শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২৭ / সালেহা খাতুন
শুধু জ্ঞান অর্জন করলেই হবে না তাকে আত্তীকরণে যথেষ্ট যত্নবান হওয়া আবশ্যক। ক্লাসের মাঝে প্রশ্ন করে করে তিনি জেনে নিতে চাইতেন আমরা ঠিক কোন অবস্থানে আছি। একবার ক্লাসে তিনি প্রশ্ন করলেন, “অক্ষর বলতে কী বোঝো”?সটান উঠে দাঁড়িয়ে উত্তর দিলাম, বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে উচ্চার্য ধ্বনিসমূহকে বলে অক্ষর। স্যার আশা করেন নি যে, কেউ উত্তর দিতে পারবে। জিজ্ঞেস করলেন,“তোমার নাম কী”? নাম বলতে বললেন, “বলোতো তোমার নামে ক’টি অক্ষর আছে”? সালেহা শব্দের ক্ষেত্রে অক্ষরের সংখ্যা ঠিক বললেও,খাতুন গেল গুলিয়ে। স্যার হা হা করে হেসে উঠে বললেন, “তাহলে তোমার নাম কি সালেহা ‘খাতুনো’”। আর ভুলিনি কোনোদিন।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের গদ্যের নিদর্শন ক্লাসে বোঝানোর সময় তিনি উদাহরণ দিতে চাইছিলেন একদিন। বললেন, “ওঁর ‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ গ্রন্থটি হাতের কাছে থাকলে তোমাদের এখনই দেখিয়ে দিতাম কেমন দীর্ঘ বাক্যে তিনি লেখেন”। আমি তো তখন নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছি বঙ্গভাষা ও সাহিত্য গুলে খাবো। কলেজ লাইব্রেরি থেকে প্রথম তুলেছিলাম ঐ বইটি। থার্ড ইয়ারের নূরদা নিজামদা আওয়াজ দিয়েছিল “বাবা ফার্স্ট ইয়ারেই এই বই পড়ছে”। তখন এতো জেরক্স বা পিডিএফের সুবিধা সহজলভ্য ছিল না। বইটি পড়ে খাতায় টুকে রেখেছিলাম কিছুটা অংশ। স্যারকে বললাম আমার কাছে আছে। খাতাটা এগিয়ে দিলাম, স্যার বললেন, “তুমি পড়ো”। তখনো বুঝিনি স্যারের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে।
আমরা স্যারের হাত ধরে একতলা থেকে তিনতলায় স্যারকে ক্লাসে নিয়ে আসতাম। স্যার কোনোরকম কাগজ কলম ছাড়াই অসাধারণ স্মৃতি এবং মেধায় ভর করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের গভীর এক পাঠ আমাদের দিতেন। খাতায় লিখে যেতাম। দুটো মোটা মোটা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের খাতা তখন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এই খাতাদ্বয় আজ আর আমার কাছে নেই। পরবর্তী ব্যাচের জন্য তখন এই খাতা আমি দিয়েছিলাম ফেরত পাবো এ আশা রেখে, কিন্তু স্যারের টেবিল থেকে কেউ একজন সম্পূর্ণ নিজের করে নেয়।
স্যারের কাছে বাংলা কাব্য কবিতার ইতিহাস পড়ে কবি হওয়ার সাধ জেগেছিল –
কবি সাহিত্যিক হবার ইচ্ছা অনেকদিনের
যদি রবীন্দ্রনাথ হতে চাই
সোনার চামচ কোথা পাই?
হই যদি নজরুল
তাহলেই করবো ভুল।
দুখুর ইতিহাস পড়ে বইয়ের পৃষ্ঠায়
নজরুল হবার ইচ্ছা একদমই নাই।
যদি চাই সুকান্ত হতে
একুশেই কি পারব জীবন পেরোতে?
জীবনানন্দ হতে যদি চাই
হেঁটে হেঁটে পৃথিবীর পথে পাবো না ঠাঁই।
ভাবলাম হবো রঙ্গলাল-
বললেন তিনি, ওরে ফিরে যা পঙ্গপাল।
দেখে শুনে ইচ্ছা হলো, হবো কবি হেম
হলো না কিছুই, বৃথা এ কবি প্রেম।
মধুসূদন হতে চাই-ই চাই
পটভূমি কোথা পাই?
মেঘনাদবধ কাব্য লেখার ইচ্ছা ছিল আমার
তার আগেই মধুকবি করলেন সাবাড়।
ইচ্ছা হলো হবো পলাশীর যুদ্ধের কবি
কবিতা লিখতে গেলে এঁকে ফেলি ছবি।
গীতিকাব্যকার হবো আমি কবি বিহারীলাল
সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন চাই কিছুকাল।
হয়ে দেখি কবি সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার
রচনারীতির আদর্শ যাঁর ক্লাসিকতার ।
লেখার চেষ্টা করি অক্ষয় বড়ালের মতো কাব্য এষা
ব্যর্থ হলো কেবল দোয়াত পেন নিয়ে বসা।
হবো আমি রবি কবির বন্ধু দেবেন্দ্রনাথ সেন
সার্থক হলো না আমার কবি হবার ধ্যান।
ভারত বিলাপ পড়ে, ইচ্ছে হবো গোবিন্দ দাস
মা এসে চড়ালেন ঠাস ঠাস।
বললেন ওরে পাজি হতচ্ছাড়া
কবি হবার ইচ্ছায় শুধু বইয়ের পাতা নাড়া?
কবিদের লেখা করে নকল
তুমি হবে বিরাট এক পাগল।
ভারত বিলাপ পড়ে চলছে এখন আমার বিলাপ
কেঁদে কেঁদে সান্ত্বনা পাই আমি সব কবিরই বাপ।
হয়ে দেখি মানকুমারী বসু
ঘোষণা তাঁর, আমি নাকি মহাশিশু।
স্থির করি এবার আমায় হতেই হবে কবি কামিনী রায়
দেখি কবিতার নেশা কে ছাড়ায়?
🍂
উনিশ কুড়ির এই ছেলেমানুষি আমার বন্ধুদের মধ্যে বিতান চৈতালী পলিরও ছিল। স্যার ওদের কবিনী উপাধি দিয়েছিলেন। বিতান সত্যি সত্যিই কবি। ও অনার্সে বিজয়কৃষ্ণ গালর্স কলেজে পড়তো। আমরা বলতাম হাওড়া গার্লস কলেজ। ও ভাবনা চিন্তায় আমাদের থেকে অনেক বেশি ম্যাচিওর ছিল। প্রকৃত বুদ্ধিমতী যাকে বলে।
(ক্রমশ)
2 Comments
মধুর স্মৃতি ৷ চলতে থাকুক...
ReplyDeleteধন্যবাদ সাগর।
Delete