জ্বলদর্চি

আকাশ মৃগয়া /নির্মাণ মহান্তী

আকাশ মৃগয়া

নির্মাণ মহান্তী

'বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ।
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে।।'


স্বরূপ ও প্রশ্ন

"...And I have felt
A presence that disturbs me with joy
Of elevated thoughts; a sense sublime
Of something far more deeply interfused,
Whose dwelling is the light of setting suns,
And the round ocean and the living air,
And the blue sky, and in the mind of man..."

এ কি প্রশান্ত নিভৃততা অন্তরে অগুন্তি কাজের মাঝে আমাকে ভাবায়?
সেই অনাদিকাল থেকে,কত পথে নীরবে হেঁটেছি আমি।
কত প্রভাতে -রাতে সম্মুখের চিরপরিচিত প্রান্তর থেকে 
কখনো বা দূর ভূমধ্যসাগরের তীরে-
বর্ষামুখর বাদামি সন্ধ্যায় মেঘাবৃত আকাশের রহস্যের নীচে।
কত পথ হেঁটেছি আমি,
আরো অজস্র পথ অনন্ত আগামীর বুকে গর্জায়।
তোমাদের অজ্ঞাতসারে,
আকন্ঠ পান করেছি আমি শুদ্ধ জীবনের সংকেত।
প্রাণের স্পন্দনে জেগেছি বারবার
মহারাত্রির কালিকে ঠেলে সরাতে চেয়ে;
করেছি অনুদ্ভাসিত কোন আলোকের সন্ধান।

দুর্গম কত পথে হেঁটেছি বিচিত্র একা,
কখনো বা বলেছি প্রবল চিৎকারে:
হে নিবিড় কুয়াশা, একটুখানি পথ করে দাও তুমি
আমার জন্য সামনে এগোবার...

অনন্ত ভুবন জানতে চেয়েছে আমার পরিচয়।
আমাকে দিদৃক্ষু করেছে মাটি,জল ও নীহারিকা,
আমাকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে  তারা
তারপর ভাসিয়েছে পুনঃ পুনঃ আমারই সাগরে।
তোমরা কি শুনেছো সে গান?পড়েছো সে লিপি?
 এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে,কান পেতে শুনে এসো জগতের আগে ,
আকাশকে তখন আরো সুন্দর মনে হবে,
বাতাসকে মনে হবে অমৃতের গন্ধে ভরা ...



 ধূসর অরণ্যে শতাব্দীর নিস্তব্ধতা

"The eyes are not here
There are no eyes here
In this valley of dying stars
In this hollow valley...'

অলসভাবে আমরা সকলে বসেছিলাম নির্বাপিত অগ্নিকুন্ডের কাছে
শীতের দিবাবসানে, নরম ঘাসে গাঢ় অম্বর মিশিয়েছিল
আপন বর্ণের ছটা।
আর আমরা তখন সেই গভীর শূন্যতায়,
ক্লান্তভাবে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম মহাজগতের ইঙ্গিত।
এ প্রচেষ্টা করেছি আগেও বহুবার
কত সহস্র বছর আগে,
হয়তো বা মহাকাব্যের যুগে...
এ সবের মাঝে ভগিনী
তুমি ছিলে একজন।
কত দীর্ঘ জন্মে সে সন্ধানে সঙ্গী ছিলে
আরো অনেকের মতো
ধরিত্রীর গুপ্ত নৃত্যের তালে।
 হেঁটেছিলে কত পথিকের চরণধুলো মেখে 
আরো একরাশ ধূসর জনতার
ক্লান্ত মস্তিষ্কের মলিন বৈপ্লবিকতার অগোচরে,
হয়তো তটিনীর মৃদু ছন্দে,
অজ্ঞাত শব্দের মতো।


আজ অনিত্য,অসত্য নিশাস্বপ্নের মতো
 মানুষের বিচলিত দীর্ঘশ্বাস
আমাদের দিশেহারা করে
সূর্যের অসারত্বের কথা বলে,
বলে চির কুহেলীপুঞ্জের কথা।
আমরাও সেই স্রোতে ডুবে যাই,অন্তর বিস্মৃত হয়,
বিস্মৃত হয় মানুষের গানে গানে চলিষ্ণুতার ঠিকানা!
আজ সাগরের ঘ্রাণে দেখি-
সমস্ত ব্রহ্মান্ডের রেণু গায়ে মেখেছি অলক্ষে,
তবু কতকাল নিজেকে অচলিষ্ণু ভেবেছি আমি!
আকাশ কি মাঝে মাঝে হেসে ওঠে বিদ্রুপে?

এ শতাব্দীর অজস্র রজনীতে জেগে
আমি কাব্যের সারশূন্যতা দেখেছি,
দেখেছি , মনে তমসাসিক্ত তত্ত্বের কোলাহলে
ঢেকে গেছে অজস্র মানুষের  ভাষা;
আমি দেখেছি অদৃশ্য একটা দোয়াত,
ঢেলে দেয় কালি, সকলের স্বচ্ছ দিঠির উপর।
নির্জীব মানুষও তখন অস্থির হয়,
অর্ধনিমীলিত চোখে বুদ্ধিহীন;তারা চারপাশের মানুষকে দেখে...

সমস্ত চরাচর জুড়ে নেমে আসে আমাদের ঘিরে,
কুহেলিভরা নিশীথরাত্রির আহ্বান-
আমাদের বাহ্য চেতনার উপর
এসে থামে সমস্ত ধরণীর ধূসর নিস্তব্ধতা।
উন্মুখ বীতিহোত্রের থেকে দূরে,
স্পন্দনহারা অলীক নির্বাসনের দেশে
ভগিনী তুমি লুকোলে কোথায়
এ প্রদোষে?
চারিপাশের এ বেদনাশ্রিত অন্ধকারে থেকেও 
সমস্ত বিশ্বের খবর বুকে ধরে রেখেছি আমি,
জেনেছি সঙ্গোপনে এর সমগ্রটাকে,
অজস্র পদশব্দ, আর কন্ঠস্বর আগলে রেখেছি
হৃদয়ের প্রকোষ্ঠতলে।

তবে তুমি আড়াল কোথায় পেলে?
তুমি লুকোলে কোথায়?
বিশ্বের কোথায় গা ঢাকা দিয়েছো তোমরা?
অনন্তকাল প্রশ্ন করি।উত্তর মেলেনি তবু...
এই শত বছরব্যাপী বিস্তৃত  তিমিরে 
অদৃশ্য ছায়া কিছু নড়ে ওঠে।
কার কথা শোনে কুয়াশারা? 

'Month follow month with woe,and year wake year to sorrow.'


অগ্নির কথা

আমরা অপেক্ষারত,
আজও অপেক্ষা শেষ হয়নি আমাদের।
দূরে আরো দূরে,
ওই তারকামন্ডল থেকে নেমে আসে
স্নিগ্ধ,শান্ত নির্ঝরিণীর জল।
কলকলরোলে কলেবর তার
যেন পাখির দুরন্ত পাখনা।
চোখ তার কস্তুরীসম;
গন্ধ বিলায়ে ফেরে মহাগগনের মাঝে।
প্রশান্তির উপঢৌকনে ভরে তোলে আঙ্গিনা আমার!

ব্যাপ্ত ছায়াপথে,
অজস্র অস্ফুট অবয়ব দেখি।
তারা জানতে চায় কোন অজ্ঞাত মৃগয়ার কথা।
আমাদের আলোড়িত করে সেই মহামৌন গহনে-
নিবিড় নিবিড়ে, বহুকাল হল যার হারিয়েছে দিশা।

তুচ্ছ আরম্ভ ও সমাপ্তি স্তব্ধ হয়,
নীরব অবনত মস্তকে স্তব্ধ হয়
তাত্ত্বিকের গভীর মননের গতি সশ্রদ্ধ প্রণিপাতে।
বিষ্ময়ের আকুতিতে থেমে যায় কবির কলম-
নেমে আসে উদার নৈঃশব্দ্যের গুঞ্জন;
সুরভিত সে গভীর অরণ্যে
আমাদের চেতনা ফুলের সুবাস রূপে আসে...

এইখানে থেকে থেকে 
কাদের আনাগোনার শব্দ শুনি মনে...
এ শ্রান্ত বিদিশায় ,
তাদের নরম চোখের ভিতর উদগ্র আগুন দেখেছি আমি!
দরিদ্র চাষীর ক্ষেতে
দীর্ঘ অমানিশার শেষে
এসে নামবে কি,
স্বপ্নের বৃষ্টিমুখর ভোর?
তারা এনে দেবে নদী,সাগর আর পর্বত-
মানুষের বেঁচে থাকা
শুচি হবে অগ্নিস্নানে,
কবেকার ঘনীভূত  সন্ধ্যায়,
নিঃসঙ্গ আবরণ তার
মুছে যাবে ,
বন্ধু অমলও আসবে শীঘ্র।

জেগে উঠবে সুর , জেগে উঠবে ভাষা,
আমরা অবাক হব।
ওই আলো আমাদের নতুন করে বাঁচার কথা বলবে...

"Sightless, unless
The eyes reappear
As the perpetual star
Multifoliate rose
Of Death's twilight kingdom
The hope only 
Of empty men."



শেষ রাতের কথকতা

 " মধু-সমীরণ বহিছে শুভদিনে,
... অমৃত ঢালে।"

মানুষ কি জেগে উঠেছে প্রভাতী শুনে?
আত্মহারা জ্যোতির্বিন্দুর মতো সকলে বিকশিত হই,
জগতে অন্তর খুঁজে আনি,গান গাই।
  আমাদের সামনে এসে থামে বিপুল নক্ষত্রের স্নিগ্ধতা,
ধূমের স্তূপ মহাগগনে অনায়াসে বিলীন হয়।

ভগিনী তখন তোমার মমতার মতো 
অজস্র জনতার বিপুল অন্তরাল থেকে
নীরব সেই তার অভিনব ভঙ্গিতে বার হয়ে আসে 
নয়নমোহিনী আলো।

বার হয়ে আসে তোমার আড়ালে মহত্ত্ব মানুষের ,
অথবা মানুষের আড়ালে অকপট তোমার বেঁচে থাকা,
তোমার মহাজীবনের আয়োজন।
জিজ্ঞাসু আমি
জিজ্ঞাসু আজও।
তীব্র জ্যোতি 
আমাদের আলিঙ্গন করে হাসে
আমরা তার ভাষা বুঝিনি
তবু মেতেছি তার আনন্দের স্রোতে।
আমরা তার কন্ঠ শুনিনি
তবু আজও উন্মত্ত হই সে ডাকে...
সৌম্য ধরণীর মাঝে থাকে সঙ্গীত,
থাকে জীবন,
আর থাকো তুমি,
থাকে আমাদের অন্তরে অগোচরে 
এ মেদিনীর মাঝে তোমাকে জানার প্রসন্ন কথকতা।

"এখনো বসে আছো? চল যাই...রাজার ঐশ্বর্য লুকানো রয়েছে... তুমি দেখতে পাচ্চ না... চল আমরা যাই।"
" জানার গন্ডী এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশ্যে...
চল এগিয়ে যাই।"

Post a Comment

0 Comments