপর কোন জিনিস স্থাপিত হওয়া দরকার, কোনটা জীবনের পাদপীঠ, কোনটা শিরোপা, তা বুঝতে পারা যাচ্ছে না বলে জীবনকে শিল্পের মতো ধাপে ধাপে সাজিয়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অন্নবস্ত্রের আয়োজন আনন্দ-উপভোগের উপায় না হয়ে আনন্দ উপভোগই অন্নবস্ত্র উপার্জনের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
৭. প্রাবন্ধিক মানব সম্পদ ও সামাজিক মন যে বৈশাদৃশ্য তা উল্লেখ করে জানিয়েছেন --
"ধন আর মন একসঙ্গে যায় না। ধনকে যে চেয়েছে মনকে সে পর করেছে, আর মনকে যে কামনা করে ধন তার দিকে ফিরেও তাকায়নি-এ তো সচরাচরই দেখতে পাওয়া যায়। তাই লক্ষ্মীর ধনভান্ডারকে সমভাবে বেঁটে দেওয়ার উদ্যম সত্যই প্রশংসনীয়। অতিভোগ ও ভোগহীনতার পাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়া; এই একমাত্র পথ। কিন্তু তা করতে হবে সরস্বতীর প্রতি দৃষ্টি রেখে লক্ষ্মীর দিকে নজর রেখে নয়। ধনসাম্যের উদ্দেশ্য হোক সর্বজনীন সরস্বতী পূজা; তবেই তা মানুষের সাত্যকার মুক্তির বাহন হতে পারবে। বলাবাহুল্য লক্ষ্মী মানে কল্যাণ, আর সরস্বতী মানে সৌন্দর্য। "
৮. বাংলাদেশে গঠন রাষ্ট্র পরিকল্পনায় যে গলদ ছিল, তার মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন --
"মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের দিকে নজর রেখেই রাষ্ট্র গড়ে তোলা দরকার, নইলে শেষ পর্যন্ত তা মানুষের মুক্তির উপায় না হয়ে বন্ধনের রজ্জু হয়ে দাঁড়ায়। মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রের পুতুল পূজার জন্য মানুষের জন্ম হয়নি, মানুষের বিকাশের জন্যই রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে।”
সাহিত্যিক প্রবন্ধের সমাপ্তি ভাবনায় জানিয়েছেন--
“জীবনমান নয়, মূল্যবোধেও যুক্তিবিচারই জীবনসমৃদ্ধির পরিমাপক।”
প্রাবন্ধিক কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর "সংস্কৃতি কথা" বইটির উপান্তের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য ---
-"--------যারা সংস্কৃতিবান তাঁদের জীবনে বাইরের কোন আদেশ নিষেধের প্রয়োজন হয় না । তাঁরা আদেশপন্থী নন--অনুপ্রেরণাপন্থী!---- সংস্কৃতি, শিক্ষিত, মার্জিত মানুষের ধর্ম , শিক্ষিত মানুষের প্রেম , সৌন্দর্য ও আনন্দের পূজারী যা তারা গ্রহণ করে সংস্কৃতি থেকে"!
অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী'র তথ্যনিষ্ট যুক্তিবোধ ও ন্যায়শাস্ত্রে পন্ডিতপ্রবর সংস্কারমুক্ত মন প্রবন্ধের স্বাদ ও অনুভূতিকে বৃদ্ধি করেছে।গানিতিক সিড়িভাঙা অঙ্কের মতো যুক্তির সত্যতা বিস্তার করে সার্থক লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন । প্রকৃষ্ট বন্ধনে মোড়া গদ্যরীতির প্রাঞ্জলতা ও স্বচ্ছতা বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিকের প্রকাশভঙ্গিকে আবিষ্ট করেছে স্বাদুতা।
0 Comments