পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ১০০
রালদুর্গা ব্রত
ভাস্করব্রত পতি
'ওড় ফুল যোড় কলা, রক্তচন্দন জবার মালা
ঘিয়ের প্রদীপ তামার টাটে থুয়ে
অর্থ দিলেন দিবাকরে।
এই বোল বলিয়ে,
ভক্তিভাবে প্রণাম করিলে তুয়া পায়,
মনোবাঞ্ছা সিদ্ধ করেন প্রভু দেবরায়'।।
অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন -- এই চার মাস ধরে পালন করা হয় রালদুর্গার ব্রত। সধবা মেয়েরাই এই ব্রত করার অধিকারিণী। যাবতীয় মনোবাঞ্ছা পূরণ কিংবা সুখ সম্পদ সহ অতুল ঐশ্বর্য কামনায় এই লৌকিক উৎসবের উদযাপন হয়।
'রাখ' অর্থে রক্ষা করা।
সংস্কৃত রক্ষ >প্রাকৃত রকখ > বাংলা রাখ
হিন্দি - র (রা)খ, গুজরাটি, মারাঠি - রাখ, ওড়িয়া, অসমীয়া -- রাখ, রাহ, পাঞ্জাবী -- রকখ
রাখআল, রাখোআল, রাখোয়াল অর্থে রক্ষাকর্তা বোঝায়।
রাখ ওয়াল > রাখোয়াল
রাখওয়াল দুর্গা > রালদুর্গা > রাখদুর্গা
রালদুর্গার ব্রত উদযাপনে ১৭ টি ধান এবং ১৭ টি দূর্বা নিয়ে কলাপাতায় অর্ঘ্য সাজিয়ে তাতে সিঁদুর, লালচন্দন, ওড়ফুল, জোড়া কলা এবং জবাফুলের মালা ইত্যাদি সাজানো হয়। পূজার এইসব সামগ্রী নিয়ে তামার একটি পাত্রে ঘট বসাতে হয়। তারপর ঐ ঘটে ১৫ দিন ধরে প্রত্যেক দিন জল আর ফুল দিতে হয়। ঐ দিনগুলিতে ১৭ মুঠো চালের শুধু ভাত খেয়ে থাকার বিধান। পৌষ মাসেও পুজো করে ১৭ মুঠো চালের পায়েস করে খেতে হয়। এরপর মাঘ মাসেও পুজো করে ১৭ মুঠো চালের পিঠেপুলি করে খাওয়ার নিয়ম। টানা চার বছর ধরে এইভাবে ব্রত পালন করার শেষে সূর্য দেবতার কাছে প্রার্থনা জানায় মহিলা ব্রতীনীরা।
রালদুর্গার বা রাখ্দুর্গার ব্রত সম্পর্কে ড. শীলা বসাক লিখেছেন, 'অগ্রহায়ণ মাসের অমাবস্যার দিন ১৭ গাছি ধান ও ১৭ গাছি দূর্বা সংগ্রহ করে রেখে দিতে হয়। পূর্ণিমার দিন এই ব্রত পালন করা হয়। অগ্রহায়ণ মাস থেকে শুরু করে ফাল্গুন মাস অবধি অর্থাৎ চারমাস এই ব্রত পালন করার নিয়ম। এই ব্রতের জন্যে অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হল লালফুল, জবাফুলের মালা, জোড়াকলা, রক্তচন্দন, কাঁচা দুধ, সিঁদুর, চিনি, চাঁপাকলা। পৌষমাসে পুজো করে ১৭ মুঠো চালের পায়েস খেতে হয় এবং মাঘ মাসে পুজো করে ১৭ মুঠো চালের পিঠে পুলি করে খেতে হয়। চার বছর ধরে এই ব্রত উদযাপন করতে হয়। সধবা নারীরা সুখ সম্পদ বা অতুল ঐশ্বর্যের কামনায় এই ব্রত পালন করে'।
কিভাবে প্রচলিত হল রালদুর্গার ব্রত? এই নিয়ে যে কাহিনীর সন্ধান মেলে, তা হল এরকম -- একসময় চিত্রকূট পর্বতে নারায়ণ এবং লক্ষ্মী একসঙ্গে বসে পাশা খেলছিলেন একান্তে। ঠিক সেই সময় এক সুপুরুষ ব্রাহ্মণ সেখানে এসে ফুল তুলতে লাগলেন। এদিকে নারায়ণ ও লক্ষ্মী নিজেদের মধ্যে পাশা খেলায় কেউ কাউকে হারাতে পারছিলেননা। তখন লক্ষ্মী নারায়ণ ঐ ব্রাহ্মণকে ডেকে বললেন, 'আপনি কি পাশা খেলতে পারেন'? ব্রাহ্মণ তখন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। অর্থাৎ, সে জানে পাশা খেলতে। নারায়ণ তখন বললেন, 'তবে আমার সঙ্গে পাশা খেলবেন আসুন। কিন্তু যদি আপনি আমাকে পাশা খেলায় হারিয়ে দেন, তবে আমি আপনাকে কুষ্ঠ রোগী বানিয়ে দেবো'। আর লক্ষ্মী বললেন, 'পাশা খেলায় আমাকে হারিয়ে দিলে আমি আপনাকে ভস্ম করে দেবো'।
ব্রাহ্মণ তখন পড়লেন মহা ফাঁপরে। 'জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ' সুলভ অবস্থা। তখন দু'জনেরই কথা শুনে ব্রাম্ভণ মনে মনে ঠিক করলেন যে, ভস্ম হয়ে একেবারে হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে কুষ্ঠ রোগ সাথে নিয়ে টিকে থাকা অনেক শ্রেয়। তখন ব্রাম্ভণ বললেন, 'আমি ভস্ম হয়ে যেতে চাই না। কুটেই হব'। পাশা খেলায় নারায়ণ হেরে গেলেন ব্রাম্ভণের কাছে। আর সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণকে শাপ দিয়ে নারায়ণ বললেন, 'ওহে ব্রাম্ভণ, আপনাকে অভিশাপ দিলাম আপনি এখন থেকেই কুষ্ঠ রোগী হয়ে পাহাড়ের নীচে পথের ওপর পড়ে থাকুন'। ভীত ব্রাহ্মণ তখন করুণভাবে নারায়ণকে জোড়ো হাতে বললেন, 'হে হরি, আপনার অভিশাপ আমি মাথায় তুলে রাখলাম। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর রোগ থেকে কিভাবে মুক্তি পেতে পারি? সেই পথ আপনি বলে যান'।
তখন নারায়ণ সদয় হলেন ব্রাম্ভণের ওপর। বললেন, 'ঐ দেশের রাজার মেয়ে মঞ্জুমালা প্রতিদিন ঐ পথ দিয়ে শিবমন্দিরে পুজো করতে যায়। সে যদি কখনও আপনাকে বিয়ে করে, তখনই আপনার মুক্তি হবে। উদ্ধারার হবে'। তারপর থেকে ব্রাহ্মণ, সমস্ত শরীরে কুষ্ঠব্যাধিতে জর্জরিত হয়ে পথের ওপর শুয়ে পড়ে রইল। পথচারীরা কেউই তাঁর দিকে তাকালোই না। সকলেই তাঁকে এড়িয়ে যেতে থাকলো। গায়ের উপর দিয়েই ডিঙিয়ে চলে যায় সবাই।
একদিন রাজকন্যা মঞ্জুমালা শিবমন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার সময় কষ্ঠ আক্রান্ত ব্রাহ্মণকে ওইভাবে পথের ওপর পড়ে থাকতে দেখে খুব মায়া হল। মঞ্জুলিকা বললো, 'ওহে ব্রাম্ভণ ঠাকুর, আপনি রাস্তা থেকে একটু সরে বসুন। আমায় ঐ পথ দিয়ে পুজো করতে যেতে হবে'। তখন ব্রাহ্মণ বললেন, 'সবাই তো আমাকে ডিঙিয়েই যাতায়াত করছে। তুমিও তাই করো'। রাজকন্যা তখন বললেন, 'এটা অসম্ভব। একজন ব্রাহ্মণকে ডিঙিয়ে আমি পাপের ভাগীদার হতে চাইনা। আপনি বরং রাস্তা থেকে একটু সরে বসুন। আমি সাবধানে চলে যাই'। ব্রাহ্মণ'। ব্রাহ্মণ বললেন, 'এক শর্তে আমি রাস্তা থেকে সরে যেতে পারি'। রাজকন্যা তখন শর্ত মানতে সম্মতি দিল।
কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্রাহ্মণ তখন শর্ত হিসেবে বললেন, 'আমাকে তোমায় বিয়ে করতে হবে'। তখন রাজকন্যা বললেন, 'আমি যখন সম্মতি দিয়েছি শর্ত মেনে চলবার, তখন তার অন্যথা হবেনা। আমি আপনাকেই বিয়ে করব, আপনিই আমার স্বামী'। ব্রাহ্মণ তখন রাজকন্যার যাতায়াতের জন্য পথ ছেড়ে দিলেন। তখন আর ব্রাম্ভণকে ডিঙিয়ে যেতে হলনা।
রাজকন্যা মঞ্জুমালা পুজো সেরে বাড়ি ফিরে রাজাকে বললেন, 'বাবা! আপনি একটা স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করুন। আমি সেখানে এক কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্রাহ্মণের গলায় মালা দেবো'। রাজকন্যার কথা শুনে রাজা তো তাজ্জব। তাঁর একমাত্র মেয়ে বলে কি! কোথায় ধুমধাম করে ভালো সুদর্শন পাত্র ঘরে আনবেন, সেখানে সে কিনা একজন কুষ্ঠরোগীকে বিয়ে করতে চাইছে! তাঁকেই স্বামী বলে স্বীকার করবে! তখন রাজাও প্রতিজ্ঞা করে জানিয়ে দিলেন, 'তোমার কথাই মেনে নিলাম। কিন্তু আমিও তোমাদের দুজনকে বনে পাঠিয়ে দেবো। রাজবাড়িতে রাখবোনা'। '।
যথারীতি পরের দিন রাজবাড়িতে স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করা হল। নানা জায়গা থেকে রাজা ও রাজপুত্রের দল এই স্বয়ম্বর সভায় এলেন। রাজকন্যা অনড়। কোনোদিকে দৃষ্টি না দিয়ে সরাসরি পথের ধারে গিয়ে সেই কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্রাহ্মণের গলায় মালা পরিয়ে দিলেন। রাজকন্যার এই রকম অদ্ভুত আচরণ দেখে সবাই অবাক! এ কি হল? সেখানে যেসব রাজা ও রাজপুত্রেরা এসেছিলেন, তাঁরা সবাই রেগে অগ্নিশর্মা।খুব করে রাজাকে অপমান করে তাঁরা যে যাঁর রাজ্যে ফিরে গেলেন। বিয়ের পর রাজাও তাঁর প্রতিজ্ঞা মোতাবেক মঞ্জুমালাকে তাঁর নববিবাহিত স্বামীর সঙ্গে বনে পাঠিয়ে দিলেন।
বনবাসে গিয়ে রাজকন্যার দিন কাটতে লাগলো খুব দুঃখ এবং কষ্টে। প্রতিদিন সে ভগবানের কাছে চোখের জল ফেলে কাতরস্বরে বলতে থাকে, 'ভগবান! আমি তো কখনও কোনো অন্যায় করিনি। তবে আমার এ দুঃখ দুর্দশা কেন? কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছো? আমাকে এই যাঁতাকল থেকে উদ্ধার করে দাও'।
দিন গড়াতে থাকে দ্রুত। সময় কাটতে থাকে নদীর স্রোতের মতো। একদিন স্বপ্নে রাজকন্যা দেখলেন যে, সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে এক উজ্জ্বল দেবতা তাঁর সামনে এসে বলছেন, 'তুই অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা থেকে রালদুর্গার ব্রত কর। তোর সব দুঃখ কষ্ট সব দূর হয়ে যাবে'। তখন অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমার দিন রাজকন্যা খুব ভক্তির সঙ্গে রালদুর্গার ব্রত পালন শুরু করল। পুজোর শেষে সূর্যদেব দেখা দিয়ে বললেন, 'আমি তোর পুজোয় সন্তুষ্ট হয়েছি। এখন বল তোর কি দরকার'?
রাজকন্যা বললেন, 'হে প্রভু, আমার স্বামীর রোগ সারিয়ে দিন, আমি আর এই কষ্ট সহ্য করতে পারছি না'। তখন সূর্যদেব বললেন, 'পুজোর অর্ঘের জল তোর স্বামীর গায়ে মাখিয়ে দিস্। দেখবি তখন তোর স্বামীর সব রোগ সেরে যাবে। কুষ্ঠ ব্যাধি থেকে তাঁর চিরমুক্তি ঘটবে। সেই সাথে তোরা অগাধ ধন সম্পদের অধিকারী হবি'।
এই পরেই সূর্যদেবের বরে ব্রাহ্মণের কুষ্ঠ রোগ সেরে গেল। সে হয়ে উঠল এক অতি সুপুরুষ আর অগাধ ঐশ্বর্য্যশালী রাজা। এই পরিবর্তনের পরে রাজকন্যা মঞ্জুমালা একদিন তাঁর রাজ্যের মন্ত্রীকে তাঁর বাবার কাছে পাঠিয়ে বাবাকে আমন্ত্রণ জানালো। মঞ্জুমালার মা ও বাবা তাঁর কাছ থেকে তাঁদের এই ঐশ্বর্য্য কিভাবে হলো, জানতে চাইলেন। মঞ্জুমালা তখন সব খুলে বললেন। রালদুর্গার ব্রত পালনের ফলেই সব বিপদ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। এরপর সংসারের নানা সুখভোগ এবং ঐশ্বর্য্য পাওয়ার পর মঞ্জুমালা এবং তাঁর স্বামী রালদুর্গার মাহাত্ম্য প্রচার করে মারা গেল। সেই থেকে মহিলারা এই রালদুর্গার ব্রত পালন করতে শুরু করে অতুল ঐশ্বর্যের কামনায়।
🍂
0 Comments