সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ২০
গৌতম বাড়ই
বসন্তসেনাও বুঝতে পারছিল অঙ্কুশের বাইরে চাকরি করতে চলে যাওয়াই শ্রেয়। এ কথা তো মানতেই হবে এ পোড়ারাজ্য আর ছেলেমেয়েদের চাকরির জন্য সবকিছু বিবেচনা করে উপযুক্ত নয়। দলে- দলে মেধাবী ছেলেমেয়েদের থেকে শুরু করে, কায়িক পরিশ্রম করা অল্পবয়সী শ্রমিক পুরুষের দল উপযুক্ত রোজগারের আশায় আজ রাজ্যের বাইরে। শয়ে- শয়ে, হাজারে- হাজারে। অঙ্কুশ তাই তার মেধা আর পরিশ্রমের দাম পেতেই চূড়ান্ত ভাবেই বাঙ্গালোরে এই মুহূর্তে চলে যাওয়া ঠিক করল। বসন্তসেনার মনের ফোঁকরেও যে ভিনরাজ্যে পাড়ি দেবার বাসনা উঁকি দিচ্ছিল না, তা নয়, উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় সে এখন প্রতীক্ষা করতে থাকবে।
সুশোভনবাবু ঘরে ঢুকে যখন মেয়ের সাথে মুখোমুখি বসেছেন চায়ের কাপ হাতে, তখন বললেন- " হাসনু-মা অঙ্কুশের একদম সঠিক সিদ্ধান্ত। এত বড় প্যাকেজ, এ কলকাতার কোন কর্পোরেট সেক্টর দেবেই না। কারণ ওরা জানে, ওর থেকে কম দিলেও এখানে জবের জন্য সমমেধার ছেলেমেয়েরা হামলে পড়বে। গোটা রাজ্যেই তো শিল্প, সে যে কোনও ধরনের হোক ,আজ ভাঁটার টান। সিঙ্গুরের জমি সংক্রান্ত বিবাদে একটা আশিভাগ সম্পূর্ণ হওয়া ভারী শিল্প পাততাড়ি গুটালো এই রাজ্য থেকে। না সেই সময়ের রাজ্য সরকার , না সেই সময়ের বিরোধী শুধুমাত্র রাজ্যের ভালোর জন্য এক জায়গায় আসতে পারলো। অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রে এ কিন্তু ঘটত না। বিরোধী বা সরকার নিজেদের ভালোটা বোঝে, আর বোঝে সেখানকার মানুষজন। আমাদের রাজ্যের রাজনীতিবিদরা নিজেদের আখের গোছাতে যা বোঝায় আমরা অবলীলাক্রমে তাই মেনেনি। আমরা এই রাজ্যের মানুষেরা খুব স্বল্প চাহিদার মানুষ, আর আছে বাঙালি কিছু সবিশেষ মেধাজীবি, তাদের নিরপেক্ষ আচরণ সমাজের স্বার্থে বা রাজ্যের স্বার্থে কোনোকালে দেখা যায়নি, আজও নয়। এরা শুধু নিজেদের ভালো থাকবার অবস্থান বেছে নিয়ে সুখে আছেন। এদের ভাববাদ বা মতবাদ থেকে যেদিন সাধারণ লোকজন বেরিয়ে আসতে পারবেন, সেইদিন সবার জন্যই মঙ্গল। এই আমার অভিমত। মা, তুইও তোর নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন পেতে গেলে অবশ্যই বাইরের রাজ্যে পাড়ি দিতেই হবে। সমস্ত কর্পোরেট সেক্টর তো পশ্চিম আর দক্ষিণের রাজ্যগুলিতেই! আমি তাই বলছি অঙ্কুশের একদম সঠিক সিদ্ধান্ত। ওকে অবশ্যই মানসিকভাবে সাহস যোগাবি।"
🍂
বসন্তসেনা বললে- " বাবা অঙ্কুশ ও যথেষ্ট বুদ্ধিমান। ওর নিজের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত বুদ্ধি আছে। অঙ্কুশ নিশ্চয় তোমার মতন সব ভেবেই এই অফারটি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছে। "
সুশোভনবাবু বললেন-" তুই অন্যভাবে নিস না। আমি জাস্ট নিজের ভাবনাটাই তোকে জানালাম। অঙ্কুশের সাথে কথা বলেই বুঝেছি, ওর বাইরেটা দেখে ওর ভেতরের বুদ্ধিমত্তা টের পাওয়া যায় না। ও সত্যি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। "
বাবা- মেয়ের কথোপকথনের মধ্যে রাত বাড়তে লাগল। এইভাবে প্রতিটি রাতের সাথে একটি করে দিন শেষ হয়ে আসে। রাত আবার একটি নতুন দিনের জন্ম দেবার জন্য অন্ধকারের গহ্বরে হারিয়ে যায়। নতুন দিন মানেই আবার একটি নতুন সূর্যের আলোয় সমস্ত দিক আলোয় আলোয় ভরে উঠবে। সুশোভনবাবুর মধ্যে আজ অনেকদিন পর ঈশ্বরচেতনার জন্ম দিল। আগেও যে ভাবনাতে আসেনি তা নয়, তবে ঈশ্বর নিয়ে তিনি ভাবতে ভাবতে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেন নি। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কী নেই? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি সবসময় , তার মনের গভীরের বিশ্বাস থেকে , ঈশ্বর বলে কারো অস্তিত্ব নেই এই ধরেই এগোবেন। তবে সারা পৃথিবীশুদ্ধ মানুষজন এত ঈশ্বর বিশ্বাসী কেন? অথচ তাদের কেউই ঈশ্বরের ছোঁয়া বা দেখা পাননি। যারা প্রচার করেন পেয়েছেন,তারা কিন্তু ধর্ম প্রচারক বা বিভিন্ন গুরুজী বা বাবাজি। মানুষ ভীত তাদের অদৃষ্টবাদ নিয়ে, তাই তারা সেই অদৃষ্টবাদের পূজারী। আবার ঈশ্বর এলেই, ধর্ম প্রসঙ্গ আসবেই। কেন? যদি ঈশ্বর একই হয়, তবে ধর্মও তো একটি হবে? তাহলে ঈশ্বরও কী বহুজন? সুশোভনবাবু ভাবছেন আর ভেবেই চলেছেন। বহুজনের বিশ্বাস আর নিজের বিশ্বাস এই দুটি ভিন্ন চিন্তাধারার দ্বন্দ্ব তার বহুকাল ধরে মনের মধ্যে ক্রিয়া করে আসছে।
আর বসন্তসেনার মনেও সাময়িক ঘটনার এই ঢেউগুলো চিন্তাকে কোথাও যেন নিক্ষেপ করছে বারেবারে। চিন্তা আর ভাবনা নিয়েই তো আমাদের এগিয়ে চলা।
ক্রমশ
0 Comments