বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
নবম পর্ব
মন্দিরের উপরের চারটি তলা ভাঙ্গার সময়ে পুরোহিতেরা গোপনে মন্দিরের কষ্টিপাথরের শ্রী রাধাগোবিন্দের মূল বিগ্রহকে গোপনে রাজস্থানের জয়পুরের মহারাজার সহায়তায় স্থানান্তরিত করেন এবং অদ্যাবধি জয়পুরের গোবিন্দদেব মন্দিরে সেই বিগ্রহ পূজিত হচ্ছেন। যদিও মোগল সৈন্যরা মথুরা বৃন্দাবনের অন্যান্য মন্দিরের সঙ্গে গোবিন্দ মন্দিরও ধ্বংস করেছিল তাহলেও গোবিন্দ মন্দিরের গঠন খুবই মজবুত হওয়াতে তারা একেবারে ভেঙে ফেলতে পারেনি। কেবলমাত্র মন্দিরের অন্যান্য মূর্তিগুলি বিনষ্ট করে তারা শুধু চূড়াসহ মন্দিরের চারটি তলা ভেঙে দেয় যাতে মন্দির শীর্ষের প্রদীপের আলো আর আগ্রা থেকে দেখা না যায়। ওই ধ্বংসলীলার পরে শ্রী গোবিন্দদেবের মন্দির দীর্ঘকাল অনাদৃত ও অবহেলিত হয়ে পড়েছিল। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ভগ্ন শ্রীগোবিন্দদেবের মন্দিরের সংস্কার শুরু হয় মথুরার কালেক্টর গ্রাউস সাহেবের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আর জয়পুরের মহারাজার সক্রিয় সহায়তায়। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে এই সংস্কার কার্য সম্পূর্ণ হয়। বর্তমানে মন্দিরের পিছনে নতুন মন্দির তৈরি করে শ্রী রাধাগোবিন্দের পূজা হয়। এই নতুন মন্দির ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেছেন বাঙালী জমিদার শ্রী নন্দকুমার বসু।
🍂
গাইডের কথায় আমি একটু বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তাহলে জয়পুরে যে মূর্তি পূজিত হচ্ছেন সেটি কি শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রনাভের তৈরী মূর্তি? আমাদের গাইড বললেন না, বজ্রনাভের রাজত্বকালের পরে সেই বিগ্রহ আত্মগোপন করেন। এর বহুকাল পরে শ্রীরূপ গোস্বামীর অলৌকিক প্রয়াসের ফলে এই পবিত্র ঐতিহ্যময় বিগ্রহ দীর্ঘকাল পরে ভক্তগণের সম্মুখে প্রকটিত হন এবং শ্রীরূপ গোস্বামী পরম আনন্দে এই বিগ্রহের সেবা পূজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম শ্রীরূপ গোস্বামী কিভাবে সেই মূর্তি উদ্ধার করেছিলেন সেই ঘটনা আমাদের বলুন। আমার প্রশ্নের উত্তরে আমাদের গাইড বললেন " মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের নির্দেশে শ্রীরূপ গোস্বামী ও শ্রী সনাতন গোস্বামী বহু বছর ধরে বৃন্দাবনে লুপ্ত তীর্থ উদ্ধার ও লুপ্ত-বিগ্রহের উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। প্রাচীন শাস্ত্র গ্রন্থাদি খুঁজে শ্রীরূপ গোস্বামী জানতে পেরেছিলেন যে রাজা বজ্রনাভের নির্মিত বিগ্রহটি বৃন্দাবনের যোগপীঠে বিরাজ করতেন। কিন্তু প্রাচীনকালের সেই যোগপীঠ কোথায় তা তো কেউ বলতে পারছেন না। সেই বিগ্রহের হদিস করতে না পেরে তিনি আকুল হয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাতে লাগলেন “হে প্রভু তুমি কোথায় লুকিয়ে আছো আমায় তার সন্ধান দাও?” তাঁর প্রার্থনায় বিগলিত হয়ে একদিন গোবিন্দদেবের কৃপার উদ্রেক হল। একদিন যমুনা তীরে বসে শ্রীগোবিন্দকে যখন একাগ্রচিত্তে স্মরণ করছেন শ্রীরূপ গোস্বামী তখন সেখানে এসে উপস্থিত হলো দিব্য লাবণ্যময় শ্যামলকান্তি চঞ্চল এক ব্রজবালক। বালকটি শ্রী রূপ গোস্বামীকে বললেন 'বাবাজি তুমি বসে বসে ঘুমোচ্ছ না গোবিন্দের ধ্যান করছো? তুমি কি জানো না যে তোমার ধ্যানের গোবিন্দ ওই ব্রহ্মকুন্ডের কাছে গোমাটিলায় আছেন?' শ্রীরূপ গোস্বামীর ধ্যান তখনো ভাঙ্গেনি। তিনি আচ্ছন্ন অবস্থায় এই কথাগুলি শুনে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বালককে জিজ্ঞেস করলেন "তুমি কি জানো ওই গোমাটিলার কোথায় তিনি আছেন"? বালকটি বলল "কেন জানব না? ওই গোমাটিলার এক জায়গায় প্রত্যহ দুপুর বেলায় একটি দুগ্ধবতী গাভী আসে এবং একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তার বাঁট থেকে দুধ ঢেলে দিয়ে যায়। ওর নিচেই তো তোমার আরাধিত গোবিন্দ দেবের শ্রীবিগ্রহ আছেন"। বালকের এই কথা শুনে শ্রীরূপ গোস্বামীর অন্তর এক অপার্থিব আনন্দে ভরে গেল। অর্ধবাহ্য অবস্থায় তিনি ভাবতে লাগলেন 'একি সত্যই কোন ব্রজবালক অথবা শ্রীগোবিন্দ নিজেই বালকের ছদ্মবেশে এসে আমার কাছে এই কথা বললেন'। এই কথা ভেবে তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। জ্ঞান ফিরে আসার পরে তিনি সেই বালককে আর কোথাও দেখতে পেলেন না। তখন শ্রীরূপ গোস্বামী নিকটবর্তী গ্রামে গেলেন। গ্রামবাসীদের প্রত্যেককে জনে জনে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন ওই গোমাটিলার ভেতরে গাভীর দুগ্ধ দানের রহস্যের কথা। গ্রামবাসীগন সমস্বরে বলল ' হ্যাঁ আমরা জানি'। তখন শ্রীরূপ গোস্বামী তাদের কাছে আকুল প্রার্থনা জানিয়ে বললেন "আপনারা সকলেই চলুন ওখানে। ওই স্থান থেকে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবেন আমাদের প্রাণপ্রিয় শ্রীগোবিন্দদেব। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় সেই স্থান খুঁড়ে শ্রী গোবিন্দদেবের পবিত্র বিগ্রহ উদ্ধার করা হলো। এরপরে শ্রীরূপ গোস্বামী নিকটবর্তী সমস্ত গ্রামবাসী, সাধুসন্ত ও ভক্তজনের কাছে শাস্ত্র বাক্য উদ্ধৃত করে প্রমাণ করলেন যে ঐ গোমাটিলাই হল দ্বাপর যুগের যোগপীঠ আর এই বিগহ হলেন বজ্রনাভ প্রতিষ্ঠিত ও পূজিত শ্রীগোবিন্দদেব।
শ্রীগোবিন্দদেব মন্দির থেকে বেরিয়ে ডানদিকে সামান্য দূরত্বে শ্রীরঙ্গনাথ মন্দিরে আমরা গেলাম। দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্য রীতিতে এই মন্দিরটি নির্মিত অনেকটা দুর্গের মত বিশাল জায়গা জুড়ে মন্দির এলাকা। সুবিশাল বৈভবশালী এই মন্দিরটি সম্ভবত উত্তর ভারতের বৃহত্তম মন্দির। চারিদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পকলায় সমৃদ্ধ দুটি সূউচ্চ গোপুরম্। একটি গোবিন্দ মন্দিরের কাছে আরেকটি রাধাবাগে। পশ্চিম দিকের রাধাবাগের এই গোপুরমটি মন্দিরের প্রধান প্রবেশ তোরন। দু’সারি প্রাচীরের মাঝখানে পাথর বাঁধানো সুপ্রশস্ত্র পথ। দ্বিতীয় পাঁচিল পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে সোনার তালগাছ - ষাট ফুট উঁচু ধ্বজস্তম্ভ। মাটির নিচে নাকি আরো ২৪ ফুট রয়েছে। সূর্যালোকে সোনার মতই চকচক করে কিন্তু সত্যই এটি সোনার নয়। তামা গিল্টি করে এই ধ্বজস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। শ্রীগোবিন্দ মন্দিরের দিকের গোপুরম দিয়ে প্রবেশ করে বাঁদিকে একটি লম্বা বারান্দায় কাল কষ্টিপাথরের অনন্ত শয্যায় নারায়ণের বিগ্রহ, পদপ্রান্তে লক্ষ্মীদেবী, নীচে রঙ্গনাথ, তাঁর দুপাশে শ্রীদেবী ও ভূদেবী। এখান থেকে উত্তর দিকে কিছুটা গেলে প্রদর্শনী কক্ষ যেখানে সোনা ও রুপার নির্মিত হাতি ঘোড়া ইত্যাদি রাখা আছে। টিকিট মাথা পিছু ১৫ টাকা। পেছনের দিকে কৃষ্ণ হনুমান মন্দির তার পূর্বে বাম দিকে যে বিরাট কুণ্ড সেখান থেকে প্রত্যহ জল নিয়ে বিগ্রহের সেবা পূজা ও ভোগ তৈরী করা হয়। মূল মন্দিরে লক্ষ্মীনারায়ণের কালো কষ্টি পাথরের মূর্তি, নীচে সোনার উৎসব মূর্তি। এই উৎসব মূর্তিকে পালকিতে করে মন্দির পরিক্রমা করা হয়। মন্দিরের বাঁদিকে তিরুপতি বালাজির বিগ্রহ এবং দক্ষিণে রামানুজনের বিগ্রহ। বাম দিক দিয়ে প্রদক্ষিণ করার পরে সম্মুখভাগে অর্থাৎ মন্দিরের ডান দিকে শ্রী রামচন্দ্র, সীতাদেবী লক্ষণ ও হনুমানের মন্দির। এখানেও পেছনে কালো কষ্টি পাথরের বিগ্রহ, তার নীাচের ধাপে সোনার মূর্তি। মন্দিরের মুখ্য উৎসব দোলযাত্রার সময় রথযাত্রা। মূল বিগ্রহকে রথে চাপিয়ে মন্দির প্রদক্ষিণ করে প্রাঙ্গণস্থ বাগান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়াও জন্মাষ্টমীর সময়ে বিরাট উৎসব হয়। প্রত্যহ মন্দিরে মঙ্গল আরতি শুরু হয় ভোর পাঁচটায় এবং রাত্রি নটায় মন্দির বন্ধ হয়। দক্ষিণ ভারতীয় পুরোহিতেরা এখানে পূজা পাঠ ইত্যাদি সমস্ত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করেন।
(পরবর্তী অংশ দশম পর্বে)
0 Comments