ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৬
বিজন সাহা
মাক্সিম গোর্কি
আমরা যখন নিঝনি নভগোরাদ আসি তখন মাত্র এক রাতের জন্য বাসা পাই। তাই সকালে গ্রামে যাবার আগেই নতুন বাসায় উঠতে হয়। সারা দিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে কচালভ সিঁড়ি থেকে সূর্যকে বিদায় দিয়ে আমরা বাসায় ফিরি বেশ রাতে। এখন আগামীকালের প্ল্যান ঠিক করতে হবে। সেটা মাথায় রেখে নেট ঘেঁটে এখানকার বিভিন্ন উপাসনালয়ের লিস্ট করলাম। কেন উপাসনালয়? কারণ সুদূর অতীতের যেসব স্থাপনা এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে উপাসনালয়ই প্রধান। এর বাইরে যা আছে তার বেশির ভাগ ব্যক্তি মালিকানায় বিধায় সেখানে যাওয়া ততটা সহজ নয়। মিউজিয়াম তুলনামূলক ভাবে ব্যয় সাপেক্ষ ও অনেক সময় নেয়। রাজপ্রাসাদ মূলত রাজাদের ইতিহাস। সেদিক থেকে পুরানো মন্দির, মসজিদ, গির্জা ইত্যাদি যদি সবার জন্য খোলা থাকে তাহলে প্রায় বিনা পয়সায় সেখানে যাওয়া যায়, প্রয়োজনে স্বল্প খরচে শুধু উপাসনালয়ের নয়, সেই এলাকার বিস্তারিত ইতিহাস জানা যায়। আর যেহেতু শুধু স্থানীয় নয়, বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ তীর্থ ভ্রমণ করে তাই এসব উপাসনালয় নিজেদের ভেতরে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ইতিহাস লুকিয়ে রাখে। অন্তত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ার বিভিন্ন উপাসনালয় ভ্রমণ করে আমার এটাই মনে হয়েছে। তাই আমি এর একটা চার্ট তৈরি করে দিলীপকে দিলাম। সব মিলিয়ে সে এক বিশাল ফর্দ -
নিঝনি নভগোরাদের সাবর, পেচরস্কি ভজনেসেনস্কি মনাস্তির, গোরাদেভ স্মলেনস্কো – ভ্লাদিমিরস্কি আশ্রম, উস্পেনিয়া ভার্জিন মেরি গির্জা, ত্রইৎসা সাবর, নিঝেগোরাদ মসজিদ, সারমভ আলেক্সান্দর নেভস্কি সাবর, ভস্ক্রেসেনস্কায়া গির্জা, উসস্পেনিয়া মাতা মেরি গির্জা, সিমন স্তল্পনিক গির্জা, আলেক্সান্দর নেভস্কি নভইয়ামারচনি সাবর, রঝদেস্তভেনস্কায়া গির্জা, মিখাইল আরখাঙ্গেলস্কি সাবর, স্পাসো – স্তারোইয়ামারচনি সাবর, নিকোলস্কি সাবর,
স্পাসো-প্রেওব্রাঝেনস্কি সাবর, সেমিলোস্তিভা স্পাসো গির্জা, রঝদেস্তভো ইয়ানো প্রেদতেচি গির্জা, ঝেন মিরোনোসিৎস গির্জা, উস্পেনস্কায়া গির্জা না ইলিনে, সেরগেই রাদনেঝস্কি গির্জা, প্রেসভ্যাতই বগরদিৎসি গির্জা, ভজনেসেনস্কি গির্জা, স্পাসো – প্রেওব্রাঝেনস্কাইয়া গির্জা, মস্কো সেন্টদের গির্জা, ঈশ্বর মাতার প্রশংসায় গির্জা, ত্রইৎস্কায়া গির্জা, প্রেসভ্যাতই রঝদেস্তভো গির্জা। এদের প্রত্যেকের আছে নিজ নিজ ইতিহাস। ব্যাপারটা এই নয় যে আমাদের সব জায়গায় যেতে হবে, তবে যদি সেসব আমাদের পথের ধারে হয় ক্ষণিকের জন্য হলেও গেলে সমস্যা কোথায়? এছাড়াও আছে বিখ্যাত নভগোরাদ ক্রেমলিন, কচালভ সিঁড়ি, দ্মিত্রি টাওয়ার, নিঝেগোরাদ ইয়ারমারকা, গোর্কি অটোমোবাইল কোম্পানির মিউজিয়াম, সারমোভস্কি পার্ক, জাচাতিয়েভ টাওয়ার, রুশ ফটোগ্রাফি মিউজিয়াম, স্টেট ব্যাংক, কচালভের স্ট্যাচু, মাক্সিম গোর্কির স্ট্যাচু, পুশকিন পার্ক, বিভিন্ন থিয়েটার। তাই দেমিদ দেখতে শুরু করল কিভাবে গেলে আমরা সবচেয়ে বেশি দর্শনীয় স্থান কভার করতে পারি। এছাড়া দিলীপের ক্যামেরার কি একটা সমস্যা হচ্ছিল। ও চাইছিল কোন এক ল্যাবে যেতে। ঠিক হল আমরা সেটা দিয়েই শুরু করব, যদিও করোনার কারণে এসব ল্যাব এখন কাজ করে কি না সেটা কে জানে। পাশেই মাক্সিম গোর্কির স্ট্যাচু – সেটাও দেখতে হবে নিঃসন্দেহে। এরপর আমরা যাব পেচরস্কি ভজনেসেনস্কি মনাস্তির, ক্যাবল কার আর যদি সময় থাকে মালিনভস্কি সাবর দেখতে। সেটা শহরের বাইরে, বেশ দূরে।
বিড়াল ও পাখি
সকালে আমরা রওনা হলাম সেই ল্যাবের খোঁজে। গাড়ির একটা সুবিধা হল নিজেদের খুশি মত যেখানে খুশি সেখানে যাওয়া যায় আর অসুবিধা হল যেখানে খুশি সেখানে পারকিং করা যায় না। তাই অনেক দূরে কোথাও গাড়ি রেখে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। এতে অবশ্য ভালোই হয়েছিল। রাস্তায় বেশ কিছু সুন্দর স্ট্যাচুর দেখা মিলল। এদের একটা ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে কুকুর সহ বিভিন্ন সময়ের পুলিশদের স্ট্যাচু। শেষ পর্যন্ত যখন ল্যাবের ওখানে এসে পৌঁছুলাম, দেখি সব বন্ধ। এর একটা কারণ হতে পারে যে এটা ছিল রোববার। আরেকটা কারণ হতে পারে যে গতকাল ছিল নিঝনি নভগোরাদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। তাই রাস্তা পার হয়ে গেলাম গোর্কি স্ট্রীটে। সেখানে উঁচু এক বেদীর উপর দাঁড়িয়ে আছেন মাক্সিম গোর্কি নামে পরিচিত আলেক্সেই পেশকভ। এই শহরেই এক দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম। এখনও মনে পড়ে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “মা” আর আত্মজীবনীর ট্রিলোজি – আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পাঠশালা আর পৃথিবীর পথে। তাঁর দুটো উক্তি আমার আজীবন সাথী – তিনি যখন বাড়ি থেকে চলে যান তখন তাঁর দাদু তাঁকে বলেছিলেন “মানুষের হাত মাত্র দুটো, কিন্তু সে দশ হাতে সব ধরতে চায়।” আর “সবার কথা শুনবে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবে নিজে, কারণ ফলাফলের দায়িত্ব একান্তই তোমার।” বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ায় মাক্সিম গোর্কি হাতে গোনা কয়েকজনের একজন যিনি লেনিন বা স্তালিনের কথার প্রতিবাদ করতে পারতেন।
তিনি অনেক বুদ্ধিজীবী ও বন্দীদের বলশেভিকদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন, এমনকি একসময় পার্টির সাথে দ্বিমতের কারণে নির্বাসনে যান। অনেকের মতে এখানেই তিনি মানের দিক থেকে নিজের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচনা করেন যা ইতালির গল্প নামে পরিচিত। ১৯২১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি কখনও ইউরোপে, কখনও রাশিয়ায় বসবাস করতেন। বিভিন্ন ভাবে সোভিয়েত সরকারকে সাহায্য করলেও তিনি স্তালিনিজম গ্রহণ করেননি। ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বিভিন্ন কোটেশনের একটি “মিথ্যা হল দাস ও মালিকদের ধর্ম। সত্য হল মুক্ত মানুষের ঈশ্বর।” রুশে একটা কথা আছে “বিপ্লব তার সন্তানদের গ্রাস করে।” রুশ বিপ্লবের ইতিহাস পড়লে কথাটা সত্য বলেই মনে হয়, কেননা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিপ্লব পরবর্তী বছরগুলোতে কত বিপ্লবী যে প্রাণ দিয়েছেন!
নিঝনিতে লেনিনগোর্কি স্ট্রীট ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এলাম অনেকটা দূরে। দেখি দেয়ালে এক দল লোকের সাথে লেনিন কথা বলছেন – স্ট্যাচু নয়, যেন কোন এক ছবির থ্রি-ডি কপি। পাশে লেখা নিঝনি নভগোরাদের মার্ক্সিস্টদের সাথে লেনিন। ১৮৯৩, ১৯৯৪ ও ১৯০০ সাল। সেই সময় লেনিনের বয়স ২৩ থেকে ৩০, তাই তাঁর মাথায় টাক বা টুপি দুটো “ট” অনুপস্থিত। মাথায় তাঁর ঝাঁকড়া চুল। সোভিয়েত আমলে এসব দেখতে অবাক হতাম না, তবে সময় বদলে গেছে, তাই একটু অবাকই হলাম। একটু দূরে খোদিত গোর্কির উক্তি “এমন কোন শক্তি নেই যা লেনিন কর্তৃক উত্তোলিত মশালের আলো আঁধার করতে পারে।” গত দু' দিনে এই প্রথম শহরটা কেমন যেন পরিচিত পরিচিত মনে হল। রাস্তার দুই ধারে ফ্যাসনেবল দোকানপাট, চারিদিকে লোকজনের ভিড়, বিশেষ করে তরুণ তরুণীদের ভিড়। এর আগে যেখানেই গেছি সবার মধ্যে ছিল ট্যুরিস্ট ট্যুরিস্ট ভাব, এখানে সবার মধ্যে এক ধরণের কর্মব্যস্ততা। এর মধ্যেই আমরা ঢুকে গেলাম এক ব্যস্ত ক্যাফেতে। আসলে এই সময় এখানে সব ক্যাফেই ছিল কোলাহল মুখর। সেখানে বসেই ঠিক করলাম পরবর্তী গন্তব্য। আমি আবারও বললাম ক্রেমলিনে যাবার কথা। তাই আমরা উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলাম। দেমিদ গাড়ি রেখেছে এক বাসার আঙিনায়। পথে পড়ল বাচ্চাদের লাইব্রেরি। আসলে এখানে প্রায় সব লাইব্রেরিতেই বাচ্চাদের বইয়ের আলাদা কর্নার থাকে। তবে কোথাও কোথাও বাচ্চাদের জন্য আলাদা লাইব্রেরিও থাকে। এটা মনে থাকার মূল কারণ দুটো স্ট্যাচু। একটা হল সিংহাসনের স্ট্যাচু। তবে সেটার মূল বৈশিষ্ট্য হল তাতে রুশ দেশের বিভিন্ন রূপকথার নায়ক নায়িকাদের ছবি খোঁদাই করা আছে। একটু দূরে আরেকটা স্ট্যাচু। সেখানে বইয়ের স্তুপের উপর একটা খোলা বই দাড় করানো। বইয়ের সামনে একটা পাখি বসে আছে আর বইয়ের ওপাশ থেকে একটা বিড়াল পাখিটাকে ধরার চেষ্টা করছে। ঠিক যেন ওরা কথা বলছে।
সেখান থেকে আমরা রওনা হলাম ক্রেমলিনের পথে। কিন্তু দেখা গেল সেখানে গাড়ি রাখা এক বিশাল সমস্যা। কেননা শহরের কেন্দ্রও মানেই নো পারকিং জোন। আর আমাদের হাতে সময় অল্প। দূরে কোথাও গাড়ি পার্ক করলে অনেকটা সময় তাতেই চলে যায়। দিলীপ বা দেমিদ কেউই তেমন আগ্রহ দেখাল না ক্রেমলিনে যাবার। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পেচরস্কি ভজনেসেনস্কি মনাস্তির।
ছবিতে নিঝনি নভগোরাদ
http://bijansaha.ru/album.php?tag=248
নিঝনি নভগোরাদ ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=mUP1yA5m0JE&t=1267
সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪
0 Comments