জ্বলদর্চি

ড. কাঞ্চন কুমার ভৌমিক (কৃষি বিজ্ঞানী, পাঁশকুড়া) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৮৬

ড. কাঞ্চন কুমার ভৌমিক (কৃষি বিজ্ঞানী, পাঁশকুড়া) 

ভাস্করব্রত পতি

ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রত্যেকটি পরিবারেই সুগার, প্রেসার, এমনকি ক্যনসারের মারনব্যধি চরম আকার নিতে শুরু করেছে। ক্ষেতের ফসলে ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত বিষ নানাভাবে আমাদের রান্নাঘরের মাধ্যমে শরীরে ঢুকে পড়ছে। মানসিক স্বাস্থ্য আজ ভুলুণ্ঠিত। স্বাভাবিকভাবেই যৌথ পরিবার তথা মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনাবোধের বিকাশ কমতে শুরু করছে। যাঁর মূলে বিষযুক্ত খাবার। যে খাবার মানুষের সুস্থ সবল জীবনের অন্যতম অন্তরায় হয়ে উঠছে। সেই সমস্যা থেকে মুক্তি না দেওয়া হলে মানুষের জীবন যে ক্রমশঃ দুর্বিষহ হয়ে উঠবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর তাই তিনি লড়াই করছেন প্রত্যেকটি মানুষের খাবারের থালা বিষমুক্ত করার। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুগার, প্রেসার, হার্ট অ্যাটাক ও ক্যনসারের মতো মারনব্যধিতে অচিরেই শেষ না হয়ে যায়। এহেন মানুষটি হলেন ড. কাঞ্চন কুমার ভৌমিক। 

পিংলার পিন্ডরুই ৮ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন উপলদা গ্রামে বাড়ি হলেও এখন থাকেন পাঁশকুড়া পৌরসভাতে। ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নকুল চন্দ্র ভৌমিক এবং মা উষারানি ভৌমিক। স্কুল শিক্ষক বাবার চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ। পশ্চিম মেদিনীপুরের গোবর্দ্ধনপুর প্রমথনাথ বিদ্যায়তনের ছাত্র ছিলেন কৃষিবিজ্ঞানী ড.কাঞ্চন কুমার ভৌমিক। এখানকার ছাত্রাবাসে থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। ১৯৯২ তে মাধ্যমিক ও ১৯৯৪ তে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ৮১ শতাংশের বেশি নম্বর পান। এই পরীক্ষায় ৮৮ তম স্থান পেয়ে জাতীয় বৃত্তি লাভ করেন। এরপর বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এগ্রিকালচার বিষয় নিয়ে। এই সময়ে বিশ্বের সবুজ বিপ্লবের জনক নোবেল জয়ী নরম্যান বোরলগ এবং ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক এম এস স্বামীনাথনদের জীবন এবং কাজ তাঁকে ভীষণ আলোড়িত করেছিল। মনে মনে সংকল্প করতে থাকেন দেশের কৃষিএখান থেকে আই.সি.এ.আর. স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৯৯ সালে সাম্মানিক গ্র্যজুয়েট ও ২০০১ সালে মাস্টার ডিগ্রী লাভ করেন ৮৭ শতাংশের বেশি পেয়ে। এরপর আই.আই.টি খড়গপুর থেকে ডক্টরেট লাভ করেন। লন্ডন গ্র্যাজুয়েট স্কুল (কমলওয়েল্থ ইউনিভার্সিটি) থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট এর জন্য মনোনীত হন। ইতিমধ্যে পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি সম্মান, ইউনেস্কো সম্মান। তিনি ইউরোপ, আফ্রিকা, আরব দেশ, সোভিয়েত রাশিয়া, সেন্ট্রাল এশিয়ার বিভিন্ন দেশে গিয়ে 'সায়েন্টিষ্ট অ্যাওয়ার্ড' পেয়েছেন। তাঁকে দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক অ্যাকাডেমিক এক্সেলেন্স সম্মান। কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিশ্বের আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট দেওয়ার প্রস্তাব পেয়েছেন। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পান সৈয়দ হেদায়েতুল্লা সম্মাননা। 

পাঁশকুড়া ব্র্যাডলি বার্ট হাইস্কুলে এগ্রিকালচার বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরি শুরু করলেও তা ছেড়ে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সি.এ.ডি.সি'তে কৃষি আধিকারিক পদে বিভিন্ন জেলায় দীর্ঘ ৯ বছর কাজ করেছেন সাফল্যের সাথে। এজন্য তাঁকে দিনের পর দিন থাকতে হয়েছে ঝাড়গ্রাম, হাওড়া, পুরুলিয়া, কলকাতা, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের ফার্মে। তাঁর কাজ ছিল ধান, গম, ডালশস্য সহ নানা ধরনের উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদন করা। এ সময়েই তিনি জৈব ইউরিয়া আবিষ্কার করেন ঘরোয়া পদ্ধতিতে। তারপর পশ্চিমবঙ্গের স্টেট লাইভলিহুড অফিসার তথা রাজ্য মিশন প্রবন্ধক নিয়োজিত হন। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের 'জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশনে'র রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞানী (এন.আর.পি. - এস.এ)। সেইসাথে বিশ্বের ১৮৪ টি দেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের প্রতিষ্ঠান 'গ্লোবাল সেন্টার ফর সাসটেনেবল এগ্রিকালচার অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি'র বিশ্ব সঞ্চালক এবং ইউএস অ্যাগ্রোর প্রিন্সিপাল সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করে চলেছেন মেদিনীপুরের এই মানুষ রতনটি। ক্ষেত খামার চষে কৃষির নানা পদ্ধতি এবং নানা আধুনিক উপায় নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন অক্লান্তভাবে। দেশের এবং দশের মঙ্গলের জন্য তাঁর এই কাজ কেবল চাকরি বাঁচানোর জন্য নয়। আসলে মনপ্রাণ মিশিয়ে দিয়েছেন নিরাপদ খাদ্যের জোগান ও জোগাড়ের উপায় বাতলাতে। তাঁর চোখে ধরা পড়েছে কৃষি নিয়ে উদ্ভুত সমস্যার চিত্র। তা মোকাবিলা না করতে পারলে অনাগত ভবিষ্যতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তাঁর মতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার অপর্যাপ্ত হারে বেড়ে যাওয়ার দরুন একটা অন্ধকার প্রচ্ছায়া ঘনিয়ে আসছে। তা থেকে মুক্তি দিতে তিনি সচেষ্ট। তাই প্রস্তাব দিয়েছেন হলুদ, আদা, ধুতুরা, রসুন, নিম, গাঁদা, বনকলমি, কলকে, বাবলা, বিশল্যকরণীর চাষ করতে হবে যত্রতত্র। এগুলো আসলে জৈব সার তৈরির অন্যতম উপকরণ। কৃষিক্ষেত্রে জৈব সারের প্রয়োগ না বাড়ালে সমস্যার শেষ হবে না। বাড়াতে হবে গবাদিপশুর চাষ। না হলে দেখা দেবে তুমুল খাদ্যসঙ্কট। যা একটা উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে মোটেও মঙ্গলজনক হবে না। 
রাজ্য সরকারের বিভিন্ন ফার্ম হাউসে থেকে কৃষি উন্নয়নের সাথে যুক্ত থাকার সময় কৃষির জৈব সার ও জৈব কীটনাশক বানানোর কাজ করতেন। সেসময় কিছু গ্রোথ স্ট্যান্ডার্ড দেখে চমকিত হন। গুড়, তেতো পাতা, ব্যাসন, গোমূত্র, গোবর দিয়ে তৈরি করেন জৈব ইউরিয়া। যাতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ১৭ শতাংশ। রাসায়নিক ইউরিয়ার নাইট্রোজেনের পরিমাণ ৪৬ শতাংশ থাকলেও মাটিতে ব্যবহার করার পর মাত্র ১০ শতাংশ অবশিষ্ট থাকে। বাকিটা উবে যায়। কিন্তু জৈব ইউরিয়ার পুরো নাইট্রোজেন মাটিতে মেশে। সেইসাথে মাটির PH মাত্রা ঠিক থাকে। মাটির উর্বরতা বজায় রাখে। ২০১৫ তে তিনি এর সত্ব পান। নাম দেন 'বেঙ্গল জৈব ইউরিয়া'। দক্ষিণ ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে তা ব্যবহৃত হচ্ছে। নিজেদের এহেন আবিষ্কার নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পেটেন্টের আবেদন করেন। যা এখনও ফার্টিলাইজার অ্যাক্টে এন্ট্রি না পেলেও মাটি, জল, পরিবেশ তথা বিষমুক্ত খাদ্যের জন্য তাঁর এই আবিষ্কার জৈব ইউরিয়া ও 'কাঞ্চনকণা' দিশা দেখাবে আগামী প্রজন্মকে। 

কৃষি নিয়ে নিবিড় গবেষণার জন্য গিয়েছেন ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যেই। বিশ্বের ৫০ টির বেশি দেশের কৃষি ব্যবস্থা সরেজমিনে দেখে এসেছেন ভারত সরকারের কৃষি উন্নয়নের অন্যতম পলিসি মেকার হিসেবে। গিনি, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, ভুটান, কুয়েত, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, তুরস্ক, আফগানিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কুয়েত গিয়েছেন কৃষিবিজ্ঞানী হিসেবে। হাইব্রিডাইজেশন ও জেনেটিক্যলেল মডিফায়েডের ফলে এখন কোনও খাদ্যই আর মনুষ্য উপযুক্ত নয়। তাই সারা পৃথিবী জুড়ে সজনে, মিলেট ও কাশাভা'র প্রমোশান মিশনের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. কাঞ্চনকুমার ভৌমিক।

বিশ্বের ১৮৪ টি দেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের প্রতিষ্ঠান 'গ্লোবাল সেন্টার ফর সাসটেনেবল এগ্রিকালচার অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি'র বিশ্ব সঞ্চালক এবং ইউএস অ্যাগ্রোর প্রিন্সিপাল সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করে চলেছেন মেদিনীপুরের এই মানুষ রতনটি। ক্ষেত খামার চষে কৃষির নানা পদ্ধতি এবং নানা আধুনিক উপায় নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন অক্লান্তভাবে। দেশের এবং দশের মঙ্গলের জন্য তাঁর এই কাজ কেবল চাকরি বাঁচানোর জন্য নয়। আসলে মনপ্রাণ মিশিয়ে দিয়েছেন নিরাপদ খাদ্যের জোগান ও জোগাড়ের উপায় বাতলাতে।

Post a Comment

0 Comments