জ্বলদর্চি

সুধীর মাইতি (ভাস্কর্য শিল্পী, নারায়ণগড়) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৭৮
সুধীর মাইতি (ভাস্কর্য শিল্পী, নারায়ণগড়) 

ভাস্করব্রত পতি

স্কুলে যেতে চাইতেন না। সবসময় মন উড়ু উড়ু। বাড়ির কাজ আর বাঁশবন আমবনে সময় কাটাতেন। নিজেকে ভাবতেন সেই বনজঙ্গলের আড়ালে এক বন্য মানুষ। গাছে উঠে বসে থাকতেন। নানা ধরনের পোকামাকড়, শালিক, বনটিয়া, ফিঙে, চড়ুইদের নিয়ে তাঁর এক আশ্চর্য জগৎ। প্রাকৃতিক চিড়িয়াখানায় তিনি ছিলেন দেখভালের দায়িত্বে। কিন্তু বাড়ির লোকজন চাইতো ছেলে অন্ততঃ স্কুলে যাক। পড়াশোনা করুক। মানুষ হোক। এজন্য খেতে হত পিটুনি। মারধর খেয়ে বাবু গেলেন স্কুল। পাড়ার যুবক গনেশ প্রধানের হাত ধরে। পরনে ছেঁড়া জামা। ধুলো কাদা মাখা। স্লেটটাও ভাঙা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক এরকম হুলিয়ার ছেলেকে দেখেই চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলেন, "হ্যাঁ রে গনেশ, এই ক্যালেন্ডারটিকে কোথায় পেলি?"

সেসময় বাস্তবিকই তিনি ছিলেন আজব এক 'ক্যালেন্ডার'। তিনি হলেন বর্তমানের বিখ্যাত ভাস্কর্য শিল্পী সুধীর মাইতি। মেদিনীপুরের গর্ব। মেদিনীপুরের মানুষ রতন। ছোটবেলায় সারাক্ষণ কাদামাটি নিয়ে কারবার ছিল তাঁর। গড়তেন আর ভাঙতেন। সারা গায়ে ধুলো কাদা মাখা। তেল মেখে স্নান করার কোনো ঘটনা কখনও ঘটত না। ফলে সারা গায়ে খড়ি ফুটে যাওয়ার চিহ্ন। কালো চামড়ায় সাদা খসখসে রূপটান। এ এক অসামান্য রক্ত মাংসের স্লেট। কিন্তু কাহিনীর টুইস্ট এখানেই। 
অভাব অনটনের সংসার। মজুর খেটে দিন চলত। তারই মাঝে পড়াশোনা। খেলাধুলা করার সুযোগই জোটেনি কোনোদিন। কিন্তু একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ভগবান প্রদত্ত। মূর্তি গড়তে পছন্দ করতেন। হাতের কাছেই ছিল কাদার তাল। মাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই বানিয়ে ফেলতেন কিছু একটা। আর ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। অথচ ছিল না কোনো কাগজ কলম। তাতে কি? মাটির ঢেলা, কাঠ কয়লা, বেল বা লেবু গাছের কাঁটা ছিল তাঁর কলম। আর নিজের সেই খড়ি ফুটে যাওয়া খসখসে চামড়া ছিল তাঁর ছবি আঁকার কাগজ! স্লেট পাথরকেও হার মানাতো তাঁর সেই অদ্ভুত আদুল গা। নিজের দেহের বিভিন্ন অংশে প্রতিদিন আঁকতেন নানা ধরনের ছবি। বডি পেন্টিং করতেন নিজের খেয়ালে। হয়ে উঠেছিলেন 'জীবন্ত ক্যালেন্ডার'। 

১৯৬২ তে নারায়নগড়ের শালুকার বেনাডিহাতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রফুল্ল মাইতি ছিলেন ঘরামী। নিজের হাতে বানাতেন বাড়ির কাঠামো। চৌকাঠ, ধান্না, দরজা, জানালা বানানোর শৈল্পিক দক্ষতা ছিল তাঁর। বাবার সেই শিল্পসুষমা সমৃদ্ধ গুন পেয়েছিলেন তিনি। নতুন কিছু বানানোর দক্ষতা অর্জন করেছিলেন বাবার কাছ থেকেই। বাবাই হাত ধরে শিখিয়ে দিতেন মাটির মূর্তি বানানোর কারিকুরি। আজ তাঁর জীবনের উত্তরণ ঘটেছে। আর যাবতীয় উন্নয়নের কাণ্ডারি ছিলেন তাঁর বাবা। 
নারায়ণগড় হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভাস্কর্য নিয়ে ভর্তি হলেন স্নাতক স্তরে। নিজের গায়ের চামড়ায় ছবি এঁকে বড় হওয়া সেই 'ক্যালেন্ডার'টি হলেন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর হলেন। সেখানেও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করলেন। আর ফিরে তাকানোর অবসর নেই। নারায়ণগড় থেকে পাড়ি দিলেন কলকাতায়। সেখানেই এখন তাঁর কাজের ক্ষেত্রভূমি। 

জীবনের নানা সিঁড়িতে দেখেছেন চূড়ান্ত সামাজিক বঞ্চনা আর শোষণ। নিজের জীবনের পরতে পরতে লেপটে ছিল তা। যন্ত্রণার সেই ছবি তাই প্রতিবিম্বিত হয় তাঁর ভাস্কর্যে। কিন্তু তিনি শিল্পচর্চাকে একমুখী করতে রাজি নন। তাঁর মননে তাই যন্ত্রনার ছবির পাশাপাশি যন্ত্রনা নিরসনের ছবিও ঠাঁই পেয়েছে বারংবার। শোষণ শাসন আর বঞ্চনার প্রতিবাদে তাঁর কাজ লালিত হয়েছে পাথরে, সেরামিকে, ব্রোঞ্জে, টেরাকোটায়, কাঠে, মিক্সড মিডিয়া আর রং তুলির ছোঁয়ায়। 

একসময় খেলাচ্ছলে যে অজানা মুখাবয়ব বানিয়ে হাত পাঠিয়েছিলেন সেই পাকা হাতে আজ বানিয়েছেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মূ, চে গুয়েভারা, সুকুমার সেনগুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, জীবনানন্দ দাশ, হো চি মিন, ক্ষুদিরাম বসু, কার্ল মার্কস, শহীদ ভগৎ সিং, কাজী নজরুল ইসলাম, মহাত্মা গান্ধী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বাণীকুমারদের মূর্তি। কোনওটা আবক্ষ, আবার কোনওটা পূর্ণাবয়ব। 

শিল্পী সুধীর মাইতি জানান 'আমার কাজ সামাজিক ভাবে মর্যাদা পায় বোদ্ধা সমাজের কাছে'। স্বাধীনভাবে এবং সৎভাবে কাজ করে বেঁচে থাকতে চাই। ভাস্কর্যের মাধ্যমে আলোছায়ার মোহময় খেলা প্রতি মুহূর্তে আমোদিত করে আমাকে। তিনি বারংবার চেয়েছেন ভাস্কর্যের মাধ্যমে সামাজিক শোষণ বঞ্চনার প্রতিবাদ জানাতে। তাঁর বেশিরভাগ ভাস্কর্যের মধ্যে ফুটে ওঠে  ছোটবেলার অভাব, অনটন আর অনাড়ম্বর জীবনের কাঁচা স্মৃতি। খুব ছোট বেলায় কৃষ্ণ যাত্রা করেছেন। 'চন্দ্রাবতী'র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু ডায়লগ ভুল করায় মার খেয়ে আর ওপথ মাড়াননি। বেছে নিয়েছেন ভাস্কর্যের আঙিনা। লিখেছেন কবিতার বই 'কলকথা'। 
সুধীর মাইতির হাতে মহীরূহ বা বৃক্ষ হওয়ার স্বপ্ন লালিত হয়েছে 'দ্রুম বাসনা'তে। মা এবং সন্তানের ভালোবাসা নিয়ে পাথর কুঁদে কুঁদে বানিয়েছেন 'সৃজনিয়া'। যা তাঁকে আকাডেমি পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছে। বাগানের মালি বিষয় নিয়ে গড়েছেন 'পুষ্পলাবি'। এছাড়াও তাঁর হাতে প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে পুষ্প বিলাসিনী, আলিঙ্গন, উড়ুক্কু, গরবিনী, কুক্কুভ, মিথুনানুভব, প্রনয় বৃত্ত, স্বপ্নবিলাসী, রিক্ত জীবন, লাবণ্য তনু ইত্যাদি। দিল্লি ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় করেছেন নিজের কাজের একক প্রদর্শনী। প্রতিটি ক্ষেত্রে পেয়েছেন বোদ্ধা সমাজের অকুণ্ঠ ভালোবাসা আর একরাশ বিস্ময়। 

তিনি তাঁর কাজের সুবাদে পেয়েছেন নানা সম্মাননা। যা তাঁকে নিরন্তর উৎসাহিত করেছে আরও সৃজনশীল কাজের জন্য। ১৯৯৫ তে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (অ্যানুয়াল কনভোকেশন) থেকে পান নীরদ বরণ মেমোরিয়াল প্রাইজ। ১৯৯৮ তে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট আকাডেমি অফ ড্যান্স, ড্রামা, মিউজিক অ্যাণ্ড ভিসুয়াল আর্টস থেকে পান সম্মান। ২০০১ এ অ্যানুয়াল অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস এক্সিভিসন ফর দ্যা আকাডেমি অফ ফাইন আর্টস থেকে সম্মাননা পেয়েছেন। এই বছরেই ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টস থেকে দেওয়া হয় কে ডি ঘোষ মেমোরিয়াল প্রাইজ। ঐ বছরেই রাজ্য চারুকলা পর্ষদ থেকে পান সম্মান। ২০০৬ তে ফের অ্যানুয়াল অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস এক্সিভিসন ফর দ্যা আকাডেমি অফ ফাইন আর্টস থেকে সম্মানিত হন তাঁর অসাধারণ কাজের জন্য। পরের বছর আবারও সম্মাননা জ্ঞাপন করা হয় রাজ্য চারুকলা পর্ষদ থেকে। প্রায় ২২ টি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে দুবার রাজ্য চারুকলা পর্ষদের পুরস্কার, স্টেট আকাডেমি পুরস্কার, সিনিয়র আকাডেমি পুরস্কার ইত্যাদি। সম্প্রতি মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থা (বেলদা আঞ্চলিক কমিটি) থেকে পেয়েছেন সম্মান প্রশস্তি।

🍂

Post a Comment

0 Comments