জ্বলদর্চি

করুণাধারায় এসো /বন্দনা সেনগুপ্ত

করুণাধারায় এসো
বন্দনা সেনগুপ্ত


আমি মিস্টার এ বি সেন, অমিয় ভূষণ সেন। বাবা মনি ভূষণ সেন। 

আমি ব্যবসায়ী। একটা ছোট্ট সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম আছে। নিজেরাও কাজ করি। আবার, লালবাজারের সঙ্গেও হ্যান্ড ইন গ্লাভস কাজ করি। একটা যোগা সেন্টার, “যোগ ও আসন”, আছে যেখানে স্পেশাল চাইল্ডদের ব্যায়াম ও আসনের মাধ্যমে যতদূর সম্ভব শারীরিক সক্ষমতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তাছাড়া, “মনস্থলি”, একটা মন চিকিৎসালয়ও আছে। সেখানে রীতিমত সাইকোলজিস্ট, কাউন্সিলর, টক ও মেডিটেশন থেরাপিস্ট, সব আছেন যাঁরা স্পেশাল চাইল্ডদের সঙ্গে সঙ্গে বয়স্ক এবং এলজিবিটিকিউদেরও মনের দিকে আলো ফেলার চেষ্টা করেন। এখানে আমি নিজেও বসি। সবার বন্ধু হয়ে ওঠার সাথে সাথে পেশেন্ট আর থেরাপিস্টের মধ্যে দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করি। 

আমার এই পরিচয় সহজে আসেনি। 

আমি মগা। মগা জানেন তো? ব্যটাছেলে মাগী। মাগী মানে আদতে মেয়ে হলেও এখন তো …যাক। সাহিত্যের পাতায় আর অশ্লীলতা আনছি না।

একেবারে ছোটতে সমস্যা অত বোঝা যায় নি। বরঞ্চ, মেয়েলী বলে একটু বেশিই সুন্দর ছিলাম, একটু বেশিই আদর পেতাম। কিন্তু, বয়ঃসন্ধি পেরোতেই শারীরিক বৈচিত্র্যগুলি প্রকট হতে লাগল। বাইরে হাসি ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপের সম্মুখীন হতে লাগলাম। আবার, ভিতরে ভিতরে মনের যে পরিবর্তন আসতে লাগল, তাতেও আমি কিংকর্তব্যবিমূ়ঢ়‌ বোধ করতে লাগলাম। কারুর সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই। কে বুঝবে কেন আমার বড় চুল রাখতে ইচ্ছে হয়, শাড়ি লিপস্টিক পরে সাজতে ইচ্ছে করে। রান্না করতে, আলপনা দিতে ইচ্ছে করে। রান্না করা লাইফ স্কিল বলে সবাই উৎসাহ দেয়, কিন্তু আর কিছুতেই নয়। 

এর মধ্যেই এক কান্ড হল। মায়ের দ্বিপ্রাহরিক‌ ঘুমের সময়টা ছিল আমার স্বাধীনতার, আমার মুক্তির সময়। তখন আমি ইচ্ছামত মায়ের সাজের জিনিস নিয়ে সাজতাম, গান চালিয়ে নাচতাম, আরও যা যা ইচ্ছে করত, করতাম। শরীর খারাপ লাগছে বলে একদিন আমার পিতাশ্রী তাড়াতাড়ি বাড়ি এসেছেন। চা জল দিয়ে মা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। শুতে যাওয়ার আগে বাবা দেখতে এলেন আমি কি করছি। আমি তখন মায়ের শাড়ি পরে আপনমনে নাচছি। বাবার বাড়ি আসা বা আমার ঘরে ঢোকা, কিছুই টের পাই নি। টের পেলাম প্রচণ্ড এক চড়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। বকাবকির শব্দে মা ছুটে এসে হতভম্ব। এসব তো তাঁরও অজানা! শুরু হল ঘরে বাইরে অশান্তি।

বাড়িতে, বাবা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠতে থাকলেন। তাঁর কাছে ছেলের থেকে সামাজিক সম্মান ও মর্যাদার দাম অনেক বেশি। আমার মত ছেলের চাইতে “শূন্য গোয়াল” তাঁর কাছে নাকি অনেক বেশি কাম্য। নিজের মনকে বেঁধে রাখতে পারি, কিন্তু গলার মিহি আওয়াজ কি করে ঢেকে রাখব? তাছাড়াও আরও সূক্ষ্ম তফাৎ ছিল।

বাইরে, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ক্রমশ অশ্লীলতায় পরিবর্তিত হতে লাগল। সবাই খারাপ নয়। কিন্তু, যারা ভাল, তারা ভয়ে দূরে সরে গেল। মাত্র কয়েক জন বখে যাওয়া ছেলে আমার জীবন নরক বানিয়ে তুলল। 

এভাবেই স্কুলের গন্ডী পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। বাবার জিদে আমাকে একটা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে হল। আপনারা জানেনই এসব জায়গায় কি হয় আর কি হয় না! প্রচণ্ড যৌণ অত্যাচারে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হলাম। মরেই যেতাম কিন্তু মায়ের যত্নে ও সাহচর্যে সুস্থ হয়ে উঠলাম। কিন্তু, বাবার হেলদোল নেই। জোর জবরদস্তি শুরু হল আবার কলেজে যাওয়ার জন্য। মায়ের উপরও হুকুমনামা জারী হল। হয় স্বামী নয় ছেলে, বেছে নাও। ছেলের কথা শুনে চলতে চাইলে, বাড়ি ছাড়ো। 

মা আমাকে নিয়ে দাদুর কাছে ফিরে এলেন। দাদুকে অবশ্য মা সময়ে সময়ে আগেই সব কিছু জানিয়ে রেখেছিলেন। দাদু প্রথমেই আমার উপরে শারীরিক ও মানসিক এবং মায়ের উপর মানসিক অত্যাচারের কারণ দেখিয়ে পুলিশে খবর দিলেন। এক সঙ্গেই বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশও পাঠালেন। বাবার অফিসেও সব কিছুই জানালেন। মানে, সোজা কথায় প্রথমেই বাবার মান সম্মানের ফালুদা বানালেন। তার ফলে খুব তাড়াতাড়িই মোটা টাকা খোরপোষের বিনিময়ে কোর্ট বহির্ভূত বিবাহ বিচ্ছেদ পেলেন মা। মা অবশ্য টাকা নিতে একটুও রাজি ছিলেন না। দাদু বললেন এই টাকা তোমার জন্য না। তোমার জন্য আমার যা আছে, তাই যথেষ্ট। এই টাকা দাদুভাইয়ের। তার জন্যেই এই টাকা থাকবে। সেভাবেই উনি ব্যবস্থা করলেন যাতে মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা আসে, অথচ মূল আমানত ব্যাংকে নিরাপদ থাকে। 

এই সমস্ত গন্ডগোল আমার সেই বছরটা নষ্ট করল। নষ্ট করল আমার সমস্ত আত্মবিশ্বাস। গভীর বিষণ্ণতায় ঘরের বাইরে বেরোতে পারি না। অত্যাচারের ভয়ে কারুর সঙ্গে কথা বলার সাহস পর্যন্ত হয় না। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকি। দাদু গিয়ে কলেজ থেকে যে সমস্ত প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দেওয়া হয়েছিল, সব নিয়ে এলেন। অভিযোগও করলেন। তবে, শাস্তি দেওয়ার চেষ্টায় সময় নষ্ট করলেন না।

দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নিয়মিত : জ্বলদর্চি। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
🍂


আমাকে নিয়ে গেলেন মনোবিদের কাছে। বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পরও উল্লেখ যোগ্য উন্নতি হল না। কি করেই বা হবে? ওরা তো আমার মনের বন্ধ দরজাই খুলতে পারে নি! ওরাই বলল আরেক জন ডাক্তারের কথা। তিনি নিজের একটা আশ্রম মত খুলেছেন। সেখানে তিনি আবাসিক রোগীদের রেখে চিকিৎসা করেন। দাদু, দিদা আর মা আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। অনেকটা জায়গা নিয়ে এই কেন্দ্র। অফিস। ডাক্তারদের কেবিন। রান্না ঘর। খাওয়ার জায়গা। বাগান। ফুল। পাখি। তা ছাড়া প্রায় কুড়ি জন রোগীর থাকার ঘর। প্রত্যেকের আলাদা ঘর। আলাদা সেবিকা। তারা যেন মায়ের মত করে সেবা করে। আমি তো প্রথমে কিছুতেই মাকে ছাড়া থাকব না। কদিন মা থাকলও। তারপর আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে চলে গেল। আমি থাকলাম সেবিকা রেবা মা আর ডাক্তার সরকারের ভরসায়। প্রথম ছমাস কিছুই হয় নি। আমি শুয়ে থাকতাম ঘরে। আমাকে খাবারও ঘরেই দিতে হত। হটাৎ হটাৎ প্যানিক অ্যাটাক হত। কেঁদে কেটে মাথা কুটে রক্তারক্তি করে ফেলতাম। পরিবর্তন এল এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। অনেক বোঝানোর পর অনেক ভয় নিয়ে রাজি হলাম। আশ্রমের প্রতিষ্ঠা দিবস। রেবা মা আমাকে সাজিয়ে দিলেন। মায়ের বিয়ের লাল রঙের বেনারসি শাড়ি। লাল লিপস্টিক। হাতে গলায় কানে নানা রকম গয়না। মাথায় মুকুট। পায়ে নূপুর। আবার ফুলের মালা। আমি মঞ্চে উঠে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে নাচলাম। আবাসিকরা সবাই খুব হাততালি দিল। একটু পরে সাজ বদলে জিন্স আর টপ পরে ইংলিশ গানের সঙ্গে নাচলাম। আবার হাততালি।  আমার গানের সঙ্গে আরেকজন নাচল। আবার হাততালি। পরে অনেক অনেক ফটো দেখলাম। ভিডিও দেখলাম। বার বার দেখলাম। নিজেকে দেখে দেখে যেন আর কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। তারপর মেয়ে সাজার ইচ্ছেটাই চলে গেল। মেয়ে না হয়েও মেয়েদের মত ধর্ষনের যন্ত্রণা আমাকে ভোগ করতে হয়েছে। এবার মেয়ে সাজার সখও পূর্ণ হল। সেজে, নেচে, গেয়ে  পুরস্কারও পেলাম, হাততালিও পেলাম। পূর্ণ হলাম মনে হল। ভয় কাটল। আত্মবিশ্বাসও কিছুটা হলেও বাড়ল। 

বাড়ি ফিরলাম। দাদু ভর্তি করলেন মার্শাল আর্ট ক্লাসে। আক্রমন নাইই কর, নিজের রক্ষা নিজেকেই করতে হবে। আর যদি পার, অন্যেরও রক্ষা করো, এই ছিল দাদুর নির্দেশ। শিখলাম। শরীর শক্তিশালী হল। অনেক কিছুই শিখলাম। কিন্তু, তবুও মন কিন্তু অবসন্নই থাকল। নিজের উপর বিশ্বাস ভরসা কিছুই যেন নেই। 

এভাবে চলতে পারে না। 

কিন্তু, দাদু আর মা যেন কিছুতেই হাল ছাড়তে রাজি নয়। আবার আবাসিক জীবন। এবারে স্বামী নির্ঝরানন্দের‌‌ আশ্রমে। প্রথমে অবশ্য সেখানেও নানা রকম গন্ডগোল হল। কিন্তু, পরে স্বামীজি নিজেই আমার দায়িত্ব নিলেন। তাঁর সুযোগ্য নির্দেশনায় প্রায় চার বছর প্রাণায়ায়, ধ্যান ও সাধন করার পর আমি জানলাম, বুঝলাম, অনুভব করলাম যে আমিও শ্রী ভগবানের এক অপূর্ব সৃষ্টি। আমি সবার মত নই বলে আমাকে অনেক কষ্ট, অনেক যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়েছে। “মগা” শব্দটা শুনলেই আমি কানে হাত চাপা দিতাম, মরে যেতে ইচ্ছে করত। 

আজ আমি জানি “আমি মগা। আমি কারুর মত নই। আমি শুধু আমার মত”। 

তারপর পড়াশুনা। নিজের সঙ্গে অন্যকেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ব্যবসা।‌ 

আর, আজ! আজকে আমার সামনে মিস্টার মনি ভূষণ সেন। অহঙ্কার ও দুর্ব্যবহার তাঁকে সমাজে একাকী করেছে। ভয়ঙ্কর একাকীত্ব ও বিষন্নতা তাঁকে মানসিক ভাবে অসুস্থ করেছে। আতঙ্কের মুখে দাঁড় করিয়ছে। অর্থ ও সম্মান তাঁকে সাহায্য করে নি, শেষে মনস্থলিতে, আমার কাছে এসেছেন সাহায্য পাওয়ার আশায়! চোখে জল নিয়ে মাথা নিচু করে আমার সামনে বসে আছেন। বোধহয় এই জন্যেই বলে “পাপ বাপকেও ছাড়ে না”।

         ।। মধুর প্রতিশোধ।।

Post a Comment

0 Comments