জ্বলদর্চি

ছায়াময় /শুভশ্রী রায়

ছায়াময়
শুভশ্রী রায়

শ্যামলবাবু বাজার যাচ্ছিলেন। আজ ভূত চতুর্দশী। মাছ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এ দিকে ফ্রিজে একটাও মাছ নেই। কাল বুদ্ধু মানে তাঁর শ্যালক আসবে। তাকে মাছ খাওয়ানো যাবে না হয়তো। গিন্নি ক' দিন ধরে সমানে বাজার যেতে বললেও তিনি যাননি। ফ্রিজের মাছ, সব্জি দিয়ে চলছিল। আজ কিছুই নেই। অবশেষে আজ সকালে যেতেই হ'চ্ছে।
এখন যদি মাছ পাওয়া না যায়, শুধু সব্জি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়, তাহলে গিন্নির হাঁড়িমুখ দেখতে হ'বে। "ভাইটা কত দিন পরে বেঙ্গালুরু থেকে এল, এক দিন নিজের বাড়িতে থাকার পর কালীপূজোর যানজট ঠেলেও সল্ট লেক থেকে এই পাইকপাড়া আসছে। তাকে মাছ খাওয়াতে পারব না। ভাইফোঁটার আগের দিনই তো প্লেনে চাপছে।" এই সব আক্ষেপও শুনতে হবে বৈকি।
  বাজারে গিয়ে শ্যামলবাবু অনেক খুঁজেও মাছ পেলেন না। মাছের বাজার খোলেইনি আজ।
ডালনার জন্য পানিফল, নিজের প্রিয় পেঁয়াজকলি, অনেকগুলো আপেল, সব কিনলেন কিন্তু মাছ না থাকলে নেবেন কী করে! বাড়ি গিয়ে আলস্যের জন্য গিন্নির খোঁচা শুনতে হবে। 
   বিরক্তমুখে চপের দোকানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। এ দিকটায় বিটি রোড। সাধারণত এ দিক দিয়ে বেরোন না। আজ কী মনে করে বেরোলেন আর বেরনো মাত্র নিজেরই দোষে একটা শিড়িঙ্গে মতো লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে গেলেন। লজ্জিত মুখে সরি বলায় লোকটা তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসল এবং তাঁকে বলল- "দাদাকে অন্যমনস্ক বলে মনে হ'চ্ছে। বাজারে চাহিদা মতো কিছু পাননি নাকি?
শ্যামলবাবু -" আর বলবেন না, মাছ পেলাম না। ক'দিন কুঁড়েমি করে আসা হয়নি। এ দিকে কাল শ্যালক আসছে অনেক দিন পর। দিদির হাতের মাছ তার বড় প্রিয়। এখন বাড়ি যাব আর গিন্নির বকবক শুরু হবে। কী যে করি!"
শিড়িঙ্গে - "মাছ তো আজ পাবেন না মশাই। ভূত চতুর্দশীর দিন এ দিকে কোথাও কোনো মাছওয়ালা বসবে না।"
একটু ভেবে সে বলল- "চিন্তা নেই। এগুলো নিন।"
   শ্যামলবাবু এতক্ষণ লক্ষ্য করেননি। লোকটার পাশে একটা বিরাট বড় ব্যাগ রাখা ছিল। সেই ব্যাগটা থেকে দু'টো বড় বড় পমফ্রেট আর একটা বেশ বড় রুই বার করে লোকটা তাঁর হাতে দিল।
শ্যামলবাবু অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। "এমন দিনে কোথায় পেলেন?"
   লোকটার জবাব- "ও আমরা পেয়ে যাই। এই সব দিনের ব্যাপারই আলাদা। কোথায় পেলাম ছাড়ুন, বাড়ি গিয়ে গিন্নিকে দিন।" 
  "দাম বলুন।" হতচকিত ভাব নিয়েই শ্যামলবাবু পকেট থেকে পার্স বার করলেন। দামের কথা শুনে লোকটা জিভ কাটল। "দাম নিতে পারব না, দাদা। বরং আপনার ঠিকানা বলুন। দু' চার দিন পরে এক দিন গিয়ে না হয় চা খেয়ে আসব। মোবাইল রাখি না। তাই নম্বর চাইলাম না।"
শ্যামলবাবু নিজের নাম, ঠিকানা বললেন। যে কোনো ছুটির দিনে সকাল আটটা থেকে দশটার ভেতরে আর সন্ধ্যা ছটা নাগাৎ গেলে তাঁকে পাওয়া যাবে, তাও বলে দিলেন। তাঁর কৌতূহলের জবাবে লোকটা নিজের নাম বলল না। "যে দিন যাব অনেক গল্প করব, নামও বলব। সব জানতে পারবেন। এখন আসি, নমস্কার।" বলে লোকটা ঝড়ের বেগে কোথায় যেন চলে গেল।
    বাড়ি ফিরে গিন্নির হাতে মাছ, সব্জি, ফল তুলে দিতে দিতে মাছ পাওয়ার অদ্ভুত গল্পটা বললেন শ্যামলবাবু। শুনে গিন্নি কপালে হাত ঠেকালেন। "সবই ওপরওয়ালার দয়া গো! তোমার মনের অবস্থা বুঝে কেমন করে মাছ তিনটে পাইয়ে দিলেন। যে লোকটা দিল সেও কত ভালোমানুষ ভাব। কাল আশ মিটিয়ে বুদ্ধুকে খাওয়ানো যাবে।"
     শ্যামলবাবু মনে মনে বললেন, হ্যাঁ, তোমার গঞ্জনা থেকেও রেহাই পাইয়ে দিলেন। শিড়িঙ্গে লোকটাকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে করে এক কাপ চায়ের জন্য গিন্নিকে অনুরোধ করলেন তিনি। মাছ ছাড়া ঢুকলে এই অনুরোধটা করা যেত না। 
🍂
    গিন্নি চা এনে দিলে কাপটা নিয়ে আরাম করে চুমুক দিলেন শ্যামলবাবু। তাঁদের এক মাত্র ছেলে থাকে দিল্লি। এক বছর হল চাকরি পেয়েছে। পুজোয় চার দিনের জন্য এসেছিল। সুতরাং এখন ছুটি পাবে না। ছেলে থাকলে হয়তো বাবাকে বাজার যেতে দিত না।

   রবিবার কালীপুজো। বুদ্ধুর সঙ্গে গল্প আর জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করে তাঁদের দিনটা দারুণ কাটল। মামা অবশ্য ভাগ্নের অভাবে প্রথমে একটু মনমরা হয়ে ছিল। দিদির হাতের অসাধারণ মাছ রান্না খেয়ে তার আক্ষেপ একটু কমল। মাছ পেয়ে যাওয়ার আশ্চর্য গল্পটা তাকেও শোনানো হ'ল। 

   পরের রবিবার সন্ধ্যাবেলায় উপকারী শিড়িঙ্গে লোকটা এসে হাজির। শ্যামলবাবুই দরজা খুললেন। দু'জনেই মহা খুশি। লোকটাকে চা মিষ্টি খাওয়ানো হ'ল। তবে লোকটা সহজে নাম বলতে চাইছিল না। "ছাড়ুন না। আমার নামটা খুব অদ্ভুত তাই বলতে লজ্জা লাগে। ধরুন, নামটা পরকাল, মৃত্যু, রহস্য এই সবের সঙ্গে জড়িত তাই সহজে কাউকে বলি না। 
শ্যামলবাবু বললেন- "এত উপকার করলেন আর নামটাই বললেন না! আমাদের যে আক্ষেপ থেকে যাবে।" গিন্নিও তাঁর কথায় সায় দিলেন।

   শুনে লোকটা বিনীত ভঙ্গীতে বলল- "উপকার কিছু করিনি। এ জগৎ, ও জগৎ সব জগতেই নিঃস্বার্থ আদানপ্রদান চলছে। শুধু বিশ্বাসটুকু রাখতে হয়।"
   কর্তা গিন্নি হাসিমুখে শুনছিলেন। লোকটার কথা বলার ভঙ্গীটা মনোরম। একটু চুপ করে থেকে শ্যামলবাবু বললেন- "যা বলেছেন! মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। তবে ওই জগৎ মানে মৃত্যুর পরে কোনো অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করি না।"
  শুনে লোকটা হেসে উঠল- "হয়তো কয়েক মুহূর্ত পরে আপনার এই বিশ্বাসটাও পাল্টে যাবে। জীবন বড় অদ্ভুত। তবে আপনাদের মতো প্রকৃত ভদ্র মানুষের সঙ্গে আর ভানভনিতা নয়। নাম বলছি। ছায়াময় সর্ব। কী অবাক হলেন তো? আসলে আমার ঠাকুর্দা গভীরভাবে পরলোকে বিশ্বাস করতেন। এই নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা ছিল তাঁর। তিনি বলতেন- ছায়া থাকলে ছায়াদের নিজেদের জগৎ থাকবে না কেন! বিশ্বাসকে অন্য মাত্রায় ছড়িয়ে দিতে হয়।"

  কর্তা গিন্নি অবাক হয়ে শুনছিলেন। শ্যামলবাবুই নীরবতা ভাঙলেন। "আপনার নামটা অন্য রকম ঠিকই কিন্তু অদ্ভুত কেন হবে! মানুষের কত রকম নাম হয়। তবে আপনার ঠাকুর্দার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি- ছায়াজগৎ কী ভূতে আমার তিলমাত্র বিশ্বাস নেই। সব কল্পনা।"
ছায়াময় বিষণ্ণ হাসল। তারপর দৃঢ়তার সঙ্গে জানাল- "অনেক সাধক তো বলে গেছেন, এই জগৎটাই আসলে মায়া। আমরাও আসলে নেই। অন্তত যেভাবে আছি বলে মনে করি, সেভাবে নেই। মোট কথা, আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ।"
বলতে বলতে দীর্ঘকায় লোকটা উঠে দাঁড়াল। দু' হাত জোড় করে শ্যামলবাবু ও তাঁর স্ত্রীকে নমস্কার করল। তারপর, কী আশ্চর্য, লোকটার ছায়াটা দিব্যি হেঁটে দরজা অবধি গিয়ে ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে গেল! লোকটা কিন্তু তখনো হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।
সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments