শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৩০ / সালেহা খাতুন
আর আমাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যে আছেন যে ত্রিকালদর্শী মানুষ, যাঁর কথা অনন্তকাল ধরে বললেও শেষ হবেনা তিনি আমাদের স্যার, অধ্যাপক ড. শ্যামল সেনগুপ্ত। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় করতে তিনি নানান উদ্যোগ নিতেন। শুধু পড়াশোনা করলেই তো হবেনা সামাজিক সংযোগ বাড়াতে হবে, সংস্কৃতির সামাজিক দূরত্ব কমাতে হবে। কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের যোগ নিবিড় করতে হবে।
তিরানব্বইয়ের বিশে ডিসেম্বর স্যারের নির্দেশ মতো চলে গেলাম বন্ধু বিশাখার বাড়ি। আমাদের কলেজ ভিন্ন ছিল। ও নরসিংহ দত্ত কলেজে পড়তো। বড়ো ভালো মেয়ে। দৈহিক-মানসিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সুষমায় নির্মিত। কাকিমার সাথে আলাপ হলো। একটা সারাদিন ওর জগাছার বাড়িতে ওর সাথে কাটালাম। অন্তরঙ্গ আলাপে মেতে উঠলাম।
ওর জন্য উপহার স্বরূপ নিয়ে গিয়েছিলাম এ আর রহমানের সঙ্গীতজীবন শুরুর দিকের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র “রোজা”র হিন্দি গানের ক্যাসেট। মণিরত্নম পরিচালিত এই বিখ্যাত চলচ্চিত্র অনেক পুরস্কার লাভ করে। এ আর রহমানও সেরা চলচ্চিত্র সঙ্গীত পরিচালনার জন্য জাতীয় পুরস্কারসহ নানান সম্মানে ভূষিত হন। সারাদিন অনেক গান শুনেছিলাম। বিশাখা খুশি হয়েছিল এ উপহারে। আমরা তখন টেপ-রেকর্ডার ও ক্যাসেট এর উপরই নির্ভর করতাম।
তখন শারদীয়ার সময় প্রায় প্রতিবছর স্যার বিশাখা ও আমাকে অনেক বই উপহার দিয়েছেন। বিশাখার একটি বইয়ের নাম মনে আছে “কালচেতনার গল্প” তবে আমার লম্বা লিস্ট খানার অনেক নামই মনে আছে – মিখাইল শলোকভের “প্রশান্ত দন”, নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির “ইস্পাত”, সুকোমল সেনের “ভারতের সভ্যতা ও সমাজবিকাশে ধর্ম শ্রেণী ও জাতিভেদ” এবং পরিতোষ সরকারের “নকশিকাঁথার জীবন” ইত্যাদি। আর সর্বোপরি স্যারের অমূল্য ব্যক্তিগত সংগ্রহের সমস্ত বই আমি পড়েছিলাম।
🍂
১৯৯৩ এর অনার্স পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় মোটামুটি ভালো ফল করায় স্যার আমাদের পড়াশোনায় নজরদারি আরো বাড়িয়ে দেন। রেফারেন্স বই পড়া বেড়ে যায়। সিলেবাসের বাইরের পড়া তো আছেই। টলস্টয়ের “আনা কারেনিনা” নিজে পড়ে ভ্রনস্কির সঙ্গে গৃহদাহের সুরেশের তুলনা করতে পারি। ইভান তুর্গেনিভের “পিতাপুত্র” পড়ে বাজারভের সঙ্গে মিল খুঁজে পাই। পড়ার যে নেশা, কোনো টেক্সট সমালোচনা করার যে নেশা তখন ধরিয়ে দেন স্যার, তা আজো আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
শারদীয়ার উপহার।
অনার্স পার্ট ওয়ান পরীক্ষার সমস্ত তারিখ এবং পরীক্ষা কেমন হয়েছিল আমার প্রিয় ডায়েরিদ্বয়ে আজো জ্বলজ্বল করছে। তিরানব্বইয়ের সতেরো মে শুরু হয়েছিল পরীক্ষা আর শেষ হয়েছিল আঠারো জুন। কিন্তু পরীক্ষার সময় শান্ত পরিবেশ পাই নি। পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে জোরে লাউড স্পিকার বাজানো আর পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচার মিছিল, মিটিং, বিজয় মিছিল, চেঁচামেচি, হই হট্টগোল, মারপিট সবে মিলে ভীষণ ডিসটার্ব ফিল করেছি। ইতিহাস পরীক্ষার আগের দিন বিজয়ী দলের ফিস্টের জন্য প্রচণ্ড কষ্ট হয়েছিল। না পারি ঘুমোতে না পারি পড়তে। সে এক অসহনীয় অবস্থা। মানুষের আচরণ দেখে অপার বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি। এখনও শব্দ দানবের অত্যাচারে প্রতিনিয়ত জর্জরিত হই। সভ্যতার অগ্রগতিতে লোকে গেল গেল রব তোলে কিন্তু চিরকালই মানুষকে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। পরিবার সমাজ সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে আমাদেরই ক্লাসের অঞ্জনা পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথেই না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিল।
বিতান ও বিশাখার সঙ্গে
আছে দুঃখ আছে মৃত্যু তবুও আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আনন্দের রসদ জুগিয়েছেন স্যার, প্রতি বছর সরস্বতী পুজোর আয়োজন করে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গল্প, নানান কাজে মত্ত থাকতাম আমরা। আমার বন্ধু বিতান শিখিয়েছিল ইলিশ মাছ বেশি ধুতে নেই। শুধু কি তাই? ওর থেকে তাস খেলা শিখেছি, ক্যাসেট আদান প্রদান করে নিত্যনতুন গান শুনেছি। সুমনের গান শোনার সুযোগ বিতানই প্রথম করে দেয়। ঐ যে বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া, আমরা প্রত্যেকেই প্রায় প্রত্যেক বন্ধু বাড়ি গেছি। মা বাবা ভাইবোন সবার সাথে একাত্ম বোধ করেছি। বিশাখার প্রদীপদা মানসদা আমাদেরও দাদা। বিতানের দিদি বোন আমারও দিদি বোন। প্রান্তিকাদির পেন ফ্রেন্ড প্রান্তিকদাকে রাখী বেঁধেছি। আমার ভাইবোন টুকু ও ওবাইকে আমার সব বন্ধুরা চেনে। কীভাবে যে স্যার আমাদের একটা বৃহৎ পরিবার গড়ে দিয়েছেন ভেবে অবাক হই।
(ক্রমশ)
0 Comments