বার্লিনের ডায়েরি --৫
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
বার্লিন গেট
তুষারাবৃত আল্পস পর্বত থেকে ধেঁয়ে আসা শৈত্য প্রবাহ সুযোগ পেলেই কড়া চাবুক কষায়। তীব্র শীতলতম হাওয়া ছুঁচ ফোটানোর মত বিঁধছে। নভেম্বরের শীতের সকাল বেলার কাঁচা হলুদের মত সোনা রোদে পিঠ দিয়ে বসে খবরের কাগজের পাতা ওল্টানোর আয়েশ টুকু এখানে প্রায় অসম্ভব। অভিমানিনী আকাশের গোমড়া মুখ প্রতিদিন স্লেট রঙা ওড়নার আড়ালেই ঢাকা। ,মেঘ কুয়াশার ঠান্ডা লড়াইয়ে কালচে আকাশের রূপে শ্রীময়ী রাগে গাল ফুলোয়। যাচ্ছেতাই আবহাওয়া-- রোদ্দুর ওঠে কই ? ,ঘরের রুম হিটারের উষ্ণতায় গরম ব্ল্যাক কফির মগ হাতে গল্প জমায় তিতিরের সাথে। কাজ না থাকার কাজে ডুবে মুখরোচক দেশী বিদেশী রান্নার রেসিপিতে টেবিল সাজায়। কখনো গুগুল ম্যাপ সার্চ করে শহর পরিক্রমার পরিকল্পনায় কবে কোথায় কখন বেড়াতে যাবে তার প্ল্যানের সাথে চলে ফ্রী সিঙ্গাড়া ,পকোড়া ,আড্ডা গান শোনা ,হাসি মজা। এককালের ইতিহাস অনুরাগী শ্রী র মনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী লীলায় বিধ্বস্ত অতীতের এবং বর্তমানের নব নির্মিত রাজধানী শহর বার্লিন ভীষণ ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। মেঘলা দুপুর গুলো ডায়েরি আর ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রির বই তে মুখ গুঁজে কাটলেও উত্তেজনায় চোখের পাতায় ঘুম নেই ,প্রতিরাতে বেড়ানোর নতুন প্ল্যান হয় আর তিন মুনির তিন মতে সব ভেস্তে যায়।
একই মাপের সাজানো শহরের বাড়ি।
চারদিন হলো ঘরে বন্দী থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে ঋষভ। ওয়েদার রিপোর্ট দেখে ওর ধারণা ছিল আজ রোদ উঠবেই। সকাল থেকে বেড়াবার প্ল্যান করে ,দুপুর বারোটা বেজে গেলে ও আলসে সূর্য দেবের হেলদোল নেই। আদ্রিজা বকুনী দিয়ে আদেশের সুরে বলে, ''এক্ষুণি বেরোতে হবে ''। রোদ ওঠার আশায় বসে থাকলে সাপ্তাহিক ছুটির দিন গুলো শুধুই নষ্ট-- কোথাও বেড়ানো হবে না। খুশিতে পুলোকিত শ্রীময়ী যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিয়েছে। ৪ ডিগ্রীর কাছাকাছি ঠান্ডার দৌরাত্মিতে হনহনিয়ে হেঁটেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাস স্ট্যান্ড পৌঁছয়। পায়ে চলা পথ দুপাশে চওড়া কালো পাথরে বাঁধানো ফুটপাত এবং এমনকি সাইকেল যাবার জন্য ও আলাদা লেন রয়েছে। পথে বেরিয়ে বারংবার নিজের দেশের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার কথা মনে পড়ে। দাপুটে শীতের মেজাজে এখানে ঘর থেকেই বেরোতে ইচ্ছে করছে না ,আর নিজের দেশে বেশীর ভাগ জায়গায় শীতেই ওরা বেড়িয়েছে।
🍂
বাসষ্ট্যান্ডে পৌঁছতেই ,কী অদ্ভুত ! সুন্দর ভাবে ,মৃদু হেসে ''হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে '' সূর্যদেব মেঘ সরিয়ে মধ্য গগনে দেখা দিলে ঋষভ আহ্লাদে আটখানা-- কেমন মিলেছে দেখো আমার কথা ! রোদ্রের ছোঁয়ায় আজ আমাদের কোথাও ''হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা ''। শ্রীময়ী ও বাকরুদ্ধ। তিতির দেখায় ঐ যে ছাদখোলা দোতলা বাস গুলো দেখছো ওকে হুফহাফ বলে।,সিঁড়ি বেঁয়ে দোতলায় উঠে চল দিব্যি চলার ফাঁকে আরামে খোলা ছাতে বসে শহর কে দু চোখ ভর দেখতে দেখতে যাবে। যেখানে নামার ইচ্ছে তুমি নামবে।এবং টিকিট অনুযায়ী তোমার সময় মত চড়তে পারো। স্টপেজ এলে বাস গুলোর পাদানি রাস্তায় কাত হয়ে মিশে যাবে, হুইলচেয়ার ,প্যারাম্বুলেটর বাইসাইকেল ইত্যাদি সব রাখার উপযুক্ত নির্দিষ্ট জায়গা আছে। বাসে টিকিট স্বয়ংচালিত মেশিন দ্বারা সংগ্রহ করে নাও , কন্ডাক্টর নেই। শুধু স্টীয়ারিং হাতে ড্রাইভার আছে। বাস ট্রাম ট্রেন সব এতো অত্যাধুনিক সিস্টেমে চলে এককথায় অনবদ্য। চোখের সামনের বোর্ডে লাল আলোয় স্টপেজ আসছে , যাত্রীরা গন্তব্য স্থলের নির্দিষ্ট ঠিকানায় নামছে উঠছে। কোনো হাঁক ,ডাক, চিৎকার চেঁচামেচি , ধোঁয়া নেই ,হর্ন এর বিকট শব্দ নেই ,পলিউশন মুক্ত জীবন।
হুফহাফেই শহর পরিক্রমায় চলেছে , ঠান্ডা মোটামুটি গা সওয়া হয়েছে -- হবে নাই বা কেন ? গায়ে যে ভালুকের মত লোমশ ওভার কোট মাথায় টুপি ,হাতে পায়ে দস্তানা চাপিয়ে শীত কে বলে দূরে থাক.এখন। চারদিক খোলা বাস ধীর গতিতে চলছে। বিল্ডিং গুলো সব একই মাপের একই রকম ডিজাইনের ,হাল্কা গেরুয়া বা বাদামী রঙের পাঁচতলা,ফ্লাট সিস্টেমের এপার্টমেন্ট। যেখানে সেখানে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা গগণচুম্বী বিশাল অট্টলিকার দম্ভ নেই। বিল্ডিংগুলো র সাথে দোকান পসার আলোক মালায় সজ্জিত ,আট দশ লেনের কালো ঝকঝকে মসৃন আদি অন্তহীন চওড়া রাস্তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ফুটপাত ধরে পায়ে পায়ে হেঁটে যেতে ও সুখ। রাস্তার ধারে গাছের গায়ে নানা রকম বাহারী আলোক সজ্জায় হাজারে হাজারে এ ,লি, ডি বাল্বের মালায় শহর কে আসন্ন কোনো উৎসবের জন্য প্রতিমুহূর্তে নিপুন করে সাজিয়ে তোলার বিস্তর আয়োজন। শ্রী ভাবে thanks given এর সময় ,এবং আসন্ন খৃস্টমাসের উৎসবের জন্যই রাতের রানীর মত পূর্ণ সালঙ্কারায় সাজানো শহর। তিতির বলে না গো তা নয় । ট্যুরিস্ট আকর্ষণের জন্য বারোমাস ই এমন আলোক মালার উজ্জ্বলতায় সেজে থাকে নগর।
শহরের আশেপাশের চার্চ পার্ক লেক ঘুরে অবশেষে ধীর পায়ে হেঁটে বার্লিন গেটে পৌঁছে পড়ন্ত বিকেলের সূর্যাস্তে আত্মহারা হয়ে স্থান কাল ভুলে আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে শ্রীময়ী --,ওমা ! এ যে বিশাল এক মেলা প্রাঙ্গণ। প্রচুর মানুষের জমায়েত এখানে। উইকেন্ডের বিকেল থেকে সন্ধ্যে গড়িয়ে গভীর রাত সবচেয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিনোদন উপভোগের সান্ধ্য কালীন সময়। সবাই মুক্ত বিহঙ্গের মত স্বাধীন সুখী। ঐতিহ্যশালী ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থাপত্য শিল্প কলার স্মারক চিহ্ন দিয়ে সাজানো এই শহর টির ইটের স্তূপে ,দালানে পাথরের খিলানে সোপানে সর্বত্র যেন পুরোনো দিনের রহস্যময়তার গন্ধ ছড়ানো। অপূর্ব এক অনুভূতি মনে সাড়া জাগিয়ে তোলে এই বিশাল জনারণ্যের ঢেউ এ ।
ঋষভ হিসেব করে ,পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইউরোপ মহাদেশের এই বার্লিন মহানগরটিতে পর্যটকের জন সমাগম হয় সবচেয়ে বেশী এবং ভ্রমণার্থীর ভিড় সর্বদাই থাকে। এখানে জীবন আনন্দ ধারায় উদ্বেল ,প্রাণ চঞ্চল বহুমাত্রায় রঙিন এবং বর্ণাঢ্য। বিশাল গেট টি র সামনে উন্মুক্ত প্রান্তরের ধারে ফেন্সিঙে নানা আকারের বিভিন্ন প্রজাতির ত্রিকোন করে কাটা ঝাউয়ের গাছ গুলোতে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে যেন , রাশাকৃত আলোর ফুল ফুটেছে। আকাশ ছোঁয়া গাছের ডালে পাতার ফাঁকে সর্বত্র আলোর মালায় উজ্জ্বল এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। রাতের অন্ধকারে যেন অজস্র জোনাক পোকা সুখের সাগরে ভেসে আলোর নেশায় ডানা মেলে দিয়ে জ্বলছে নিভছে। জগতের সব অন্ধকার কে এক লহমায় শুষে নিয়ে ঝিকি মিকি আলোর বন্যায় নিরন্তর গেঁথে চলেছে এক বৈপ্লবিক শহরের অশ্রুত কাব্য গাঁথা। কত রকমের সুগন্ধে ভরপুর ফুড প্লাজা গুলো।পৃথিবীর নানা দিক থেকে আসা মানুষের ,নানা ভাষায় আলাপচারিতায় উৎসব মুখর প্রাঙ্গন। তরুণ তরুনীদের গীটার,ড্রাম স্যাক্সোফোনে ঝংকার তুলে গানের আসর জমে উঠেছে। কিছু জনতা শপিং সেন্টারে জিনিস কেনায় উৎসাহী। ''বার্লিন গেট ''বারোমাস এমন জমজমাট ভাবতে কেমন অবিস্মরণীয় রোমাঞ্চ লাগে। শ্ৰীময়ী অভিভূত ,ও যেন এক বিশ্ব নাগরিকের যজ্ঞ সভায় মহামিলন ক্ষেত্রে এসেছে।.ওর তন্ময়তা ইতিহাসের অলিগলি ধরে বিস্মৃত প্রায় অতীতের রাজ দরবারে ঘুর পাক খায়।
ও তখন স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়ে ইতিহাস মুখর।World history ক্লাশে টিচারের কাছে পড়া মুখস্ত বলার মত করে সানগ্লাস টি হাতে ঘুরিয়ে ঋষভ কে বলে, ''এই যে সু উচ্চ বার্লিন গেটটি দেখছো ,'' ১৮০০সেঞ্চুরীতে ব্রান্ডেনবার্গের শাসক দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক উইলিয়াম এর রাজত্ব কালে তৈরী --এ এক রোমাঞ্চ কর ঐতিহাসিক তোরণ দ্বার। জার্মানির সব থেকে উল্লেখ যোগ্য ল্যান্ডমার্ক গুলোর অন্যতম একটি স্মারক চিহ্ন। ঐ যে সুউচ্চ কলাম গুলো দেখছো ,সব কিন্তু গ্রীকপুরাণের উপকথার ভিত্তিতে নির্মিত। খোদিত রয়েছে বিভিন্ন গ্রীক পুরাণের দেবদেবীর মূর্তি ও কাহিনী। এবং সর্বোচ্চ স্থানে বিখ্যাত ভাস্কর্য Quadriga ,সেখানে চারটি ঘোড়া টানার রথে উপবেষ্টিতা রোমান যুদ্ধ জয়ের দেবী ভিক্টরিয়ার বিজয়ী মূর্তি শোভিত রয়েছে।
নির্মল আকাশ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বার্লিন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল তখন এই গেটের দুইপাশেই বিখ্যাত বার্লিন প্রাচীর জুড়ে দেওয়া হয়েছিল । অবারিত দ্বার গেট টি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কারণে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মনে পুঞ্জীভূত রাগ অভিমান অসন্তোষের অন্ত ছিল না। কিন্তু বার্লিন প্রাচীরের পতন হবার পরে এই গেট টি আবার সর্ব সাধারণের জন্য উম্মুক্ত করা হলে পৃথিবীর ইতিহাসে এই দ্বার অনেক বেশী প্রসিদ্ধ এবং গুরুত্ব পূর্ণ স্থান অধিকার করে নিয়েছিল। তবে এখন যে গেট টি আমরা দেখছি ,সেটি কিন্তু আগের গেট নয়। নব নির্মিত এই গেট টি আগের গেটের থেকে আকারে অনেক বড়ো করে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। খুব অতীতের কথা নয় ,১৯৮৯সালে ;''বার্লিন ওয়াল '' ভেঙে ফেলার পর এই তোরণদ্বার টি "ব্রান্ডেন বার্গ ফটক" পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের পুনরায় মিলনের তথা একত্রী করণের প্রতীক হিসাবে উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে স্বগর্বে মহিমান্বিত হয়ে আছে ।বার্লিনের পরতে পরতে এমন ইতিহাস কত সুপ্ত হয়ে আছে।'' ঋষভ ও তিতির শ্রীময়ীর বর্ণিত ইতিহাসে ডুবে গিয়েছিল। বিস্মিত তিতিরের মন বাস্তবে ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে গ্রেট মা! কি সুন্দর মেমোরি ! তোমার এত বছর আগে পড়া ইতিহাসের ঘটনা গুলো ,তবু কি সুন্দর সহজেই গল্পের ছলে বলে গেলে ! চলার পথে
তিতির বলে সেদিনের কথা খুব মনে পড়ছে ,আমার ল্যাবমেট আলেক্সেয়েই ও ম্যাক্সপ্ল্যাংকের বন্ধুরা ২০১৩ সালের বর্ষবরণ উৎসবে অর্থাৎ বার্লিনগেট তৈরীর ২৫ বছরের Birthday celibration এ ওরা আমাকে এখানে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় আমার আসা হয়নি। ওদের কাছে শুনেছিলাম ,এই ঐতিহাসিক তোরণে সেদিন নাকি দশ লক্ষ মানুষ এক সঙ্গে গ্যাংনাম স্টাইল নেচে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নামাঙ্কিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। যদিও ঐ ১০ লক্ষ সংখ্যা ? আমার বিশ্বাস হয় নি। তবে সেদিন,অসংখ্য মানুষের মহা মিছিল জমায়েত হয়েছিল এই গেটে টিভি নিউজ পেপারে সে খবর দেখেছিলাম। সেদিন আনন্দ উল্লাসে মত্ত সমগ্র বার্লিন বাসী ঠিক মধ্য রাতে প্রায় এগারো মিনিট ধরে শুধু আতশ বাজি জ্বালিয়ে ছিল। কম করেও ছয় হাজার হাউই উড়িয়ে ছিল এবং সে আলোর ফুলঝুরি ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা শহর জুড়ে। সে সময় দিনের আলোর মত উজ্বল ছিল রাতের আকাশ। প্রচন্ড শীতের কামড় উপেক্ষা করে.উৎসবে মেতেছিল সমগ্র নগর বাসী।ভাবতে ভালো লাগে সব বিদেশী বন্ধুদের সঙ্গে থেকে বাজী পোড়ানোর সেই ঐতিহাসিক দৃশ্যর আমি ও সাক্ষী ছিলাম।.ওদের আনন্দের সাথে আমিও একাত্মবোধ করেছিলাম। (ক্রমশঃ)
0 Comments