বাগদি চরিত ( চতুঃচত্বারিংশতি পর্ব )
শ্রীজিৎ জানা
বেগদা হাঁড়ির পান্তা- আমানির আলাদা সোয়াদ। যাদের কপালে জুটেনি,তারা অভাগা। লোখা কেন,ঢোলের অনেকেই মনে করে। লোখা বলে,
— একটু বেগুনপড়া চুকুটা,নাইলে মাচ চুকুটা পেলেই হল,জামবাটি পুরা উল্টি দুব। আগে ত মোর বাপকে দেকতম,বাসি গ্যাঁড়ার টক দিয়ে পান্তাকে সাবাড়ে দেয়ঠে। ঠাকুর্দা ত আমানিয়ে কাঁচা লঙ্কা গুলে চঁচান দিত।
খুঁদিঘর থেকে বেরিয়ে সোজা পান্তার জামবাটির সামনে বসে। ময়নার রাগ কোথায় যেন উড়ে গ্যাছে। লোখার পাশেই তালচাটি পেতে বসে যায়। খাওয়ার সময় লোখা খুব একটা কথা বলে না। ময়না জানে। তারসঙ্গে এও জানে,এখুনি লোখা মুড়ি চাইবে। পান্তাভাতের আমানিতে মুড়ি ভিজিয়ে লোখা খেতে খুব পছন্দ করে। সেই বুঝে আগে ভাগেই কাঁসিতে করে ময়না মুড়ি এনে রেখেছে পাশটিতে।কিন্তু এই মুহুর্তে কি যেন একটা কথা লোখার মনের ভিতরে পাক খাচ্ছে। বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। সবেমাত্র বউকে সে ঠান্ডা করেছে। এখুনি কিছু বলা মানেই সব পরিশ্রম জলে ফেলে দেওয়ার মতো। বাধ্য হয়েই মুখ বুজে খায়। কিন্তু সবদিনের মতো ময়না জিগ্যেস করে,
— কি গো আর চাট্টি পান্তা লিবে?
— নাহ্, অনেক খেই লিইচি। টক আমানি এট্টু চঁচাতে হবে। হেবি সেন উটচে আমানির!
— এই যে বোলছিলে খিদায় তসার মাথা ঘুরি দিইল। থাইলে? হাঁড়িয়ে ভাত ত আছে অ্যাখনো।
— থাউ – তুই লিবি ত দশটি লেনা। তাবাদে..
—-তাবাদে কি বোলবে আমি জানি। তমার বৌদির কথা বোলবে ত?
— রাগিসিনি তুই। আসলে ঘরে ত এই কটা পেরানি থাকি। যতই রেগে যাই,সবাই খেয়ে লুব আর সে খাবেনি,সেটা কি ঠিক হবে! যেদি আলাদা থাকত,থাইলে কুনু ভাবার ছিলনি।
— ইটা ত আমি জানতম। দেকছিল তমার পেট থিকে কখন কখাটা বেরায়। তমাদের ভাইদলের অর উবরে এত কেনে দরদ বুজতে পারিনি।
— দ্যাক্ দরদ -টরদ নয়, একঘরে থেকে যেদি তাকে খেতে না দেউ,পাড়া বাখুলে কথা উঠবেনি ত! তাবাদে দেক্, আসি সেজদার মুখ চিয়ে টান টানিঠি। ভাইপোটার কথাও ভাবিঠি।
— তুমি তমার দাদার টান টানঠ কুন্তু সেকি সেজ ভাসুরের কুনু মানসম্মান রাখেঠে। অমন একটা দেবতুল্য লোকের বউ হোয়ে অর এরকম বেভিচার করা সাজেঠে!
— সে ত তোকে বোলেইচি। সুদু সময়ের অপিখ্যা। এখন ত কিছু বোলবোনি। এগবার যেদি তাল পাই,তখন দেখবি লোখা বাগদির মুখের বোলচাল ক্যামন! দাদা হউ আর বৌদি,কুনু মানামানি থাকবেনি তখন।
লোখার তর্জনগর্জন দ্যখে ময়না ভিতরে খুশি হয়। স্বামীকে যে সে বোঝাতে পেরেছে,তাতেই যেন তার জয়। তবে আবার ভয়ও পায় মনে মনে। পুরুষ মানুষের রাগ বলে কথা। মাথা গরম করে হিতে বিপরীত না করে ফেলে। ভয়ে লোখার রাগের আগুনে জল ছিটাতে চায়।
—তমার ত সবেতেই হঁক্ কঁক্ করা স্বভাব। ক্যানে বাপু, যখন বুইতে পটারবে তখন তার বাপের ঘরের লোককে ডেকে আলাদা থাকতে বোলে দিবে,ব্যাস্। তার কুনু লেপসায় আমরা থাকবোনি।
— সে তোকে বোলতে হবেনি। এরকম বেলেল্লাপনা আমি সোজ্জ করে লুব মনে করেচু। তবে কটা দিবন তুই চুপ মেরে থাকবি,কুনু কিছু বুজতে দিবিনি। তারপর দেকনা মজাটা।
— লাও দিখি,ঢের হইচে। এবার উঠে পড়। আমি সোগড়ি লুব। আবার রাঁদার সময় হয়ে গেল। আর শুন,ময়না বাগদিকে অতটা নিষ্ঠুর ভাবনি। মোরও বুকে দয়া মায়া আছে,বুইলে। জামবাটিয়ে দিদির জন্নে আলাদা কোরে বেড়ে রেখে দিচি। মাঠ থেকে এলে সে খেই লিবে।
লোখা অবাক চোখে ময়নার মুখের দিকে তাকায়। মাঝে মাঝে ময়নাকে সে চিনে উঠতে পারে না। শিলাইয়ের ঘূর্ণিপাকের মতো মেইয়াদের মনের স্রোত পাক খায়। কখন কাকে পাড়ের দিকে ঠেলে দেবে,কখন কাকে সেই ঘূর্ণপাকে তলিয়ে দেবে বোঝা মুশকিল। লোখা মুচকি হেসে দুয়ার থেকে উঠানের পৈঠা ভেঙে ভিটার নীচে নামতে থাকে। হঠাৎ পিছু ডাকে ময়না,
— কি বোলিঠি,শুন না। কুথাকে যাউঠ তুমি?
— কেনে? কি বোলবি?
— বোলিঠি কি, বাচাড়ি জালটা লিয়ে একটু বিলের দিকে যাওনা। ঘরে রাঁদার মত এট্টুও আঁশপাতি নাই কুন্তু। খাওয়ার সময় পাতে এট্টু মাছটাচ না থাকলে ত কাঁইমাই করবে! ছ্যানা গুলানও ত হোইচে তমার মতোই টিট্টিরা।
মাছ ধরার কথায় লোখার কোন ব্যাজার নাই। বাগদি মাছ ধরতে মুখ মুড়ে না সহজে। অন্য সময় পেছন ডাকলে লোখা চটাক করে রেগে যেত। কোন উত্তর না করে ঘুরে আসে। খিয়া চালটা ক্যাঁদাল থেকে নিয়ে ঘাড়ে ফেলায়। খালইটার দড়ি ট্যাঁকে গুঁজে নেয়। ব্যাটাছ্যানা দুটা কাছে নেয়। ভিটার নিচে নামতে নামতে হাঁক পাড়ে। মাছ ধরার অনেক টোটকা আছে। ঢোলের মেছা-বাগদি মানেই এসব টোটকা মেনে চলে। লোখার বাপ মাছ ধরতে যাবার আগে তার মাকে খোঁজ করত। তার বাপ কেন যে ওরকম বলে মায়ের খোঁজ নিত,লোখা আজও বুঝে উঠতে পারেনি। মাকে না দেখতে পেলেই বোলত,
— কোচা তোর বৌ-কে দেখেচু কুথা গেল? ডেকে দে দিখি এগবার।
কেন এভাবে বোলত খগেন মাস্টারকে জিগ্যেস করবে ভেবেও করা হয়নি তার। তবে মাছ ধরকে যাওয়ার সময় তার মাকে খোঁজ করার কারণ ছিল। তার মা নাকি মাছ ধরার জন্যে খুব পয়া। লোখা অনেকবার শুনেছে – দেখেছে। তার বাপ মাকে ডেকে বোলছে,
— লে দিখি জালটায় হাত দিয়ে দে। দু'চার খিয়েই যেন বিলবুড়ি খালোই ভরি দেয়।
মা তার খর্ খর্ করে এসে জালে হাত ছুঁই দিত। তারপর তার আর পিছন ডাকা চোলতো না কিছুতেই। লোখাও তার বাপের ধারা বজায় রেখেছে। লোখা দেখেছে,তার ছোট ব্যাটা জালে হাতে ছুঁই দিলে মাছ ভালোই পড়ে। তাই যখনই লোখা মাছ ধরতে যায়, তার ছোট ব্যাটাকে হাঁক পাড়ে। এখনো হাঁক দ্যায়,
— কুথা গেলু রে ছোট কোচা। চোলই তাত্তাড়ি।
বাপের ডাকে কানে যেকেই চোঁচা মেরে দৌড়ে আসে। কাঁধে জাল দেখেই বুঝে যায় তার করনীয় কাজ। ডান হাতের তালুটা জালে ঠক করে ঠেকিয়েই আবার দে দৌড়। লোখা খুশি খুশি মন নিয়ে হাঁটা দেয় কালসাবার বিলের দিকে।
কালিতলার কাছে লোখার সঙ্গে দেখা হয় তার সেজবৌদির। ছাগল চরিয়ে ফিরছিল সে। অন্যদিন হলে লোখা ওখানেই ঝাঁঝিয়ে উঠত,
—ছাগল চরানার কি এগবারে ঘুরমা লেগে গেছে! ব্যালা কত হইচে দেকতে পাওনি! পেটে ত পিত্তি পড়ে চড়া গ্যাছে। অ্যার উবরে জিয়ে চাটি পান্তা মুখে দিয়ে টক আমানি চোঁচি লিবে। ব্যাস্, হয়ে গেল!
আরতি কোন উত্তর করবে না। ছাগলের দড়ি টানতে থাকবে। একপাল ছাগল নাদি ছড়াতে ছড়াতে পিছু পিছু যাবে তার। ওদিকে লোখার গজগজানি তখনো ছাড়বে না। কিন্তু আজকে তার মুখ থেকে কোন কথা সরে না। রাগ যে ভিতরে হচ্ছে না তা নয়। তবে আজকে রাগের কারণ তো আলাদা। গোঁ ভরে হাঁটা দেয় মাঠের দিকে। আরতি দূর থেকেই লোখার মেজাজ বুঝতে পেরেছিল। সামনাসামনি হতেই আরতি নিবজে থেকেই দোষ স্বীকার করার স্বরে বলতে শুরু করে,
— লাউঠার ছেগল গুলানকে আর কি লিবি। যেন মরণ খাবা খেল। এসার নাম লেইনি। কত্ত ব্যডালা হয়ে গেল দেকতে দেকতে।
কথা বলার ফাঁকে বার কয়েক লোখার মুখের দিকে তাকায় আরতি। লোখা দ্রুত পায়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আরতি থমকে দাঁড়ায়। তার মনে কু ডাকে। কদিন ধরেই তার ডান চোখের পাতাটা নাচছিল। একবার পাতার একটা চুলও উপড়ে দেয়। কিন্তু তাতেও নাচা থামেনি। সেই থেকে একটা ভয় তার মনকে চেপে ধরছিল। ভয়ের কারণ তার অজানা নয়। ময়নার চালচলনেও তার সন্দেহ হচ্ছিল কদিন ধরেই। কত রাত অব্দি তার চোখে ঘুম আসছিল না। শুধু মনে হত তার ময়না কি তবে সব বুঝতে পেরে গ্যাছে! লোখাকে কি তার সন্দেহর কথা বলেছে! যদি সত্যিই জানাজানি হয় তাহলে সে কি করবে! গলায় দড়ি নয়তো বিষ খাওয়া ছাড়া তার কোন রাস্তা থাকবে না। যদি মরতেই হয় তাকে তাহলে ছ্যানাটার কি হবে! কতবার সে খুদাকে বুঝাতে চেয়েছে। শোনেনি তার কথা। প্রথম যেদিন খুদা তার কাছে এসে বলে তার মনের কথা সেই মুহুর্তে আরতি আগুন মূর্তি ধরেছিল।
🍂
আরও পড়ুন 👇
— ইসব কি কথা তুমি বলঠ! মোর কানে শুনাও যে পাপ! তুমি কি খেপে গেছ?,ভুলে গেছ আমি তোমার ভাদর বৌ হয়নি? তুমি একটা ভাসুর হোয়ে এরকম হেনেছ্যারা পস্তাব দাওঠ মোকে। তমার লোজ্জা করেনি? তাই যে তুমি মা মনসার পুজা কর? লোককে ওষুদ দাও? গনাও? ছ্যা!
সেই রাতে আরতি সারারাত কেঁদেছিল। আর মনে মনে স্বামীকে গালিগালাজ করতে থাকে। সেই কবে হঠাৎ করে জয়রাম তাকে ফেলে ঘর ছেড়ে কোথায় চলে গ্যাছে কেউ জানে না। শুধু ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরেই সব কষ্ট ভুলে থাকতে চেয়েছে সে। সেও ত একটা মেইয়ামানুষ। আর পাঁচটা মেইয়ার মতো তারও কত শখ আহ্লাদ ছিল। এখনো আছে। তবে সেই শখ আহ্লাদ মরার মতো পড়ে আছে মনের অতলে। কত আর বয়স তার। শরীর তারও আঁচড়কামড় করে। কিন্তু সেই ছটপটানিকে বুক চেপে বিছানার সাথে জোর করে মিশিয়ে দেয়। সমস্ত উত্তাপ কাঁথা বালিশের গায়ে সঞ্চারিত হয়। ভেতরটা আরতির চিৎকার করে ওঠে। সেই আর্তনাদ তীব্র স্বরে বিঁধতে চায় অদৃশ্য জয়রামকে,
—মরে গেছে না খালকে গেছে কে জানে! সাধু হইচে! জগৎ উদ্ধার কোত্তে গেছে। অত যেদি সাধু সাজার শক থাইলে কেনে মোর জীবনটাকে এভাবে শেষ কোল্লি? নিজের সাধ মিটি লিয়ে,মোকে নরকে ফেলি রেখে,বাবু কি নাই ধম্ম পথে গেছে! যে পুরুষ মানুষ তার বিয়া করা বৌকে কাঁদায় সে আবার সাধু কিসের? অমন সাধুর মুয়ে আগুন!
সেই রাতে কোনমতে খুদাকে নিবজের ঘর থেকে আরতি তাড়ায়। ভয়ে তার ছাতি ঢিপঢিপ করতে থাকে। কি ভাগ্যে ছ্যানাটা তার বাপের ঘরে আছে। তার উপরে সে যেই ঘরটায় থাকে তার দরজাটা পুকুর পাড়ের দিকে। নইলে যার হোক চোখে পড়তেই পারে। আরতি কদিন থেকেই খুদার আবভাব লক্ষ্য করছিল। প্রথম দিকটায় কোন আমল দেয়নি। খুদা পুকুর পাড়ে দুপুর বেলা তার শিকড় তোলা ছোট্ট দাউলি নিয়ে ঘুরত। আর মাঝে মাঝে আরতির ঘরের দিকে তাকাত। আরতি পুকুর ঘাটকে গেলেই ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকত। পারা-বাখুলের জা-জাউলিদের সঙ্গে আরতি ভালোই কথা বলে। বিকালে তাদের বাইরটায় অনেকেই আসে। সবাই সবার মাথায় তেল দিয়ে দ্যায়। চুল আঁচড়ে খোঁপা বেঁধে দেয়। কখনোে সখসো উকুন বাছতে বাছতে গল্প করে। হাসিঠাট্টা করে। এপড়া ওপাড়ার খবরাখবর নিয়ে টপকা-শলুক কাটে। কিন্তু এসব কথা সে তো কখনোই বলতে পারবে না। আরতি জানে মেইয়ামানুষের জীবন আলাদা। তার উপরে সে ঘরপোড়া গরু। তার কথা কেউই বিশ্বাস করবে না। উল্টে তার উপরেই দুর্নাম চাপাবে সকলে। সান জা ময়নাকে সে ভালভাবেই চেনে। বাইরে সে যতই খাতির করুক, ভিতরে গরসগরস করে সারাক্ষণ। আরতি অত খেপি হাউড়ি নয়। সে সবই বুঝতে পারে। দেওরের ভাত খাচ্ছে সে। জা কি সহজে মেনে নিতে পারবে। মুখ ফুটে বলেনি,শুধু স্বামীর অংশের ভিটা- জমি আছে। দেওরই চাষবাস করে সেইসব জমিতে। তাবাদে সেও ত দাসীবাঁদীর মতো সংসারে খাটে। কখনো দু'টাকা হাত পেতে চায়নি তাতের কাছে। মাঠঞাট থেরকে ঘুঁটা কুড়িয়ে লেথি দিয়ে বিক্রি করে সে। ছাগল পুষে। হাঁস মুরগীর চাষ করে। সেইসব থেকে যা পায় তাতেই তার চলে যায়। উপরন্ত লোখার দু'ব্যাটাকেও জামা-পোশাক কিনে দেয়। তার নিজের ছ্যানাটা বাপের ঘরে থাকলেও,ভাই-ভাজের হাতে কিছু টাকা দিয়ে আসে।
0 Comments