সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ২৬
গৌতম বাড়ই
সেই টালমাটাল সময়, সেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কথা বারবার মনে করতেই থাকে সুশোভন। তার মনে হয়, পশ্চিমবাংলায় স্বাধীনতা উত্তরকালে এরকম পরিস্থিতি যে আসেনি তা নয়, বারবার এসেছে। বারবার বিপর্যস্ত করেছে আমাদের সময়গুলোকে। আমরা স্বভাবতই আর বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারিনি। এগিয়ে গেল অন্যান্য রাজ্যগুলো। বিশেষত ভারতবর্ষের পশ্চিমের আর দক্ষিণের রাজ্যগুলো। দশক- দশক বিরতিতেই এ হেন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে, অথচ আমাদের রাজ্যের সরকারের দিকে তাকালে এক ভিন্ন দর্শন চোখে পড়ে, দীর্ঘকাল ধরে এক দলীয় বা একই রকম রাজনৈতিক ভাবাপন্ন শাসকদলের দীর্ঘকালীন শাসন, অথচ আমাদের সেইসব রাজনৈতিক দলগুলির বিরোধীদলগুলো আইন শৃঙ্খলার এক চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করে আছে সবসময়, সমস্ত উন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর আছে সংবাদ মাধ্যমগুলোর একপেশে বল্গাহীন পক্ষপাতমূলক খবর আর নিজেদের সুবিধাজনক জনমত তৈরী করা। পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির কোনও সঠিক দিশা কখনও দেখায় নি। ১৯৯০ বা তার পরবর্তী সময়ে আমরা বাঙালি হিসেবে যতটা ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার তৈরী করেছি, ঠিক ততটাই পরিমাণে এই বাংলাদেশ থেকে প্রশাসনের উপযুক্ত দক্ষ ছেলেমেয়ে তৈরী করতে পারিনি। এর ভীষণ দরকার আছে আমাদের। ক্রমান্বয়ে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। সুশোভনবাবু ভাবতে বসলে, এর থেকে নিজেকেও বিচ্ছিন্ন করতে পারেন না। সমান অপরাধে নিজেকেও দোষী মনে করেন। তার মেয়ে বসন্তসেনাও তো শেষমেশ মেধাবী হয়ে ইঞ্জিনিয়ার বা কারিগর বিদ্যাতেই শিক্ষিত হল। এই গড্ডলিকা প্রবাহে তিনি নিজেও জানেন না কী করে গা ভাসালেন?
বসন্তসেনা আজকাল বাবার আনমনা এই ভাব খেয়াল করতে থাকেন। কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন - " বাবা ইদানিং তোমার মধ্যে এক ভীষণ পরিবর্তন দেখছি, তোমার মনের ভেতরে কি হঠাৎ কোনও বদল এসেছে? কী ভাব এত সাতপাঁচ? "
সুশোভন বলে- " না রে মা, বিরাট কোনও আমূল পরিবর্তন হয়ত আমার মনের ভেতর হয়নি, তবে ভাবনা চিন্তার একটা দিকবদল তো হয় মানুষের, এবং চিন্তাশীল যে কোনও মানুষের, তা কি তুই অস্বীকার করতে পারিস মা?"
-- " না বাবা, তা আমি কখনও অস্বীকার করি না। তবে এরকম গভীর ভাবনা থেকে তোমার শরীরের ও মনের ওপর কোনও চাপ পড়ুক, তাই ভেবে ভয় হয়! আমি আর কাউকে হারাতে চাই না বাবা! "বসন্তসেনা কেঁদে ওঠে একদিন এরকম এক রাতে।
সুশোভন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে থাকেন- " হাসনুমা এত অল্পে ভেঙে পড়লি কেন? তোকে তো কোনদিন এত অল্পে ভেঙে পড়তে দেখিনি? আমি আর তোর মা তোকে মানসিক দিক দিয়ে এক বলিষ্ঠ মনের নারী শুধু না, এক বলিষ্ঠ মানসিক চরিত্রের মানুষ বলে তৈরী করেছিলাম। তুই কি মানসিক দিক দিয়ে ভেতরে ভেতরে দূর্বল হয়ে পড়লি? এই দূর্বলতা কিন্তু মানসিক ব্যাধি।"
বসন্তসেনা নিজেকে সামলে নিয়ে এবারে সোজাসুজি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বসলেন। বললে- " আবেগকে তো অস্বীকার করতে পার না বাবা? একা মানুষ অবলম্বনহীন এক কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে বেঁচে থাকেন, এবং তিনিই জয়ী হন, এ আমি জানি, কিন্তু মুশকিল হল, যে বা যিনি বড় হচ্ছেন মানসিক দৃঢ়তার সাথেই, তবুও তার বেঁচে থাকবার সব নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের প্রশান্তি , তা কিন্তু সহায় সম্বল হয়ে, যদি সে ভাবে তার অবলম্বন হারিয়ে যাচ্ছে, সে কী করবে বাবা?"
সুশোভনবাবু এবারে মেয়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। এই মুহূর্তে সেই প্রশ্নের জবাব তিনি কী দেবেন? চুপচাপ রইলেন বসে। দূরে কোথাও এই প্রায় নিস্তব্ধ রাতে হইচই হট্টগোল শোনা গেল। পাড়ার মধ্যেই , তবে কাছাকাছি কোথাও নয়। ব্যালকনিতে এসে বাবা ও মেয়ে এই রাতের অন্ধকারে দাঁড়ালেন। আর চমকে উঠলেন একটা ভয়ানক দৃশ্য দেখে। সেই দূরের হট্টগোল এখন তাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় চলে এসেছে। তারা দেখলেন, একটা সাদা রঙের চারচাকার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, গাড়ির ড্রাইভারের সিটের দিকের দরজাটা খোলা, ভেতরে হয়ত কিছু লোকজন বসেও আছেন। গাড়ির পেছনের কাঁচে যে লেখাটা নজরে পড়ছে রাতের রাস্তার আলোয়, তা একদম স্পষ্ট, ক্যাব কোম্পানির নাম। গাড়ির ভেতরে হয়ত দু- তিনজন যাত্রী বসে আছেন। এটুকুর বাইরে রাস্তায় যা প্রকাশ্যে ঘটে চলেছে, তা রীতিমতন শরীরে শিহরণ জাগানো।
সুশোভনবাবু সেই দৃশ্য দেখে , আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। চিৎকার করে উঠলেন। তারা দেখল, একটা রোগাপটকা অল্পবয়সী ছেলেকে তিন- চারজন ষণ্ডামার্কা যুবক বেধড়ক মার মারছে। গাড়ির সামনে দুটো মোটরসাইকেল দাঁড় করানো আছে। ঐ যুবকেরা দাঁড় করানো বাইকের আরোহী বলেই সুশোভনবাবু নিশ্চিত। কারণ ওদের হাতের হেলমেট দিয়েই এই অল্পবয়সী ছেলেটিকে মাথায় বারবার আঘাত করছে আর খিস্তি- খামারি করে নৃশংস ভাবে মেরে চলেছে যুবকের দল। সুশোভনের চোখের সামনেই এই ভয়ানক এক গণপিটুনিতে মৃত্যু ঘটে যাবে কারও, এ তিনি মানতে পারবেন না, তাই তিনি চিল্লিয়ে উঠলেন -- " এই থাম! হচ্ছেটা কী?" কী কারণে এইসব তার আর জানবার দরকার নেই। বসন্তসেনাকে বললেন স্থানীয় থানাকে ফোন করতে। এই বলে তিনি তার ঘরোয়া পরিধেয় পোশাকেই ফ্ল্যাটের নিচে দৌঁড়ে নামলেন জোরে চেঁচাতে চেঁচাতে।
সুশোভনবাবু যখন হিতাহিত শূন্য হয়ে নিচে নামছেন, খেয়ালও করেন নি তার আশেপাশে কোনও লোকজন বা স্থানীয় বাসিন্দা আছেন কিনা বা পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী। শুধু মনে আছে ঐ গুন্ডা প্রকৃতির যুবকেরা যখন একজন অল্প বয়সী যুবককে ধরে মারছেন বড় রাস্তার পাশে অল্প দূরে দু- একজন লোকজন নিরাপদ দূরত্ব রেখেই নির্বাক দর্শক হয়ে এইসব দেখছিলেন। কিন্তু ওই রাতে সদর রাস্তায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে তিনি দেখলেন এক বড় জটলা তার চিৎকারে ঐ গুন্ডা প্রকৃতির যুবকদের ঘিরে ফেলেছে চারদিক থেকে। যুবকেরা পালিয়ে যেতে চাইলেও আর পালাতে পারলেন না।
🍂
গাড়ির ভেতরে মহিলা যাত্রী ছিলেন আর খুব ভয়ার্ত গলায় কাঁদছিলেন এই বলে- " ড্রাইভার ছেলেটি কিছুই করেনি, এই লোকগুলো ছেলেটিকে মেরেই ফেলছিল চোখের সামনে। দেখুন কী ভয়ানক ভাবে মেরেছে!"
ঘটনা যা জানা গেল, ক্যাবের ড্রাইভারটি শুধু সিগন্যালে আটকে থাকা মোটর বাইকের কাছে একটা সাইড চেয়েছিলেন আর সিগন্যাল সবুজ হতেই ঐ চার যুবকের বাইকগুলো ওভারটেক করে এগিয়ে যআয়, তাতে কাউকে ধাক্কা বা কিছুই মারেনি, এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ঐ চার যুবক বাইক গাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে ক্যাবের ড্রাইভারকে বেধড়ক মারতে থাকে। সুশোভন এই দৃশ্য তার ব্যালকনির উপর থেকে দেখতে পেয়েছিল । তারপর জোরে চিৎকার করতে করতে নিচে নেমে আসেন। আর এই চিৎকারে স্থানীয় লোকজন না এলে রাতে এখানে বড়সড় অঘটন ঘটে যেতে পারত। তবে স্থানীয় লোকজন সবকিছু জানবার পর আবার ঐ যুবকদের গণপিটুনি দিতে উদ্যোগী হলে সুশোভন তাদের বুঝিয়ে প্রতিরোধ করে এবং আটকায়, বলে- " আপনারা এইসব গুন্ডাদের আর বদমায়েশদের মেরে ওদের সুবিধা করে দেবেন না। এদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার। পুলিশ এক্ষুনি চলে আসবে। একটু ধৈর্য ধরুন।"
পুলিশ এসে ঐ চার ষণ্ডামার্কাকে প্রিজন ভ্যানে তুলে নিয়ে গেল। সুশোভনবাবু ড্রাইভারকে সঙ্গে করে , পাড়ার আরও কিছু লোকজন নিয়ে থানায় চললেন। ওদের অর্থাৎ চার যুবকের সেই রাতের মতন থানার হাজতে থাকার ব্যবস্থা করলেন।
এইসব করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে গভীর রাত হয়ে গেল। তবে তার জন্য কোনও ক্লান্তি বা খেদ নাই। মনটা আজ ভীষণভাবে এক গভীর আনন্দে ভরে গেল। একজন নিরীহ অল্পবয়সী, বলতে গেলে গরীব ঘরের ছেলেকে বেঘোরে এক নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন বলে। এক মায়ের কোল আজ বদমাশদের খপ্পড়ে পড়ে খালি হয়নি বলে।
মেয়েকে তিনি বললেন - " বুঝলি হাসনুমা জামা- কাপড় আর চালচলন দেখলে আজকাল কিছু বোঝা যায় না। তার মাঝে কত যে দুষ্টু রাক্ষস বসে থাকে! যে সভ্যতা মানুষকে এত নৃশংসতা দেয় সেই সভ্যতাকে কী সভ্যতা বলা চলে? আমি তো তা বলি না। সেই আসল সভ্যতায় আজও আমরা পৌঁছায়নি। বিজ্ঞানের যতই অগ্রগতি হোক। মেকী আর ধিক এই সভ্যতা! আর আরও একটা জিনিস আজকাল প্রকট হয়ে উঠছে এই পশ্চিমবঙ্গে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অর্থের বিনিময়ে পুরো যুব সমাজটাকেই আজ নষ্ট করে দিতে চলেছে। এই বীজ রোপণ করে বিষবৃক্ষের জন্ম দেবে আগামীদিনে। যা আমাদের দেশের কাছে ভয়ানক রূপে দেখা যাবেই। ঐ যুবকের দল বারবার থানাকে ক্লাব আর একজন ক্ষমতাসীন দলের নেতার নাম করে ধমকাচ্ছিল। দেখলাম অল্পবয়সী পুলিশ অফিসারটির বুকের পাটা আছে! চড় থাপ্পড় মেরে হাজতে ওদের ঢুকিয়ে দিয়ে কেস ডায়েরি নিতে শুরু করে দিল।
বসন্তসেনা বলল- "আমিও তো তোমার সাথে সাথে দৌঁড়েছি বাবা। আমিও তো ওখানে গিয়ে দাঁড়াই প্রথমে। তোমার তো কোনোদিকেই চোখ ছিল না, তাই দেখতে পাওনি। তবে বাবা আজ তুমি মহান এক কাজ করেছ। আজ তোমার সন্তান বলে আমি গর্বিত!সত্যি আমারও আজ দারুণ লাগছে। "
সুশোভন বললেন-- " তবে তুই পুলিশ ডাকিস নি? তবে পুলিশে খবর দিল কে? তাহলে চারপাশে এখনও ভালো লোকের সংখ্যাটাই বেশি কী বলিস? এই কথাটি ভুলে যায় ক্ষমতাবানরা! "
ক্রমশ
0 Comments