জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের দেওয়াল চিত্র /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৯৭

জঙ্গলমহলের দেওয়াল চিত্র

সূর্যকান্ত মাহাতো


"শিল্প হচ্ছে শখ। যার সেই শখ ভিতর থেকে এল সেই পারে শিল্প সৃষ্টি করতে, ছবি আঁকতে, বাজনা বাজাতে, নাচতে, গাইতে, নাটক লিখতে যাই বলো।"---- অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

চিত্রকে কখনো কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়? বোধ হয়, না। আর সে চেষ্টা করাটাও খুব একটা ভালো বলে মনে করি না। কারণ চিত্র সৌন্দর্যকে চোখ দিয়ে দর্শন করাটাই একমাত্র শ্রেষ্ঠ পথ। তারপর হৃদয় দিয়ে সেই সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে পারাটাই হল আসল উপলব্ধি। এমন উপলব্ধির রস সঞ্চার ভাষার বর্ণনায় কখনো সৃষ্টি হয় না। তাই তো 'মোনালিসা'-র বর্ণনা পড়ে বা শোনার পরেও যখন সে ছবি আমরা চোখে দেখি, অবিসংবাদিতভাবেই আমাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে একটাই শব্দ, 'বাহ্!' 

জঙ্গলমহল জুড়ে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলো বাঁদনা ও সহরায় পরবের সময় যেন চিত্রপট বা ক্যানভাসে পরিণত হয়ে উঠে। শুধু তাই নয় দেওয়ালগুলো এমনভাবে চিত্র সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটায়, দেখলেই মনে হবে এ যেন এক চিত্র প্রদর্শনশালা। কোন দক্ষ শিল্পীর তুলির রঙে আঁকা। কিন্তু কোন দক্ষ শিল্পী নয়, প্রত্যন্ত গ্রামের একেবারে সাদামাটা অনামী নারীরাই সাধারণত এসব ছবির চিত্রকর হয়ে ওঠেন। পুরুষেরা যে ছবি আঁকেন না তা নয়। তবে নারীরাই প্রধান ভূমিকা পালন করেন। বিশিষ্ট লেখক 'তপন কর'ও সে কথাই বলেছেন, "দেওয়াল চিত্র এঁকে থাকেন সাধারণত গ্রামের মেয়েরাই।"(মাটির ঘরে দেওয়াল চিত্র /তপন কর) তারা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অদক্ষ হাতেই সে চিত্র ফুটিয়ে তুলে দেয়ালগুলোতে।

চিত্রশিল্পী হিসাবে তাদের হাতে সর্বদা ছবি আঁকার তুলি থাকে না। অনেক সময় একটা সরু কাঠিই ভরসা। কাঠির ডগাটা একটু ঠুঁকে নরম করে তুলির আকার বানানো হয়। কখনো সরু কাঠির উপর আবার এক টুকরো কাপড়কে জড়িয়েই তুলি বানিয়ে ফেলেন। কখনো কখনো হাতের আঙুলকে, নয় তো আঙুলের ডগায় কাপড়ের টুকরো জড়িয়েও তুলির কাজ করতে হয়। তবুও ছবি আঁকার কিংবা ছবিকে দেওয়ালে ফুটিয়ে তোলার অসামান্য শখ ও ভালোলাগা থেকেই তারা ছবি এঁকে চলেন দেওয়ালের গায়ে গায়ে। তাই তো চিত্রকরের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবও তাদের কাজে কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে না। স্রেফ শখ আর মনের সৌন্দর্যকে বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেই এঁকে চলে কতসব ছবি। ছবির মধ্যে থাকে নানা রকমের জ্যামিতিক চিত্র, কত সব ফুল, ফল, লতা, পাতা, পশু, পাখির ছবি। দেওয়াল জুড়ে অবস্থান করে এবং ঘরের সৌন্দর্যকেও বৃদ্ধি করে।

সাঁওতাল নারীরা সারা বছর ধরে যে ছবি আঁকার চর্চা করেন তাও নয়। প্রতিবছর কেবল এই বাঁদনার সময় এলেই তারা ঘরবাড়িকে সৌন্দর্যময় করে গড়ে তোলেন। অবশ্য আরো একটা কারণ আছে। বর্ষার জলের ঝাপটা পেয়ে মাটির বাড়িগুলোর দেওয়াল এসময় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেওয়ালের উপরের অংশটা বৃষ্টির ঝাপটায় ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে। রাস্তার গোল গোল গর্তের মতোই দেওয়ালগুলোরও একই দশা হয়ে পড়ে। তাই বর্ষা শেষ হলে ক্ষতিগ্রস্ত দেওয়ালগুলোকে পুনর্গঠনের কাজ পুনরায় শুরু করা হয়। লাল বা গিরিমাটি দিয়ে প্রথমে দেয়ালগুলোর ক্ষতস্থান মেরামত করে তোলা হয়। তার উপর সাদামাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। সেটা দুই বা তিনবারও দিতে হতে পারে। কখনো গোবরের প্রলেপও দেওয়া হয়। এভাবেই দেওয়ালগুলোকে আরো বেশি সুন্দর ও মসৃণ করে গড়ে তোলা হয়।

মাটির এই বাড়িগুলোর দুটো অংশ থাকে। একটি মূল দেওয়াল। অন্যটি মূল দেওয়ালের ঠিক পদতল বা নিম্নভাগ। যেখানে একটি দুআড়াই ফুট উঁচু মোটা দেওয়ালের অংশ বানানো থাকে। সেটা দেওয়ালের গোড়াকে সুরক্ষিত রাখে। কারণ বৃষ্টির জলে ওই অংশটাই নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও মূল দেওয়ালকে সুরক্ষিত রাখে। এর আবার আঞ্চলিক নানান নামও আছে। কোথাও 'পিঁড়হা', কোথাও 'পিঁড়ি' বা 'পিঁড়হি', কোথাও আবার 'ভতা'। এগুলোতে বসেই গ্রামের মানুষেরা আড্ডা মারে ও নানান গল্প গুজব করে। ক্ষতিগ্রস্ত এই পিঁড়হাগুলিকেও নতুন করে আবার সারিয়ে তোলা হয়। এগুলোকে বেশিরভাগ সময়ই কালো রঙে রং করা হয়। এর ঠিক উপর থেকেই ফিতার মতো সমান্তরাল ভাবে বাড়ির দেওয়ালকে আড়াআড়ি বিভিন্ন রঙে সাজিয়ে তোলা হয়। এরপর মূল দেওয়ালের ঠিক পাঁচ ছয় ফুট উপরে নানা রকমের ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়।
🍂
ছবির বিষয়বস্তু যদি দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন ধরণের জ্যামিতিক চিত্র আঁকা থাকে। 'তপন কর' বলেছেন, দেওয়ালগুলোতে চতুষ্কোণ ও ত্রিভুজের ছড়াছড়ি। চতুষ্কোণ এর ভিতর কখনো আরো চতুষ্কোণ এবং ত্রিভুজের ভিতরে আরো ত্রিভুজ বসানো থাকে। (মাটির ঘরে দেওয়াল চিত্র/ তপন কর) তবে বৃত্তাকার ও অর্ধ বৃত্তাকার ছবিও দেখা যায়।

ফুলের মধ্যে পদ্ম ফুলের ছবি সব থেকে বেশি লক্ষ্য করা যায়। সে কথা শিপ্রা ঘোষ ও সজল কুমার মণ্ডলও '"পুরুলিয়ার দেয়াল চিত্রের ঐতিহ্য ও বৈচিত্র‍্যতা: একটি অধ্যয়ন" অংশে বলেছেন। তারা পদ্মের কয়েকটি ভাগের কথাও উল্লেখ করেছেন। যেমন, কুঁড়িপদ্ম, ফুটন্ত পদ্ম, চার পাপড়িযুক্ত পদ্ম প্রভৃতি। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পাপড়িযুক্ত ফুল যেমন জবা ফুল সহ অন্যান্য চার পাপড়িযুক্ত ফুলও বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। উদ্ভিদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের লতাপাতার ছবিই বেশি অঙ্কিত হয়। টবের ফুলগাছও তাদের মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। প্রাণীদের মধ্যে নৃত্যরত নর-নারী, ময়ূর, টিয়া, হাতি, মাছ ও প্রজাপতির ছবিও দেখা যায়। এছাড়াও নানান ঘটনাকে দেওয়ালে ছবির আকারে প্রকাশ করা হয়।
দেওয়াল চিত্রে যে রং ব্যবহৃত হয় তার মধ্যে কালো রং সাধারণত লন্ঠনের কালি, কিংবা টায়ার পুড়িয়ে অথবা পুঁয়াল পুড়িয়েও তৈরি করা হয়। গেরুয়া রং বিশেষ এক ধরনের পাথর ঘষে ঘষে তৈরি করা হয়। দেওয়ালে যে দুধ সাদা মাটি দেওয়া হয়,(তাকে আমরা বলি পশুমাটি) সঙ্গে থাকে খড়িমাটি ও কিছুটা নীল বড়ির সংমিশ্রণ। এতে দেয়ালগুলো দারুণ এক উজ্জ্বলতায় ভরে উঠে। উজ্জ্বল দেয়ালগুলোতে তাই যে কোন রং-ই দারুণভাবে ফুটে ওঠে। লাল,গেরুয়া, হলুদ, নীল, সবুজ রং সচরাচর সব থেকে বেশি ব্যবহৃত হয়।

তপন কর তার "মাটির ঘরে দেওয়াল চিত্র" অংশে মানভূমে প্রচলিত ছবিগুলি ছাড়াও আরো একটা উল্লেখযোগ্য চিত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। তা হল, "মোরগঝুঁটি"। তিনি "মোরগঝুঁটির ঝাড়" সম্পর্কে বলেছেন, "যখন মোরগ ঝুঁটিকে চালচিত্রের মধ্যে স্থাপন করে অন্যান্য মোটিফ সংযুক্ত করে জড়োয়া সাজ করা হয় তখন বলা হয় 'মোরগঝুঁটির ঝাড়' বা 'মুরগা ঝাড়'।" সেই সঙ্গে 'কদম ঝাড়' ও 'শালুকলতার' কথাও উল্লেখ করেছেন।

এই দেওয়াল চিত্র ঠিক কত প্রাচীন তা বলা কঠিন। তবে কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন বলা যেতেই পারে। তাই এসময় জঙ্গলমহল পরিদর্শনে এলে এমন চিত্রের শোভা দর্শন না করে থাকলে তার চেয়ে বড় আফশোস আর কিছু হয় না।

Post a Comment

0 Comments