জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৯/বিজন সাহা

নভগোরাদে কুজমা মিনিন ও দ্মিত্রি পঝারস্কির স্ট্যাচু

ভোলগা নদীর খোঁজে – ২৯

বিজন সাহা 

নিঝনির মানুষ 

কোন দেশ বা শহর বা জনপদ শুধু সেখানকার দালানকোঠা বা প্রকৃতি নয়, তার মানুষ। এই মানুষই কোন জায়গাকে বিশেষ করে। তভের সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমরা যেমন আফানাসি নিকিতিনকে এড়িয়ে যেতে পারিনি, একই ভাবে নিঝনি নভগোরাদের কথা বলতে গিয়ে আমরা কিছু নাম এড়িয়ে যেতে পারব না। এর মানে এই নয় যে এদের বাইরে উল্লেখ করার মত কেউ নেই, তবে আমরা এখানে মাত্র কয়েকজনের মধ্যেই আমাদের গল্প সীমাবদ্ধ রাখব। আমার ধারণা এরা সবাই রাশিয়ায় ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মাক্সিম গোর্কি ও ভালেরি কচালভের কথা স্বল্প পরিসরে আমরা ইতিমধ্যেই বলেছি। এখন আরও কয়েক জনের কথা বলব যাদের দু’জন চার শ’ বছর আগে ইতিহাস গড়েছেন আর কেউ কেউ আমাদের সমসাময়িক।   

রাশিয়ার ইতিহাস নিয়ে বলতে গিয়ে বার বার এসেছে দুটো নাম – কুজমা মিনিন ও যুবরাজ পঝারস্কি। মনে হয় তাদের সম্পর্কে একটু না বললে পাঠকদের তো বটেই, তাদের প্রতিও অবিচার করা হবে। কারণ রিউরিক ও তাঁর বংশধররা রুশ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করলেও আজকে যে রাশিয়া আমরা দেখি সেটা তৈরি হয়েছে প্রথমে রোমানভ বংশ ও পরে সোভিয়েত শাসকদের হাতে। মোঘল শাসন, ব্রিটিশ আমল ও আধুনিক ভারতের সাথে তুলনা করলে রোমানভ বংশের শাসনামলকে মোঘল আমলের সাথে তুলনা করা যায়। ভারতে মোঘল শাসনের শুরু ১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, এদেশে রোমানভ শাসন শুরু ১৬১৩ সালে। আর এই রোমানভ বংশ রাজনৈতিক মঞ্চে এসেছে এই দুজনের হাত ধরেই। 

নিঝেগোরাদ ক্যাথলিক চার্চ

কুজমা মিনিনের শৈশব সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তাঁর পুরা নাম কুজমা মিনিচ মিনিন, কুজমা মিনিচ কসোরুকি বা কুজমা মিনিচ জাখারেভ সুখরুকি। জন্ম ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আর মৃত্যু ১৬১৬ সালের ২১ মে। তিনি ছিলেন ১৬১১ – ১৬১২ সালে পোলিশ ও লিথুনিয়ানদের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থানের সংগঠক ও নেতাদের একজন। নির্ভরযোগ্য ভাবে যা জানা যায় তা হল সপ্তদশ শতকের শুরুতে তিনি নিঝনি নভগোরাদে একটি দোকান খুলে মাংসের ব্যবসা শুরু করেন। ১৬০৮ – ১৬১০ সালে স্থানীয় মিলিশিয়ায় সাথে যোগ দিয়ে তিনি দ্বিতীয় নকল দ্মিত্রির অনুসারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এর মধ্য নিয়ে নভগোরাদের মিলিশিয়া শুধু শত্রুদের পরাজিতই করে না, প্রয়োজনীয় যুদ্ধ পারদর্শিতা অর্জন করে। ১৬১১ সালের শরতে নিঝনি নভগোরাদে এক নাগরিক সভায় পাত্রিয়ারখ গেরমোগেনের প্রশংসাপত্র পড়ে শোনালে সবাই কুজমা মিনিনের বীরত্বের কথা জানতে পারে। এর ফল স্বরূপ তাঁকে শহরের স্তারস্তা বা প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এরপর থেকে নিঝনি নভগোরাদে প্রায়ই জনসভা হতে থাকে যেখানে হানাদারদের হাত থেকে রাশিয়াকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়। কোথায় লোক ও অর্থ পাওয়া যাবে এসব প্রশ্ন নিয়ে সবাই কুজমা মিনিনের কাছে আসে, তিনি তাদের সাথে নিজের পরিকল্পনার কথা বিস্তারিত জানান। নতুন করে মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আর যুবরাজ দ্মিত্রি পঝারস্কিকে এই নতুন মিলিশিয়ার প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তাঁর দিক থেকে পঝারস্কি নিজে কুজমা মিনিনের উপর মিলিশিয়ার অর্থনৈতিক বিষয়ের দায়িত্ব দেবার প্রস্তাব করেন। 

যুবরাজ দ্মিত্রি মিখাইলোভিচ পঝারস্কসি ১৫৭৮ সালের ০১ নভেম্বর প্রাচীন রুশ অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সেনানায়ক, রুশ জাতীয় বীর, সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় গণ মিলিশিয়ার প্রধান যার নেতৃত্বে পোলিশ ও লিথুনিয়ান হানাদারদের কবল থেকে মস্কো মুক্ত করা হয়েছিল। জার ইভান গ্রজনির মৃত্যুর পর ১৫৯৩ সালে যুবরাজ দ্মিত্রি মিখাইলোভিচ নতুন শাসক বরিস গদুনভের রাজদরবারে কাজে নিযুক্ত হন। বরিস গদুনভের মৃত্যুর পর ১৬০৫ সালের ১৩ এপ্রিল ক্ষমতা দখল করে নকল দ্মিত্রি। আসলে ইভান গ্রজনির পুত্র দ্মিত্রি উগলিচে নিহত হন। পরে এই দ্মিত্রি নিজেকে যুবরাজ দ্মিত্রি বলে ঘোষণা করে। তাই রুশ ইতিহাসে সে নকল দ্মিত্রি বা লঝেদ্মিত্রি নামে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে সে ছিল পোল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জিগমুন্ডের লোক। মস্কো শহর ও অভিজাতদের দুমা বা পার্লামেন্ট ইতিমধ্যেই তৃতীয় জিগমুন্ডের বশ্যতা মেনে নিয়েছিল। এই সময় পঝারস্কি নকল দ্মিত্রির প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন, এমনকি তাঁর বিয়ের সময় পোল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতের সাথে একই টেবিলে বসেন। ১৬০৬ সালের ১৬ মে নকল দ্মিত্রি নিহত হলে যুবরাজ ভাসিলি ইভানোভিচ শুইস্কি মস্কোর জার হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন। পঝারস্কি নতুন জারের বশ্যতা মেনে নেন। পঝারস্কির সততা, বিনয়, ন্যায়পরায়ণতা, দানশীলতা, রুশ দেশের প্রতি আনুগত্য, সাহস, আত্মত্যাগ, প্রয়োজনে কঠোরতা এবং পিতৃভূমির শত্রু ও বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি ক্ষমাহীন মনোভাব তাঁকে সাধারণ মানুষ থেকে অভিজাত, ছোট বড় সবার কাছে প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য করে তোলে। আর সে কারণেই নভগোরাদের মিলিশিয়া তাঁকে নিজেদের নেতা নির্বাচন করে।  

কুজমা মিনিন ও দ্মিত্রি পঝারস্কির যৌথ নেতৃত্বে রুশ দেশ শত্রু মুক্ত হয়। শুরু হয় রোমানভ বংশের শাসন।   ১৬১২ সালে এদের বীর গাঁথা চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮০৩ সালে নভগোরাদবাসীরা অর্থ সংগ্রহ শুরু করে। প্রথমে নিঝনি নভগোরাদে এই স্ট্যাচু স্থাপনের পরিকল্পনা থাকলেও রাশিয়ার ইতিহাসে এদের অবদানের গুরুত্ব মাথায় রেখে ১৮১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মস্কোর রেড স্কয়ারে স্থপতি ইভান মারতসের তৈরি এই স্ট্যাচু স্থাপন করা হয়। ১৮২৮ সালে নিঝনি নভগোরাদের ক্রেমলিনের পাশে মিনিন ও পঝারস্কির স্মৃতিতে স্থাপন করা হয় মনুমেন্ট। ১৯১০ এর দশকে সেখানে স্ট্যাচু স্থাপনের পরিকল্পনা বিপ্লবের কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৪ সালে মস্কোর মেয়র ইউরি লুঝকভ নিঝনি নভগোরাদে মস্কোর রেড স্কয়ারে অবস্থিত মিনিন ও পঝারস্কির স্ট্যাচুর কপি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৫ সালের ৪ নভেম্বর রাশিয়া ডে তে জনসংহতি স্কয়ারে, যা এখন মিনিন ও পঝারস্কি স্কয়ার নামে পরিচিত, জুরাব ৎসেরিতেলির তৈরি এই স্ট্যাচু স্থাপন করা হয়। নিঝনি নভগোরাদের স্ট্যাচু মস্কোর স্ট্যাচুর চেয়ে ৫ সে মি ছোট আর মস্কোর স্ট্যাচুতে লেখা আছে «নাগরিক মিনিন ও যুবরাজ পঝারস্কিকে – কৃতজ্ঞ রাশিয়া, ১৮১৮ সাল», নিঝনি নভগোরাদের স্ট্যাচুতে সালের উল্লেখ নেই।    

🍂

আমরা যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি এখানকার অধিকাংশ নেতারাই ছিলেন বয়োবৃদ্ধ। ব্রেঝনেভকে আমি দেখিনি, তবে আন্দ্রোপভ, চেরনেঙ্কো এদের শাসন আমি দেখেছি আর দেখেছি তাদের প্রায় অচল শরীর। তাই চেরনেঙ্কোর মৃত্যুর পরে যখন ৫৪ বছর বয়স্ক গরবাচেভ ক্ষমতায় আসেন এটা ছিল তারুণ্যের বিজয়। লোকজন সেভাবেই সেটাকে নিয়েছে। তবে নতুন রাশিয়ায় যদিও অধিকাংশ পদে কমবেশি চল্লিশোর্ধ দলত্যাগী পার্টি কর্মীরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় এর মধ্যে কিছু কিছু ব্যতিক্রমও ছিল। এই ব্যতিক্রমী লোকজনের মধ্যে ছিল বরিস নেমৎসভ, সেরগেই কিরিয়েঙ্কো, কিরসান ইলুমঝিনভ। এরা সবাই ছিল আমাদের কাছাকাছি বয়সের, তাই তাদের নির্বাচন আমাদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে।    

  নিঝেগোরাদ ক্যাথলিক চার্চ

যেমন সুদূর অতীতে বা বিপ্লবের পর পর তেমনি গত শতকের নব্বুইয়ের দশকে আধুনিক রাশিয়ার রাজনীতিতেও নিঝনি নভগোরাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্দ্রেই সাখারভ এখানে গৃহবন্দী থাকার কারণে এই শহর সম্পর্কে বিদেশীদের কৌতূহলের শেষ ছিল না। সেই সময় আরও দু'জন তরুণ ধূমকেতুর মত রাশিয়ার রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে। এদের একজন ১৯৫৯ সালে সচিতে জন্মগ্রহণকারী বরিস নেমৎসব যিনি রাশিয়ার ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার হয়েছিলেন আর পরবর্তী কালে পুতিন বিরোধী রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। উচ্চাভিলাসী এই নেতা নিজেকে ইয়েলৎসিনের উত্তরসূরী হিসেবে মনে করতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল পুতিনের আগমনকে কখনোই মেনে নিতে পারেননি। ২০১৫ সালে মস্কোর কেন্দ্রে তিনি নিহত হন। পশ্চিমা বিশ্বে এটাকে পুতিনের রাজনৈতিক হত্যা বলে মনে করা হলেও আমার ব্যক্তিগত ধারণা এর পিছনে নেমৎসবের ব্যক্তিগত শত্রুতা কাজ করেছে। জীবিত নেমৎসব পুতিনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না, বরং বিরোধীদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করে পুতিনের পক্ষেই কাজ করতেন। অন্য আরেক যে রাজনৈতিক নেতা এখান থেকে বেরিয়ে আসে তিনি হলেন ১৯৬২ সালে সুখুমি শহরে জন্মগ্রহণকারী সেরগেই কিরিয়েঙ্কো যিনি নিঝেগোরাদ রিজিয়নের গভর্নর নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৮ সালে তার আমলেই ঘটে কুখ্যাত ডিফল্ট। কিছু সময় বিরোধী দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার পর পুতিনের আহ্বানে তিনি রস এটমের দায়িত্ব নেন। বর্তমানে তিনি প্রেসিডেন্ট এডমিনিস্ট্রেশনের ডেপুটি হেড। 

প্রকাশিতব্য 

Post a Comment

0 Comments