জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৮ /বিজন সাহা

মালিনোভস্কি স্তারিওব্রিয়াদচেস্কি সাবর

ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৮  

বিজন সাহা 

মালিনোভস্কি স্তারিওব্রিয়াদচেস্কি সাবর
 

পেচেরস্কি ভজনেসেনস্কি মনাস্তির থেকে আমরা রওনা হলাম মালিনভস্কি সাবরের দিকে। সেটা অন্য এক গ্রামে, এখান থেকে বেশ খানিকটা অনেক দূরে। এসব জায়গায় জিপিএস মনে হয় ঠিকঠাক কাজ করে না। যাই হোক, সেই গির্জার খোঁজে আমরা চলে গেলাম পাশের গ্রামে। দেখি এক মহিলা গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। আমার মনে পড়ে গেল নিজের গ্রামের কথা। তবে এখন বাংলাদেশের অনেক গ্রামেই আর গরু, লাঙ্গল এসব পাওয়া যায় না। মনে আছে, ২০১১ ও ২০১৪ সালে দেশে গিয়ে অনেক খুঁজেও হাল চাষ করার ছবি তুলতে পারিনি। পরে এ ধরণের ছবি তুলি চেন্নাই গিয়ে, চেন্নাই থেকে পন্ডিচেরি যাবার পথে। যাহোক, সেই মহিলাকে জিজ্ঞেস করে গ্রামের পথ ধরে আমরা চললাম মালিনভস্কি সাবরের খোঁজে। এসে পৌঁছুলাম প্রায় ভাঙ্গা এক গির্জার পাশে। প্রথমে মনে  হয়েছিল গির্জাটা পরিত্যক্ত। যখন এদিক সেদিক ঘুরে ছবি তুলছি তখন এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। পোশাক দেখে বুঝলাম গির্জার পাদ্রী। তিনি মনে হয় দুপুরের খাবার সেরে রেস্ট নিচ্ছিলেন। জানতে চাইলেন কোত্থেকে এসেছি, কিসের খোঁজে। যখন বললাম কথা বলতে চাই, বললেন 

একটু অপেক্ষা করুন, আমি পোশাক বদলিয়ে আসছি।  

আমরা এদিক সেদিক ঘুরে আবার ছবি তুলতে শুরু করলাম। দিলীপ জানালো কি ধরণের তথ্য ও পেতে চায়। এর মধ্যেই উনি ফিরে এলেন। একটু পেছনে এক ভদ্রমহিলা। পরে জানলাম উনি ইউগুমেনিয়া, এখানেই থাকেন। আগে স্বামী স্ত্রী ছিলেন। গির্জায় আসার পর সেই সম্পর্ক এখন নেই। ওনাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা শেষ করে শহরে থাকেন। ওনারা মাঝেমধ্যে সেখানে যান, ওরাও বেড়াতে আসে। নিজে আর্মি অফিসার। একসময় ধর্মের সাথে সম্পর্ক ছিল না যদিও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করতেন না। তারপর এক সময় সিদ্ধান্ত নেন গির্জায় যোগ দেবার। পরে তাঁর স্ত্রী যোগ দিয়েছে তাঁর সাথে। যেহেতু তিনি সন্ন্যাস নিয়েছেন এবং চার্চের নিয়ম অনুযায়ী তিনি বিবাহিত থাকতে পারবেন না, তাই প্রথমে তিনি বিবাহ বিচ্ছেদ করেন। এটা স্তারোভের বা পুরাতনপন্থীদের গির্জা। 

আতিয়েৎস ভ্লাদিমির ও তার ইউগুমেনিয়া

আমার মনে পড়ল ২০১৩ সালের কথা। সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা গেছিলাম ভিলকোভা। এটা ওদেসার পরে, দানিউব ডেল্টায়। এখানে দানিউব নদ কৃষ্ণ সাগরে পড়েছে, ইউক্রেন আর রোমানিয়ার সীমান্তে। সেখানে অনেক পুরাতনপন্থীদের বাস। সাধারণভাবে স্তারোভের বলা হলেও ফর্মাল ও সঠিক নাম স্তারোঅব্রিয়াদচেস্তভো। কারণ সমস্যা বা পার্থক্য বিশ্বাসে নয়, ধর্মীয় আচারে – মানে কিভাবে ক্রুশ আঁকবে এসবে। এই স্তারোভের আসলে রুশ অর্থোডক্স চার্চের অনেকগুলো ধর্মীয় স্রোত ও সংগঠন যারা ১৬৫১ থেকে ১৬৬০ সালে মস্কোর চার্চের প্রধান নিকন ও জার আলেক্সেই মিখাইলোভিচের ধর্মীয় সংস্কার মানতে অস্বীকার করেন। এই সংস্কার ছিল মূলত রুশ উপাসনার পদ্ধতি গ্রীক, বিশেষ করে কনস্টান্টিনোপলের গির্জার উপাসনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং চার্চের সম্পদ রাষ্ট্রের স্বার্থে দান করা। ১৬৫০ থেকে ১৬৮০ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মস্কোর উপাসনালয়গুলো ধর্মীয় আচারের সংশোধন গ্রহণ করে। যারা এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করে ১৬৫৬ সালে এবং ১৬৬৬-১৬৬৭ সালের মস্কো গির্জার সম্মেলনে তাদের অভিশাপ দিয়ে গির্জা থেকে বের করে দেয়া হয়। সম্রাজ্ঞী ইয়েকাতেরিনা প্রথম তাদের ভিন্নমতাবলম্বী বলে উল্লেখ করেন। ১৭৮৮ সালে ভিন্নমতাবলম্বীর পরিবর্তে স্তারোঅব্রিয়াদৎসি বলে উল্লেখ করা হতে থাকে। তবে ১৮০৩ সালে আবার ভিন্নমতাবলম্বী নাম অফিসিয়ালি ফিরে আসে। জারের আমলে কী রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ, কী জারের প্রশাসন দুটোই স্তারোভেরদের কড়া নজরে রাখত। বিংশ শতাব্দীতে রুশ চার্চ স্তারোভেরদের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান অনেকটা নরম করে। ১৯৭১ সালে মস্কো চার্চ ১৬৫৬ ও ১৬৬৭ সালের অভিশাপ তুলে নেয়। 

গির্জার ভেতরে গল্পরত আমরা

জারের আমলে এই চার্চ জারের বিরুদ্ধে ছিল, তবে বর্তমানে মূল রুশ চার্চের মত এদেরও রুশ সরকারের সাথে এক ধরণের চুক্তি আছে। মানে যদিও এ দেশে ধর্ম মানে চার্চ বা অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন, তবে সব ধর্মই সরকার থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পায় এবং তারাও সামাজিক শান্তি বজায় রাখতে সরকারকে সাহায্য করে। মালিনভস্কির এই গির্জা শতাধিক বছর আগে তৈরি। এদের বিভিন্ন পার্থক্যের একটা হল ক্রুশে – রুশ চার্চে ক্রুশে যীশুর ক্রুসিফাইয়ের ছবি আছে, এদের সেটা নেই। এই চার্চের প্রধান কিভাবে এই বিশ্বাসে এলেন জিজ্ঞেস করায় বললেন – এটা হঠাৎ করেই ঘটে গেছে। তিনি আগে রুশ অর্থোডক্স চার্চ দ্বারাই ব্যাপ্টাইজড হয়েছিলেন। তাঁর মতে তখন ঠিক নিয়ম অনুযায়ী তাকে ব্যাপ্টাইজড করা হয়নি, কারণ তাঁর গায়ে শুধু পুণ্য জল ছিটিয়ে দেয়া হয়েছিল যদিও উচিৎ ছিল ডুবিয়ে স্নান করানো। এরপর তিনি যখন পোশাক বদলাতে শুরু করেন ক্রসটা মাটিতে পড়ে হারিয়ে যায়। অনেক খুঁজেও সেটা না পেয়ে তিনি একটি নতুন ক্রস কেনেন যেখানে যীশুর ক্রুসিফাইয়ের ছবি ছিল না। সেটা ছিল ৎসারগ্রাদ বা ক্রাস্নোদারে তৈরি ক্রুস। পরে তিনি যখন নিঝনি নভগোরাদের একজন পুরোহিতের সাথে পরিচিত হন, তিনি তাকে বলেন সেটা আসলে স্তারোভের ক্রস। তিনি নিজে ছিলেন স্তারোভের। তিনি প্রস্তাব দেন তাকে নতুন করে ব্যাপ্টাইজড করার। এভাবেই তিনি অনেকটা কাকতালীয় ভাবে এই স্রোতে ঢুকে যান। 

বর্তমানে রাশিয়ায় এদের প্রায় ১০০ গির্জা আছে। এছাড়াও রোমানিয়া, বুলগেরিয়া – এসব দেশেও তাদের চার্চ আছে। বিপ্লবের পর এদের অনেকেই ল্যাটিন আমেরিকায় চলে যায়। ব্রাজিল, বলিভিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে এখন অনেকেই ফিরে আসতে শুরু করেছে। অন্য দিকে চেষ্টা করা হচ্ছে দুই গির্জার মধ্যে মতবিরোধ দূর করার। চার্চের ভাঙ্গনের পরে মস্কো ও পিটারবারগ থেকে অনেকেই ভোলগা এলাকায় পালিয়ে আসে। এক সময় এখানে এদের ৪০ টির মত প্রিখদ বা আশ্রম ছিল। এলাকার ধনী ব্যবসায়ী বুগরভ এই জায়গা কেনেন আর ১৯০৩ সালে এই সাবর তৈরি করা হয়। ওনার কাছ থেকে গির্জা সম্পর্কে অনেক তথ্য পেলাম। ৎসেরকভ বা গির্জায় থাকে তিনটে গম্বুজ। গম্বুজের সংখ্যা ৬ হলেই সেটাকে সাবর বলে। এই সাবরের গম্বুজ সংখ্যা ১৩ - যীশু ও বার জন আপস্টল বা প্রেরিত পুরুষের, অর্থাৎ যারা যীশুর সরাসরি শিষ্য ছিলেন তাহের প্রত্যকের জন্য। এই মালিনভস্কি গ্রাম বা স্কিত আসলে যারা স্তারোভের তাদের জনপদ। নিজেদের জমিতে ফসল ফলান, মৌমাছি মধু দেয় আর আছে ভক্তদের অনুদান। তাদের খুব ইচ্ছে এটাকে মনাস্তিরে পরিণত করা যাতে স্তারোভের লোকজন এখানে থাকতে পারে। যদি ক্যাথলিক ও অর্থোডক্স চার্চের অনুষ্ঠান বিভিন্ন দিনে হয় স্তারোভের ও রুশ অর্থোডক্স চার্চের সব ধর্মীয় অনুষ্ঠান একই দিনে হয়। তবে রুশ অর্থোডক্স চার্চে অনেক নতুন সন্তের আবির্ভাব ঘটেছে যাদের এরা স্বীকার করে না। রোমানভ বংশের শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাইকে সন্তের সম্মান দিয়েছে রুশ অর্থোডক্স চার্চ। তারা এটাকে স্বীকৃতি দেন না বরং রাশিয়ার দুর্ভোগের জন্য শেষ জারকে দায়ী করেন। আরও জানালেন যে মস্কোয় তাদের চার্চের সেমিনারি বা স্কুল আছে যেখানে যারা এই চার্চের সাথে নিজেদের জড়াতে চান তারা শিক্ষা নিতে পারেন। ওনারা দুজন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাদের গির্জার সব কিছু দেখালেন, বর্ণনা করে শোনালেন। খুবই আন্তরিক ছিল তাদের ব্যবহার। বোঝা গেল এদিকটায় খুব কেউ একটা আসে না। বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে আমরা চলে এলাম। চলে আসার সময় তারা দিলীপকে এক বয়ম ভর্তি মধু দিলেন আর আমাকে দিলেন তাদের ঠিকানা যদি কেউ তাদের সাহায্য করতে চায় সেই আশায়। এখন আমি প্রায়ই ভাবি, কেন তখন ওদের কাছ থেকে কয়েক লিটার মধু কিনলাম না? গির্জার মধু খাঁটি বলে সুনাম আছে।    

মালিনভস্কি সাবরের কিছু ছবি 

http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=251

ভিডিও

https://www.youtube.com/watch?v=hcwPRK940-A&t=670s


Post a Comment

0 Comments