সুবর্ণা নাগ
ভারতীয় বাংলা সিনেমার তিন নক্ষত্রদের একজন মৃণাল সেন (১৯২৩ -২০১৮)। সত্যজিৎ রায়ের (১৯২১- ১৯৯২) সঙ্গে তাঁর চিন্তাগত নৈকট্য কমই ছিলো। বয়সে তাঁর চেয়ে দু’বছরের বড় ছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের প্রথম ছবি ‘রাত ভোর’ মুক্তি পায়। একই বছর সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ও মুক্তি পায়। ‘পথের পাঁচালি’ বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে, অথচ মৃণাল সেনের প্রথম ছবি সে অর্থে কোন আলোড়ন তোলেনি। তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) তাঁকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে চিহ্নিত করে। আরো পরে ১৯৬৯ সালে ‘ভুবন সোম’ চলচ্চিত্রের কারণে মৃণাল সেনকে আমরা সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের এক পংক্তির চলচ্চিত্রকার মনে করি। ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫-১৯৭৬) অবশ্য বয়সে সত্যজিৎ ও মৃণাল সেনের চেয়ে ছোট হলেও চলচ্চিত্রে তাঁর আগমন ও প্রস্থানও তাঁদের আগেই। ‘নাগরিক’ (১৯৫২) চলচ্চিত্র দিয়ে ঋত্বিকের চলচ্চিত্র অভিযান শুরু আর সমাপ্তি ঘটে ‘যুক্তি তক্ক গপ্পো’ (১৯৭৩) দিয়ে। ঋত্বিক ঘটক আর মৃণাল সেনের একটা কমন আইডেন্টিটি ছিলো। দুজনই আইপিটিএ (Indian People’s Theatre Association) এর কর্মী ছিলেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক মুখপাত্র ছিলো এই নাট্যদল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪২ সালে এ নাট্যদলের জন্ম। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ, উপনিবেশিকতার ভয়াবহবতা এবং সর্বোপরি শ্রেণি বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরাই আইপিটিএ-এর অন্যতম কাজ ছিলো। নানা সময়ে পৃথ্বিরাজ কাপুর, বিজন ভট্টাচার্য, বলরাজ সাহানি, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, মৃণাল সেন, সলীল চৌধুরী, পণ্ডিত রবি শঙ্কর, সফদর হাসমির মতো ব্যক্তিরা এখানে কাজ করেছেন। এবং অনিবার্যভাবেই তাঁদের কাজে আইপিটিএ-এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষত বাংলা চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন এবং উৎপল দত্ত শ্রেণী সংগ্রামকে দিয়েছেন নতুন মাত্রা। সত্যজিৎ রায় সরাসরি এই দলে যোগ দেননি। তবে তাঁর একাধিক চলচ্চিত্রে সাধারণ মানুষ, শ্রেণী শোষণ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’র (১৯৮০) আগেই সত্যজিৎ রায় বানিয়েছিলেন ‘অশনি সংকেত’ (১৯৭৩) আবার ১৯৭২-এ মৃণাল সেন বানিয়েছেন ‘কলকাতা ৭১’। উল্লেখ করা দরকার এই তিনটি চলচ্চিত্রেই ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের চিত্রায়ণ হয়েছে বলিষ্ঠভাবে। ‘অশনি সংকেত’ বিভূতিভূষণের উপন্যাস অবলম্বনে করা। অন্যদিকে ‘কলকাতা ৭১’ এর কাহিনী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ স্যান্যাল, সমরেশ বসু এবং অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারটি গল্প থেকে নেয়া। এটাই তো স্বাভাবিক যে, লেখক, চলচ্চিত্রকার, শিল্পীরা তাঁদের সময়, সমাজের সংকট তুলে ধরবেন। অতীত আর বর্তমানকে বিশ্লেষণ করবেন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়ে। মৃণাল সেন সময় ও সমাজের দায় পালন করেছিলেন ‘কলকাতা ৭১’, ‘আকালের সন্ধানে’র মতো চলচ্চিত্র বানিয়ে। সোজা করে বললে, মৃণাল সেনের সব চলচ্চিত্রই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নির্মিত।
সত্তরের দশকের ছবিগুলি দিয়েই মৃণাল সেনের পরিচিতি নির্মিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ, ১৯৬৯ সালের ‘ভুবন সোম’, যা দিয়ে নতুন ভারতীয় ছবির আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল, সেখান থেকে মোটামুটি ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) পর্যন্ত। এই যে মধ্য পর্যায়, তা যে কেন্দ্রে থাকবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, এবং মৃণাল সেনের পরিচিতি নির্মাণে এই পর্যায়ের গুরুত্বও অস্বীকার করার মতো নয়। কিন্তু মৃণাল সেনের শিল্পীজীবন এমনই যে, ‘রাতভোর’ (১৯৫৫) থেকে ‘মাটির মানুষ’ (১৯৬৬) অবধি পর্যায়টিকে ঠিক এই কেন্দ্রীয় পর্যায়ের প্রস্তুতি হিসেবেও পড়তে পারা যায় না। তিনি ব্যক্তিগত বিশ্বাসে ‘বামপন্থী’ ছিলেন, তাই প্রথম পর্যায়েও তাঁর ছবি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বেকার যুবকের গল্পে গিয়েছিল, গিয়েছিল গ্রামবাংলার বাস্তবতায়, এমনকী পশ্চিমবঙ্গের বাইরের গ্রামজীবনেও চলে গিয়েছিল তাঁর ক্যামেরা। বরাবরই পর্দায় যে-বাস্তব সচরাচর আসে না, তাকে ধরে ফেলার তাড়না তাঁর ছিল। কিন্তু মৃণাল সেনের শিল্পীসত্তায় প্রধান অধৈর্য ছিল বোধহয় গুছিয়ে গল্প বলায়। তাই ১৯৬৯ সালে রীতিমতো আঙ্গিকগত পুনর্জন্ম ঘটেছিল তাঁর চলচ্চিত্রের। তাঁকে নিয়ে আলোচনার খাতিরে ‘সত্যজিৎ রায়’ এবং ‘ঋত্বিক ঘটকের’ প্রসঙ্গ আসবেই। কেন আসবে? কেন তাঁকে ‘তপন সিংহ’, ‘যাত্রিক’, ‘তরুণ মজুমদার’, ‘রাজেন তরফদার’দের সঙ্গে আলোচনা করা হয় না? কেবলই ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতি’ কারা কারা অর্জন করেছেন বাংলা সিনেমায়, সেই যুক্তিই কি নিয়ামক? জানা নেই। তবে এই ত্রিকোণটি - ‘সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল’ – আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতিতে এমনই সুসংহত হয়ে বসে আছে যে, সেটাকে খামোকা এখন প্রশ্নের সম্মুখে ফেলে আর বিশেষ লাভ নেই। ‘সত্যজিৎ’ নিটোল গল্প বলাকে প্রধান কাঠামো করে তুলেছিলেন তাঁর ছবিতে, ‘ঋত্বিকের’ কাছে ‘গল্পের প্লট’ ছিল অজুহাত। কিন্তু ‘ঋত্বিকের’ ছবিতে যে ‘মেলোড্রামা’র ‘রাজনৈতিক ব্যবহার’ করে শৈল্পিক পরিকল্প, তা মৃণাল সেন গ্রহণ করেন না। সত্যি বলতে কী, তিনি হয়তো সেই কাঠামোটি মেনেও নিতে পারেননি। কিছু বছর আগেও তিনি ‘ঋত্বিকের’ ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র বিখ্যাত ‘ক্লাইম্যাক্টিক দৃশ্য’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। মৃণাল সেনের ‘অস্থির সিনেমা’ অন্য কোনও আঙ্গিক খুঁজছিল। তিনি সেই আঙ্গিক পেয়ে গিয়েছিলেন, এটা সর্বজনবিদিত, ১৯৬৯-এর ‘ভুবন সোম’-এ। কিন্তু সেই আঙ্গিকে তিনি থেকে যেতে পারেননি। আশির দশক থেকেই তিনি আবার ফিরে গিয়েছিলেন দর্শকদের চেনা ‘বাস্তববাদী গল্প-বলা’ ছবির ঢঙে। এবং বস্তুতঃ তাঁর ছবি সেই সময় থেকেই ক্লান্ত হতে শুরু করেছিল। অর্থাৎ, সেই পর্যায়ে কিছু একটা সংকট ছিল। শিল্পীর সংকটকেও চিহ্নিত করে পাঠ করতে হয়। এই সংকট সবসময়ে ‘ব্যর্থতা’ নয়। আর আমরাই বা সাফল্য-অসাফল্যের নিদান ডাকার মতো কে? সত্তরের দশকের শেষ পর্যায় বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটা সংকটের সময় ছিল, এটা নতুন করে ঘোষণা বা আবিষ্কার করার মতো খবর নয়। ‘উত্তমকুমারের’ কলকাতা ত্যাগ করা, তাঁর ‘নায়কোচিত চরিত্রে’ কাজ করার ক্লান্তি, ‘সুচিত্রা সেনের’ অবসর, ‘উত্তম-সুচিত্রা জুটি’র রোমান্টিক ছবির পরিকল্পের আচমকা পুরনো হয়ে যাওয়া এবং ‘সামাজিক অস্থিরতা’ হেতু মধ্যবিত্তের হলবিমুখ হওয়া মূলধারার ছবিতে সংকট এনেছিল, যার ‘ক্লাইম্যাক্টিক’ চিহ্নমুহূর্ত ছিল দশক ঘোরার সময়ে ‘উত্তমকুমারের’ মৃত্যু। আর অন্য ধারার ছবিতেও সেই সময়ে যে-জোয়ার এসেছিল মৃণাল সেন এবং নতুন ভারতীয় ছবির স্ফুরণে, তা খুবই ক্ষণিকের ছিল। পরবর্তী সময়ে বাংলার বিকল্প ধারার ছবিও যে নিশ্চিন্ত এবং স্বাস্থ্যোজ্জ্বল বৃদ্ধি পায়নি, সেটি তর্কসাপেক্ষ হলেও সত্য থেকে মুখ সরিয়ে রাখলে আমাদের শিল্পের ইতিহাস পাঠটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
ফরাসি চিত্রনির্মাতা ফ্রাঁসোয়া ট্রুফোর দ্বারা প্রভাবিত মৃণাল সেন ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে ‘আকাশ কুসুম’ ছায়াছবিটি বানাতে শুরু করেন। অভিনয়ে ছিলেন সৌমিত্র চ্যাটার্জি ও অপর্ণা সেন। প্রকাশের পর এই ছবির ভাষাভঙ্গি নিয়ে চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মাঝে সাড়া পড়ে যায়। তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে এই ছবির সমালোচকদের একজন ছিলেন সত্যজিৎ রায়।
মৃণাল সেন সে’সময় আশীষ বর্মণের একটা গল্প নিয়ে ছবি বানাচ্ছিলেন। ‘আকাশ কুসুম’ নামের এই ছবির গল্পটা এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির যুবককে নিয়ে, যে যেনতেন উপায়ে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতো। মৃণাল চিত্রনাট্যে গল্পের ভেতর কিছু কিছু জায়গা বদলে দেন। ফলে গল্পের নায়ক অজয়ের চরিত্র হয়ে ওঠে স্বপ্নালু ও ভাবুক, যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধ বাস্তবতার ভেতরে বসেও আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখতো, যার প্রবল বিশ্বাস ছিল যে শুধু স্বপ্নের জোরেই সে একদিন বিরাট ধনী হতে পারবে। শেষ পর্যন্ত সে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়, এবং তার যা সহায়সম্পদ ছিল সেটাও খুইয়ে বসে।
কেন যেন অজয়ের চরিত্রটাকে চলচ্চিত্রের সমালোচকেরা ভালোভাবে নিতে পারলেন না। মৃণাল বেশ উদ্বিগ্নই হলেন। শেষতক ২৫ জুলাই একটা বিজ্ঞাপনেও একটি বাক্য জুড়ে দিলেন, “অজয় কোন ধোঁকাবাজ নয়, সে উচ্চাকাঙ্খী”। এর কিছুদিন আগে ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ‘স্টেটসম্যান’-এ ছবিটার একটি সমালোচনা ছাপা হয়েছিল। তার প্রতিক্রিয়ায় সেই ২৫ জুলাইয়ে সম্পাদকের কাছে চিঠির পাতায় চিঠি লিখে পাঠালেন পাঠকেরা। প্রতিক্রিয়ার কারণ হলো স্টেটসম্যানের সমালোচক তার লেখায় বলেছিলেন যে এই ছায়াছবির সমাপ্তিটা ডন কিহোতের সমাপ্তির মতো – হাস্যরসে মেশানো করুণ। যে কারণে দর্শকেরা ছবি শেষ করে নায়কের পরিণতিতে সমব্যথী হবে। এর জবাবে গল্পকার আশীষ বর্মণ বলেছিলেন যে গল্পটা মোটেও এভাবে শেষ হয়নি। কারণ ওভাবে শেষ করলে তা শুধু ভুলই হতো না, দর্শকদের কাছেও সেটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো না। বর্মণের মতে, ‘সমসাময়িক’ সময়ের একটি গল্পে এমন শৈল্পিক ধোঁয়াশা রেখে দেয়া প্রায় অসম্ভব।
এই পর্যায়ে সত্যজিৎ ঘটনায় জড়িয়ে গেলেন। যদিও প্রতিক্রিয়া লেখার আগে সত্যজিৎ মৃণালকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন যে তার সমালোচনার লক্ষ্য আশীষ, এবং তার লেখা পড়ে মৃণাল যেন আহত না হয়। কিন্তু তার লেখা প্রকাশ পেলে দেখা গেল যে তিনি পুরো ছবিটার ভিত্তিমূল নিয়েই প্রশ্ন করছেন। এই ছবির সমসাময়িকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন। যা পড়ে মৃণালও ভাবলেন জবাবটা তার দেয়া দরকার। সত্যজিৎ’র লেখার জবাবে একদিকে আশীষ লিখলেন যে, ‘কোন গল্পে মৌলিক মানবিক তাড়না, যেমন প্রেম, ঈর্ষা, ক্ষুধা, আশা কিংবা ভালো জীবনের আকাঙ্ক্ষার কথা বললেই তা সমসাময়িকতা হারায় না’। অন্যদিকে মৃণাল সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে উত্তর দিতে গিয়ে তুলে আনলেন চ্যাপলিনকে। আশীষ বর্মণ আর মৃণাল সেনের জবাবে বারবার সমসাময়িকতার বরাত দেয়াতে সত্যজিৎ বেশ ক্ষিপ্ত হলেন। এর পরের জবাব হলো আরো খাপখোলা তলোয়ারের মতো, কোনোরূপ চটুল রসিকতার আড়াল ছাড়াই, “এই ছবির নায়কের আচরণ আর তার পরিণতির কোন সমসাময়িকতার উপরে পুরো গল্পটা দাঁড়িয়ে আছে তা বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। ‘আকাশ কুসুম’-এর যদি কোন সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা থেকে থাকে, তা শুধুই উপরে উপরে, কিছু ছড়ানো-ছিটানো শহুরে জীবনের বর্ণনা আর ফ্যাশনদুরস্ত বয়ানে। কিন্তু এই গল্পের থিমের সমসাময়িকতা কোথায়? সে ব্যাপারে ছবির নির্মাতাদের বক্তব্য কী?”
পাঠকদের চিঠি আসতে থাকলো। তার বেশিরভাগই সত্যজিৎ’র এমন রূঢ় লেখাকে ভালোভাবে নিলো না। কারো কারো কাছে মনে হলো সত্যজিৎ ‘গোঁড়া এবং অসহিষ্ণু’, কারো চোখে মনে হলো তার লেখায় ‘তলে তলে ছিদ্রান্বেষী মনোভাব সুস্পষ্ট’। এর মধ্যে মৃণালও আবার জবাব দিলেন, তবে তাঁর জবাব সচেতনভাবেই চ্যাপলিন সংক্রান্ত বিষয়ে সীমাবদ্ধ, আকাশ কুসুম নিয়ে তিনি কিছুই বললেন না।
এতসব চিঠি পড়ে রায়সাহেবের মেজাজ ঠাণ্ডা থাকার কথা না। এবার তিনি লিখলেন এক ঝাঁঝালো ব্ল্যাক হিউমার মেশানো সার-সংক্ষেপ, প্যারোডির ঢঙে এক গল্প লিখলেন, যার প্রত্যেক লাইনে জোর করে “সমসাময়িক” শব্দটা ঢুকিয়ে দিলেন। যেমন, নায়ক থাকে এক কুঁড়েঘরে, কিন্তু তার দেহের গড়ন সমসাময়িক সুনজর পেয়ে বেশ দশাসই। এই লেখাটা শেষ হলো তার বিখ্যাত সেই উক্তি দিয়ে, ‘A crow-film is a crow-film is a crow-film’।
কথার লড়াই ততোদিনে মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে অনেকটাই ব্যক্তিগত যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। তাই কদর্যতায় রূপ নেয়ার আগে ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় উদ্যোগী হলো তর্ক-যুদ্ধ অবসানের। তাঁরা মৃণাল এবং আশীষের কাছে একটি শেষ জবাব দেয়ার অনুরোধ করলো। মৃণাল সত্যজিৎকে আক্রমণও করলেন না, তার ছায়াছবির হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনও করলেন না। তিনি সত্যজিৎ’র শেষ গল্পের জবাবে বললেন যে চাইলে হ্যামলেটকেও সংক্ষেপে রাজবাড়ির এক খুন আর ভূত-রহস্য-প্রেম-প্রতারণা-অজাচারের গল্প বলে চালিয়ে দেয়া যায়, যে গল্পের শেষে নায়িকা উন্মাদ হয়ে আত্মহত্যা করে, আর বেশ কয়েকটি খুন ঘটার পর নায়কও আত্মহত্যা করে।
কেন যে সত্যজিৎ অমন আক্রমণাত্মক লেখাটি লিখেছিলেন তা আজও রহস্য। আকাশ কুসুমের থিমের ব্যাপারে তার অ্যালার্জির কারণও বুঝতে বেজায় কষ্ট হয়। কারণ প্রায় কাছাকাছি থিমের একটি ছবি তিনি নিজেও এর সাত বছর আগে বানিয়েছিলেন। তার ‘পরশ পাথর’ ছায়াছবিতে এমনই এক গরীব কেরানি জাদুর পাথরের বদৌলতে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যায়। সে পাথর লোহাকে সোনায় পরিণত করতো, যার সুবাদে সেই কেরানির জীবনেও আমূল পরিবর্তন এসেছিল।
কারণ যাই হোক না কেন, আকাশ কুসুমকে ঘিরে ঘটে যাওয়া এই তর্ক-যুদ্ধে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল। সত্যজিৎ রায় প্রকাশ্যে মৃণাল সেনের সাথে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। ‘পথের পাঁচালী’র সময় থেকেই তিনি বাংলা সিনেমা জগতের অবিসংবাদিত নায়ক। সেই জগতে মৃণাল যে তাঁরই মতন প্রাসঙ্গিক আর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন এটা তিনি নির্ঘাত বুঝতে পেরেছিলেন।
সে বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর দ্য স্টেটসম্যান আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আকাশ কুসুম’ ছায়াছবি নিয়ে তর্কের সমাপ্তি ঘোষণা করে জানায় যে এই বিষয়ের ওপর আর কোনো চিঠি তাঁরা ছাপাবে না। সেদিন সন্ধ্যায় ফিল্ম সোসাইটির একটা প্রদর্শনী ছিল। সেই মিলনায়তনে সত্যজিৎ আর মৃণালের দেখা হলো। সত্যজিৎ হাসতে হাসতেই বললেন, ‘কেমন হুট করে তর্কটা থামিয়ে দিলো! আপনি লেখা বন্ধ করলেন কেন? আমি তো আরো অনেকগুলো চিঠি লিখতে পারতাম!’
‘আমার তো আপনার মতো ভক্তকূলও নেই, লোকবলও নেই’, মৃণাল জবাব দিলেন, ‘তবে একাই আপনার সব চিঠির জবাব দিতে পারতাম!’
এই কথা-পাল্টা-কথাই এই দু’জনের পরবর্তী জীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ালো। হাসি-ঠাট্টার সৌজন্যমূলক আবরণের আড়ালে তাঁরা পরষ্পর দূরে দূরেই থাকলেন। কেউ কাউকে চিনলেন না। সদা-সতর্ক, সদা-উদ্যত। ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলের আড্ডাতেও তারা একে অপরের কাজ নিয়ে কথা বলতে চাইতেন না।
কলকাতার সিনেমাবোদ্ধাদের অনেকে প্রায়ই বলেন যে সত্যজিৎ আর মৃণালের মধ্যে মিল শুধু দৈহিক উচ্চতায় আর গায়ের রঙে। সংবেদনশীল শিল্পী হিসেবে দু’জনেই চারপাশের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা আর হালচালে প্রভাবিত হতেন। যদিও তাঁদের প্রকাশভঙ্গি আর শিল্প ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, যেমন পুনশ্চ আর মহানগর। তাঁদের দীর্ঘ চলচ্চিত্র নির্মাতা জীবনে এমন অনেকবারই ঘটেছে। আধুনিক তারুণ্যের সমস্যা নিয়ে তাঁরা দু’জন বানিয়েছেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ আর ‘ইন্টারভিউ’; ১৯৪৩ এর মন্বন্তর নিয়ে বানিয়েছেন ‘বাইশে শ্রাবণ’ আর ‘অশনি সঙ্কেত’; আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদ হিসেবে বানিয়েছেন ‘কোরাস’ আর ‘হীরক রাজার দেশে’।
আশির দশকে যেন নিজেরাই বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান বদলে ফেললেন দু’জনেই। সঙ্গীতময়, সূক্ষ্ণ আর নিয়ন্ত্রিত সত্যজিৎ ক্রমশ হয়ে উঠলেন উচ্চকিত ও দৃঢ়ভাষী। নিজের দর্শনকে প্রকাশ করার জন্য তিনি তার ছবির ভাষাকেও আগাগোড়া বদলে দিলেন। অন্যদিকে মৃণাল, যিনি বরাবরই ছিলেন কসরতবাজ আর চড়াসুরের বক্তা, তিনি হয়ে উঠলেন অন্তর্মুখী আর শান্ত।
🍂
বর্তমান প্রজন্মের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে এককালে এই দু’জন অসম্ভব অন্যরকম শিল্পী পরষ্পরের খুব ভাল বন্ধু ছিলেন। মৃণাল সেনের চ্যাপলিনের ওপর লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। সত্যজিৎ’র লেক টেম্পল রোডের বাসায় মৃণালের নিত্য আসা-যাওয়া ছিল। সেখানে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সিনেমা নিয়ে আলাপ করতেন। ‘অপরাজিত’ দেখে মৃণাল মুগ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর কাছে এটাই সত্যজিৎ’র সেরা ছবি। কিন্তু কেন জানি ‘পরশ পাথর’ অতোটা পছন্দ করেননি, সত্যজিৎকে বলেওছিলেন সে’ কথা। ‘বাইশে শ্রাবণ’ দেখে সত্যজিৎ’র তেমন আহামরি কিছু মনে হয়নি। পরে অবশ্য তিনি এই মত পরিবর্তন করেছিলেন, এবং ১৯৬৫ সালের ২য় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জুরি থাকাকালীন সময়ে এই ছবিটার একটি বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন তার বন্ধুদের জন্য।
এমন চমৎকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের পর ‘আকাশ কুসুম’ নিয়ে সত্যজিৎ’র লেখা চিঠিতে মৃণাল যারপরনাই আহত বোধ করেছিলেন। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেননি। আগের উষ্ণতা না থাকলেও মৃণাল বরাবরই সামাজিক সৌজন্য বজায় রেখেছিলেন। তাই তাঁর পরের ছবি ‘মাটির মণীষা’ দেখতে সত্যজিতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ছবি দেখে সত্যজিৎ-ও বলেছিলেন যে তাঁর ভাল লেগেছে। প্রায় দশ বছর পর মৃণালের ‘ওকা উরি কাথা’ দেখেও তিনি একইভাবে প্রশংসা করেছিলেন।
মৃণালও তাঁর ছবি ‘ভুবন সোম’-এর একটি দৃশ্যে বাংলার গৌরব নিয়ে বলার সময় পর্দায় সত্যজিৎ’র আলোকচিত্র দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এই ছবিটা আবার সত্যজিৎ’র ভাল লাগেনি। তাঁর লিখিত বই “Our Films, Their Films”-এ সত্যজিৎ এই বিষয়ে লিখেছেন, “ভুবন সোম উৎরে গেছে কারণ মৃণাল এখনকার সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু কৌশল ব্যবহার করেছেন, যা এই ছবির ভাষার খচখচে জায়গাগুলোকে কিছুটা নরম করে দেয়। এসব কৌশলগুলো হলোঃ সুন্দরী নায়িকা, সুমধুর আবহসঙ্গীত, আর একটি সাধারণ, মন-ভালো-করে দেয়া চিত্রনাট্য ইত্যাদি। সাত শব্দে সারাংশ করলে দাঁড়ায়ঃ “Big Bad Bureaucrat Reformed by Rustic Belle”।
সত্যজিৎ রায়ের বইটা প্রকাশ হবার পর কলকাতার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা মৃণাল সেনের কাছে পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার অনুরোধ করে। প্রথমে কিছুটা টালবাহানার পর মৃণাল লিখতে রাজি হন। ভুবন সোম বিষয়ে সত্যজিতের সমালোচনা নিয়ে তিনি লিখেছেন, “সমালোচকেরা অনুকূল মন্তব্য করেছেন, দর্শক ছবিটা পছন্দ করেছেন, আর উভয়েই ছবিটাকে ব্যতিক্রমী মনে করেছেন। স্বভাবতই আমরা খুশি। যা হোক, অনেকে বলে এর সতেজ আমেজের কারণে ভুবন সোমকে সবাই গ্রহণ করেছে। এটুকুই যথেষ্ট।”
সত্যজিতের সাত শব্দের সারাংশ একটু পাল্টে মৃণাল তাঁর ছবিকে বললেন, “Big Bad Bureaucrat Chastised by a Charmer’s Cheek”। তাঁর এই লেখাটার শিরোনাম ছিল “His Book, My Comments”।
সত্যজিৎ’র জীবনের শেষ দশকে তাঁরা দুইজন বেশ কয়েকটি কমিটিতে একসাথে কাজ করেছেন। বিভিন্ন ফিল্ম সেমিনার ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মেও তাদের কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁদের এই শীতল ও আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের খুব বেশি উন্নতি হয়নি।
শেষদিকে আরো একবার সত্যজিৎ মৃণালের দিকে আক্রমণের তীর ছুঁড়েছিলেন। যদিও অনেকে বলেন তিনি এটা প্রকাশ্যে করতে চাননি। তাঁর পুরনো বন্ধু ও বিখ্যাত চিত্রসমালোচক চিদানন্দ দাসগুপ্তকে লেখা তাঁর এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে তথাকথিত ‘আর্ট ফিল্মের’ নির্মাতারা নিজ দেশে দর্শকদের সাথে মেলবন্ধনের চেয়ে বিদেশি ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার ব্যাপারে বেশি উৎসাহী। ‘তাঁরা কেউই গল্প বলার কৌশল জানে না, মৃণালও জানে না’, এই ছিল তাঁর বক্তব্য।
১৯৯১ সালের জুনে বন্ধুকে লেখা এই ব্যক্তিগত চিঠিটি অক্টোবর মাসে একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়ে যায় সত্যজিৎ’র অনুমতি ছাড়াই। ততোদিনে সত্যজিৎ খুবই অসুস্থ এবং বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি মৃত্যুর দিন গুনছেন। মৃণাল স্বভাবতই এই আকস্মিক আঘাতে বিচলিত হয়েছিলেন। তবে তিনি তা প্রকাশ করেননি। অনেকের প্রণোদনা থাকার পরেও পত্রিকাকে একটি অসম্ভব স্থিতধী মন্তব্য জানিয়েছিলেন।
“আমি নন্দনতত্ত্ব আর গল্প বলার শৈল্পিক দিক নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সাথে কোন তর্কে জড়াতে চাই না। তাঁর অসুস্থতায় ওষুধের পাশাপাশি মানসিক শান্তিও প্রয়োজন, এবং আমি তা কোনোভাবেই নষ্ট করতে চাই না।”
সত্যজিৎ রায়ের জবাব জানার আর কোন উপায় ছিল না। কারণ এই বিতর্কিত চিঠিটি প্রকাশের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সত্যজিৎ রায়ের অসুস্থতার পুরো সময়টায় সেন পরিবারের সবাই তাঁর পরিবারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা বজায় রেখেছিলেন। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে নার্সিং হোমে সবার আগে তারাই পৌঁছেছিলেন। শেষকৃত্য শেষ হওয়া পর্যন্ত মৃণাল সেনকে দেখাচ্ছিল উদ্ভ্রান্ত, শূন্য দৃষ্টিতে তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। প্রায় দুই দশক আগে তিনি সত্যজিতকে তার একাকীত্ব নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। সেই একই একাকীত্ব যেন তাকে গ্রাস করেছে। সেই ক্লান্ত গ্রীষ্মের এপ্রিলের বিকেলে সত্যজিৎ’র মরদেহের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। একটু পরেই এই দীর্ঘাঙ্গী সত্যজিৎ’র শেষ চিহ্নটিও চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মৃণালের উপলব্ধি হলো যে এতদিন তাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহে, উদ্যমে, ক্ষেপিয়ে সৃজন-উৎকর্ষের সুউচ্চ চূড়াটিতে তুলে দেয়া মানুষটি আর রইলো না।
তথ্যসূত্র:
১- মৃণাল সেন, তৃতীয় ভুবন - আনন্দ পাবলিশার্স (২০১১), কলকাতা।
২- মৃণাল সেন, আমি ও আমার সিনেমা- বাণীশিল্প (২০১৫), কলকাতা।
৩- মৃণাল সেন, অনেক মুখ অনেক মুহূর্ত - পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ ও থীমা (২০১৫), কলকাতা।
৪- Mrinal Sen: Sixty Years in Search of Cinema - Dipankar Mukhopadhyay, HarperCollins India.
৫- Always Being Born: Recipient Of Dadasaheb Phalke Award Mrinal Sen A Memoir, Mrinal Sen, Stellar (২০১৬)।
৬- দেশ, মৃণাল সেন বিশেষ সংখ্যা, ১৭ই জানুয়ারি ২০১৯ সাল।
৭- বর্তমান পত্রিকা, বৃহস্পতিবার, ৩রা জানুয়ারি ২০১৯ সাল।
৮- ইন্টারনেট ও অন্যান্য
0 Comments