ছড়া ছন্দসী নিয়ে দু'চার কথা
আবীর ভট্টাচার্য
ছন্দ সৃজনের যে কয়েকটি কৃৎকৌশল জানা আছে, ছড়া রচনা তার মধ্যে কঠিনতম বলেই মানি। সহজ কথায় গভীর ভাবনার এই পদ্যআঙ্গিক সুকুমার রায়, সসত্যেন্দ্রনাথ দত্তের যাদু কলম পেরিয়ে বাংলা সাহিত্যের আনাচে কানাচে যে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল, মায়া দে'র বইটি তারই সাক্ষ্য বহন করে।
জ্বলদর্চি প্রকাশিত “ছড়া-ছন্দসী “ নামের প্রায় আশি পাতার এই বইটির পরিবেশক শব্দরঙ, কাঁথি শহরের। প্রচ্ছদশিল্পী সুরজিৎ সিনহা, নামাঙ্কন শুভ্রাংশু শেখর আচার্য, লেখিকার নাম মায়া দে। ঝকঝকে ছাপা, নির্ভুল বানান, সুঠাম সজ্জায় বিন্যস্ত তিপান্নটি ছড়া লেখনী সমৃদ্ধ বইটি জ্বলদর্চির আগের সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছে,বলাই বাহুল্য।
তবে প্রথমেই যে কথা বলতে হয়, বইয়ের প্রচ্ছদটি বেশ চিত্তাকর্ষক; আদিগন্ত শ্যামল প্রকৃতির পটভূমিকায় দুটি হাস্যোজ্জ্বল শিশু, যেন কবেকার সেই ভুলে যাওয়া শৈশবের সুগন্ধি এই পড়ন্ত বেলায়ও খুশি ছড়িয়ে যায়। তাই বইটি হাতে নিতে না নিতেই পাঠক এক সুখের রাজ্যে প্রকাশ করেন, এবং সৌভাগ্যের কথা এই যে, বইটিতে সঙ্কলিত ছড়াগুলির পঠনসুখে সেই খুশি মন ভরিয়ে উপছে পড়ে যেন।
এবার আসি লেখিকার কথায়। একেবারে প্রথমেই তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি… . “ ছড়া হলো ছন্দে গড়া। আজগুবি, উদ্ভট, অসম্ভব, অতি হাস্যকর, অতি বাস্তব, অতি অবাস্তব সবকিছু নিয়েই ছড়ার চলন- গমন। মনের এক প্রগাঢ় রসবোধ থেকে ছড়ার সৃষ্টি। রসিক জনের কাছে ছড়া কেবল মজার বিষয় শুধু তা নয়, ছড়া মনের আরাম, মনের আনন্দ। ছড়া মন খারাপের মলম। সকলেই ছড়াকে সঙ্গী করে এক অনাবিল আনন্দ মুখর ছন্দময় জীবন কাটাতে পারেন। তাই আমি মায়া দে, ছড়াকার হিসেবে আমার প্রচেষ্টা, ছড়াকে সকলের মনের অন্দরে পৌঁছে দেওয়া। এই প্রচেষ্টা যদি সার্থকতা পায়, তবে আমার "ছড়া ছন্দসী" এই ছড়ার বই প্রকাশ ও সার্থকতা পাবে।”... এই কথা কয়টি ছড়াপাঠের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে, শুরু হয় পড়া।
প্রথমেই বলেছি, বইটির সুষম সজ্জা,ছড়া নির্বাচন ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়তা, ছড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আঁকিবুকির কথা,যেগুলি বইটিকে এক অনন্য উচ্চতা দিয়েছে। প্রথম ছড়াটি,
“ছড়া মানেই খোলা আকাশ
ছড়া মানেই ছুট
ছড়া মানেই আকাশ কুসুম
মজার হরির লুট।
ছড়া মানেই ফুল পরীরা
ছড়া মানেই পাখি ছড়া মানেই
লাগামছাড়া স্বপ্ন মাখামাখি।
ছড়া মানেই আয় ছুটে আয়
মন খারাপের দল
ছড়া মানেই ছন্দ হাজার
হাসছে খলোখল
ছড়া মানেই তুই আর আমি
দেখ না কত মিল
ছড়া মানেই আজগুবি
সব খেয়াল রসের দিল।
ছড়া মানেই কচি মুখেদের থমকে থেমে বলা
ছড়া মানেই মজা করে মিষ্টি করে বলা।”… আমাদের মানসিক ছন্দ এবং পাঠসক্ষমতা বেঁধে দেয়, এগোয় পঠন।
বিশেষতঃ ননসেন্স পোয়েম্স-এর যে সুকুমারীয় মধু-ধারণা, তার সুপ্রযুক্তি দেখিয়েছেন কবি তাঁর সুচারু কিন্তু সীমিত ক্ষমতায়। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আমরা একটার পরে একটা পড়ে যাই শৈশবের ছেলেমানুষী আবেশ মেখে, ‘বৃষ্টি যখন পড়ে’, ‘ওরে বাবা ভূত যে’, ‘হনুমান’,’বর্ষার ব্যাঙ’, ‘ঘুম পাড়ানিয়া গান’, ‘ব্যাটা খুব বেয়াকুব’….
হঠাৎ থমকে যাই, পঁচিশ পাতার
“কে বলে নেই”... ছড়াটিতে,
বিশ্বজোড়া নজর কাড়া ফুটবলের যুবরাজ
কাঁদো বিশ্ব কাঁদো তুমি হারালে কাকে আজ। আর্জেন্টিনার ফুটবলার ফুটবলের মারাদোনা
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ বিশ্ববাসীর জানা।
জ্বলে রোশনাই বাজে দামামা মেক্সিকো ময়দান ম্যাজিক দেখছে তামাম দুনিয়া লড়িয়ে দিচ্ছে জান। ঈশ্বর রূপী "হ্যান্ড অফ গড" সেদিন দেখেছে বিশ্ব একক ক্ষমতার প্রভাব ৯০। ২০২০ তে করলে নিঃস্ব।
আলোর দেশে দিয়েছো যে পাড়ি ফুটবলের যুবরাজ তোমার ঘামের গন্ধ মাখা জার্সি যে কাঁদে আজকে
মহা তারকার মহাপ্রয়াণ শূন্য যে ময়দান
কে বলে নেই? আছো হৃদয়ে বিশ্বনন্দিত প্রাণ।
আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়ি, সাধারণ ভাষায় কি অপুর্ব শ্রদ্ধা প্রদর্শন,কি অপুর্ব কাব্য প্রকাশ!
এমনি করেই খুশির দোলায় নাচতে নাচতে ভেসে চলে আমাদের সেই আদরের মননৌকো, ‘পড়াশুনা ভাল্লাগে না’, ‘ঝামেলা’, ‘হাঁচি’,’চড়াইবৌ’ ও আরও বাকি সব ছড়ার পঠনসুখে। যার শেষ হয় বিদ্যাসাগর ছড়াটিতে
… মেদিনীপুরের খাঁটি রত্ন সবার হৃদয় মণি
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামেই যারে চিনি।
দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর তুলনা তার নাই
আর্ত মানুষে করেছো সেবা হৃদয়ে দিয়েছো ঠাঁই।
এক আকাশে এক চন্দ্র ঈশ্বরচন্দ্র তুমি
জ্ঞানের আলোয় করেছ পূর্ণ ধন্য স্বদেশ ভূমি। বর্ণপরিচয়, বোধোদয় আর কথামালা কত বই
বাংলা ভাষা পুষ্ট হল তোমার ছোঁয়া পেয়েই।…
কবির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রণামও নিবেদিত হয়, একাত্ম বোধ করি লেখিকার সঙ্গে, সার্থক হয় তাঁর কাব্য নির্মাণ।
সবশেষে বলার কথা এই যে, অধুনা গ্লোবালাইজেশনের ব্যস্ততায় এবং চটজলটি সবকিছু হাতের মুঠোয় পাওয়ার সৌজন্যে আমাদের ধৈর্য বড়ো কম পড়ছে, বই পড়ার অভ্যেস প্রায় তলানিতে। স্বাভাবিক ভাবেই বাংলা প্রকাশনাও বেশ সমস্যায়। তবু তারই মধ্যে জ্বলদর্চির মতো কিছু সৎ এবং নিবেদিতপ্রাণ প্রকাশক ছোট বড় লেখনীর সন্ধান করছেন, প্রকাশ করছেন নিয়মিত, এ যেন ঘনায়মান অন্ধকারে নিস্কম্প প্রদীপ জ্বালাবার মতোই পূণ্যশ্রম। আসুন সবাই আবার পড়ার অভ্যেসে ফিরি, ‘মায়া দে’-এর মতো আরও লিখনশ্রমিক পাদপ্রদীপের আলোয় আসুন, আলো ঝলমলে লোক রঙ্গের নিভৃতে রূপকথার চাটুই বিছিয়ে কবে সেই ফেলে আসা শৈশবের ঠাকুমার পান খাওয়া মুখে সেই ছেলেভোলানো ছড়াগুলি আওড়াই অথবা শুনি মনে মনে, অযুত সমস্যা ও বিক্ষোভের মাঝে সে হোক আমাদের স্বস্তিসুধার আশ্রয়, আমাদের মনোহর প্রাপ্তি… লেখিকার কাছে আশা করে রইলাম এমন আরও শান্তি পারাবারের, যে খোঁজ তিনি দিলেন তাঁর “ছড়া-ছন্দসী”-এর ছত্রে ছত্রে… শুভমস্তু।
🍂
0 Comments