জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে-৬/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী


বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
          
ষষ্ঠ পর্ব

সূর্যতনয়া যমের বোন যমুনার তীরে অতি প্রাচীন এই জনপদ। রামায়ণ ও মহাভারতের যুগে মথুরার উল্লেখ আছে। এছাড়াও শ্রীমদ্ভাগবত, হরিবংশপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ, গর্গসংহিতা, প্রভাস খন্ড এবং বিভিন্ন বৈষ্ণব ধর্মপুস্তকে মথুরার উল্লেখ করা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান এবং কংস নিধনস্থল হিসেবে। হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে যে সপ্তপুরীর উল্লেখ আছে তন্মধ্যে মথুরা অন্যতম। "অযোধ্যা, মথুরা, কাশী, কাঞ্চি, হ্যবন্তিকা তথা পুরী, দ্বারাবতী চৈব সপ্তৈতাঃ মোক্ষদায়িকাঃ"। অর্থাৎ হিন্দু শাস্ত্রে সাতটি যে মোক্ষদ্বার আছে সেগুলি হল- অযোধ্যা, মথুরা, কাশী, কাঞ্চীপুরম, অবন্তী বা উজ্জয়িনী, পুরী এবং দ্বারকা। বারানসীর মতোই বৃন্দাবন পুন্যতীর্থ। বারাণসীতে আছেন শিব এখানে আছেন কৃষ্ণ। সেখানে গঙ্গা এখানে যমুনা। বারানসীর মতোই বৃন্দাবন জুড়ে রয়েছে অসংখ্য মন্দির। এই একবিংশ শতকেও বৃন্দাবন রাধা-কৃষ্ণময়। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যেও সাধারণ মানুষ দিনান্তে একবার রাধা কৃষ্ণের নাম করেন।
আহুকের মৃত্যুর পরে উগ্রসেন মথুরার রাজা হন। কিন্তু উগ্রসেনের প্রথম সন্তান কংস উগ্রসেনকে বন্দী করে মথুরার সিংহাসন অধিকার করেন। তার অত্যাচারে সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এরপরে অতর্কিত আক্রমণ করে কৃষ্ণ ও বলরাম রাজদরবারে কংসকে হত্যা করেন এবং উগ্রসেনকে কারাগার থেকে মুক্ত করে মথুরার সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন। বসুদেব ও দেবকীকেও কারাগার থেকে মুক্ত করেন। কংসের মৃত্যুর পরে তার শ্বশুর মগধরাজ জরাসন্ধ জামাতা হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বারংবার মথুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু কৃষ্ণ বলরাম এমন প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন যে শত চেষ্টা করেও জরাসন্ধ মথুরায় প্রবেশ করতে পারেননি। ১৭ বার তিনি মথুরা আক্রমণ করেছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই তাকে ফিরে যেতে হয়। বারবার জরাসন্ধের আক্রমণের ফলে শ্রীকৃষ্ণ চিন্তা করলেন এর ফলে মথুরাবাসীদের যথেষ্ট ক্লেশ স্বীকার করতে হচ্ছে এবং তারাও শান্তিতে বসবাস করতে পারছেন না। সমস্ত কিছু চিন্তা করে জরাসন্ধ যখন অষ্টাদশতম আক্রমণ করেন তখন সেই আক্রমণ প্রতিহত করার পূর্বে শ্রীকৃষ্ণ যাদবদের নিয়ে পশ্চিমে দ্বারকাতে চলে যান এবং সেখানে তাঁর রাজ্য স্থাপন করেন। কৃষ্ণ বলরাম দ্বারকায় চলে যাওয়ার পরে জরাসন্ধ মথুরা আক্রমণ করে মথুরাকে শ্মশানে পরিণত করে জামাতা হত্যার প্রতিশোধ নেন। অবশ্য এর কিছুদিন পরে মধ্যম পাণ্ডব ভীমের সহায়তায় জরাসন্ধকে বধ করে শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞাতিহত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। জরাসন্ধের মৃত্যুর পরে যাদব বংশের অনেকেই পুনরায় মথুরাতে ফিরে আসেন এবং বসবাস করতে থাকেন। মথুরা আবার শূরসেন দেশ নামে অভিহিত হয়।
🍂
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরে যুধিষ্ঠির অর্জুনের পুত্র পরীক্ষিতকে নিজের রাজ্যভার অর্পণ করে মহাপ্রস্থানের পথে চলে যান। যাওয়ার আগে মথুরামন্ডলের রাজা রূপে কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের পুত্র বজ্রনাভকে অভিষিক্ত করেন। তাঁর উদ্দীপনা ও প্রয়াসের ফলে মথুরায় তিনি শ্রীকৃষ্ণের তিনটি মন্দির স্থাপন করে শ্রীগোবিন্দ, শ্রীমদনগোপাল ও শ্রীগোপীনাথের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভক্তিমান আচার্যদের সহায়তায় অর্চনা ও ভোগরাগের পদ্ধতি প্রবর্তিত করেন। ঐ সময়ে সাধু মহাত্নাদের প্রচেষ্টায় শ্রীকৃষ্ণের লীলাস্থল নতুন করে আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীকালে অবশ্য ওইসব বিগ্রহ ও তীর্থস্থান লুপ্ত হয়ে যায় বিশেষ করে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খননকালে জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব একাদশ থেকে পঞ্চম শতকের মধ্যে মথুরা গাঙ্গেয় সমভূমির সাথে মালব এবং পশ্চিম উপকূলের মধ্যে বাণিজ্যের এক প্রধান কেন্দ্র ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মথুরা শূরসেনা রাজবংশের রাজধানী ছিল। পরবর্তীকালে চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত মথুরা মৌর্য রাজত্বের অধীনে ছিল। গ্রিক পন্ডিত মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় মথুরাকে 'মেথোরা' বলা হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০ থেকে ১০০ সময়কালে এখানে আলেকজান্ডারের রাজত্ব ছিল এবং পরবর্তীকালে যবন রাজাদের আধিপত্য এখানে কায়েম হয়। এই সমস্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে মথুরা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরত্বে মাঘেরাতে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খনন কালে সেখানের একটি ব্রাহ্মী শিলালিপি থেকে। এরপরে মহাক্ষত্রপ বংশের রাজত্ব শুরু হয়। মহাক্ষত্রপ বংশের পরে কুষাণ, গুপ্ত এবং হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল। সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে এখানে চারিটি বড় এবং অনেকগুলি ছোট ছোট বৌদ্ধস্তূপ নির্মাণ করেন। কুষাণ সম্রাট কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় মথুরা বৌদ্ধধর্মের একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের লেখনীতে উল্লেখ আছে সেই সময় মথুরাতে কুড়িটি বৌদ্ধ বিহার এবং পাঁচটি হিন্দু মন্দিরের কথা। তিনি মথুরাকে একটি বৌদ্ধনগরীরূপে বর্ণনা করেছেন। মথুরা থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খননকালে যে প্রস্তর মূর্তি পাওয়া গেছে তাতে বৃষ্ণি বংশের পাঁচ ক্ষত্রিয় বীরের নাম উল্লেখ আছে। এঁরা হলেন সঙ্কর্ষণ, বাসুদেব, প্রদ্যুম্ন, শাম্ব এবং অনিরুদ্ধ।                                     
দশম শতাব্দী থেকে মথুরার উপরে যবন আক্রমণ শুরু হয়। পশ্চিম সীমান্তের গিরিপথ দিয়ে গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষে এসে বিভিন্ন মন্দিরের সাথে মথুরার সমস্ত মন্দিরগুলিকে আক্রমণ করে ভূমিসাৎ করে দেন এবং হিন্দুদের উপর বর্বরোচিত অত্যাচার ও উৎপীড়ন করেন। মথুরামন্ডলের মহাবনের রাজা কুলচন্দ্র জন্মভূমি ও ধর্ম রক্ষার জন্য তাঁর ষাট হাজার বৈষ্ণব সৈন্য নিয়ে মামুদের বাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু লক্ষাধিক সুশিক্ষিত যবন সৈন্যবাহিনী নৃশংসভাবে ওই বৈষ্ণব সেনাদের হত্যা করার পরে কুলচন্দ্র নিজের স্ত্রী পুত্রকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেছিলেন। মামুদের সময়ে পর্যটক আলবেরুনীর লেখায় আমরা জানতে পারি যে সেই সময় মথুরা ও বৃন্দাবনে যমুনার তীরে তীরে শিল্প সৌন্দর্যময় মনি মুক্তা খচিত সহস্রাধিক মন্দির ছিল। তাঁর মনে হয়েছিল এই রকম নয়ন মনোহর মন্দির নির্মাণ করতে প্রচুর অর্থের  প্রয়োজন হয়েছিল এবং বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সুনিপুণ স্থপতিরা ২০০ বছর অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করেও এরকম মন্দির নির্মাণ করতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ। সমগ্র মন্দিরগুলি সোনার পাতে মোড়া, বিগ্রহগুলি স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত এবং সেই বিগ্রহের চক্ষুগুলি ছিল মূল্যবান হীরা অথবা নীলকান্তমনির। এরপরে শতাধিক বৎসর মথুরামন্ডলের কোনরকম সংস্কার হয়নি। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য সূচনার পূর্বে দিল্লির সুলতান লোদী বংশের সিকান্দার লোদীর হাতে মথুরার মন্দিররাজি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়। সিকান্দার লোদী এতখানি হিন্দু বিদ্বেষী ছিল যে বেলেপাথরের মন্দিরগুলি ভেঙেই ক্ষান্ত হয়নি, উপরন্তু মন্দির অভ্যন্তরে যে সকল বিগ্রহের মূর্তি ছিল সেগুলি ভেঙে মুসলমান কসাইদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে সেই চূর্ণ-বিচূর্ণ প্রস্তর খন্ড দিয়ে মাংস ওজনের বাটখারা করার জন্য। পরবর্তীকালে বুন্দেলখন্ডের রাজা বীর সিংদেও তেত্রিশ লক্ষ টাকা খরচ করে কেশবদেব মন্দির পুনরায় নির্মাণ করেছিলেন। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এদেশে আগত পর্তুগিজ জেসুইট ফাদার এন্টোনিও মনসেরাট্টা দেখেছিলেন এখানের হিন্দু মন্দিরগুলি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। আকবরের পরে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব এবং  বল্লভাচার্য এখানে এসেছিলেন লুপ্তপ্রায় হিন্দু মন্দিরগুলির অন্বেষণে এবং সমস্ত মন্দির পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করেছিলেন। এরপরে হিন্দুবিদ্বেষী দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে পুনরায় মথুরার হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন মন্দিরগুলির উপরে আঘাত এসেছিল। মন্দির ধ্বংস করেও তিনি ক্ষান্ত হননি উপরন্ত কৃষ্ণ জন্মভূমির উপরে তিনি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীতে আলেকজান্ডার কানিংহামের লেখাতেও মথুরার উল্লেখ আছে। এরপরে ব্রিটিশের রাজত্ব শুরু হয়”। 
                                                    পরবর্তী অংশ সপ্তম পর্বে

Post a Comment

0 Comments