প্রসূন কাঞ্জিলাল
প্রচলিত লোকসংগীতের পূর্ববর্তী স্তরকে আমরা আদিম সংগীত বলে ধরে নিতে পারি।মানুষ যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসে, কাঁদে, আবেগে চেঁচিয়ে ওঠে, তেমনি সভ্যতার প্রাচীন অবস্থায় আদিম মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে গান গেয়ে উঠত সেই গানই ছিল আদিম সংগীত। যে কোনো লোকসংগীত, উচ্চ মার্গের সংগীত বা মার্জিত সংগীতকলার বীজ লুকিয়েছিল সেই আদিম সংগীতের মধ্যে। তা হলে কি আদিম সংগীতের রূপ ইতিহাসের অতীতে হারিয়ে গেছে? সেই রূপ কি শুধু অনুমান ও কল্পনার ব্যাপার? তা কি আর শুনতে পাবার কোনো উপায় নেই? তা নয়। যে সব আদিবাসী বর্তমান সভ্যতার খুব একটা ধার ধারে না, অন্তত নিজেদের সংস্কৃতির রূপকে ধরে রাখতে চায়, তাদের গানের মধ্যে আদিম সংগীতের রূপ বহুল পরিমাণে, কখনো বা অকৃত্রিমভাবেই বর্তমান। সাঁওতালী গান আদিম সংগীতের নিকটতম দৃষ্টান্ত, অন্তত আমরা আমাদের কাছাকাছি যে-সব গান শুনতে পাই সেই-সব গানের মধ্যে। অসাধারণ সুরেলা এদের কণ্ঠস্বর। সমস্বরে এরা যখন গান করে তখন সকলের কণ্ঠস্বর এমনভাবে মিলে যায় যে তথাকথিত সাধা গলাও অনেক সময় সেভাবে মেলে না। এদের গানে বারোটি স্বরও নেই, ত্রিসপ্তকে গতিবিধিও নেই। তবু তা গান এবং এই গান আদিম সংগীতের ধারাকে বর্তমান কাল পর্যন্ত যথাসম্ভব সার্থকভাবে বহন করে এনেছে।গারো, খাসি, নাগা এবং বিভিন্ন উপজাতি ও আদিবাসীদের গান, বাজনাও অনুরূপ দৃষ্টান্ত, যেগুলির মধ্যে আদিম সংগীতের স্বরূপকে চিনে নেওয়া যায়। ভারতের সমস্ত অঞ্চলে এইরকম বিভিন্ন লোকের বাস। তাদের আপন আপন গান বহন করছে আদিম সংগীতের ধারাকে। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের গান, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের হুলা গান ও নাচ, আর্জেন্টিনার টাঙ্গো — পৃথিবীর নানা দেশে নানা ধরনের লোকসংগীতের মধ্যে ছড়িয়ে আছে আদিম সংগীতের অল্পবিস্তর পরিচয়। এ কথাও বলতে হবে যে দেশ বিদেশের আদিম সংগীতের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে আছে নৃত্য। স্বতঃস্ফূর্ত স্বরোৎপাদন যেমন জন্ম দিয়েছে আদিম সংগীতের, তেমনি স্বতঃস্ফূর্ত উল্লম্ফন, অঙ্গসঞ্চালন, চোখ মুখের অভিব্যক্তি ও পদক্ষেপের দ্বারা ছন্দোৎপাদন জন্ম দিয়েছে আদিম নৃত্যকলার।
নৃত্য-গীত-বাদ্য এই তিনটি স্বতন্ত্র কলা ছিল না, ছিল একই কলা। সংগীতের সংজ্ঞার মধ্যেই এই তাৎপর্য নিহিত। সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের (Cultural Anthropology) গবেষকরা বলেন সংগীত খুবই ভ্রমণশীল অর্থাৎ এক জায়গার সংগীত অন্য জায়গায় সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।
উচ্চাঙ্গ সংগীত সম্বন্ধে এ কথা নিঃসন্দেহে প্রযোজ্য না হলেও আদিম সংগীত সম্বন্ধে এ কথা অনেকাংশে প্রযোজ্য। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল আদিম নৃত্য-গীত-বাদ্যে সমৃদ্ধ। আমেরিকা মহাদেশে আফ্রিকার আদিবাসীদের সংগীত ব্ল্যাক মিউজিক নামে পরিচিত। আমেরিকার গায়ক বাদকেরা এই সংগীতের উপকরণকে খুবই কাজে লাগিয়েছে। ব্লু, জাজ প্রভৃতি শৈলীর নৃত্য-গীত-বাদ্য তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন। জিপসিদের নাচ গানের মধ্যে অলক্ষ্যে লুকিয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাচ গানের প্রভাবের চমক। জিপসিদের সুরের মূল হিন্দুস্থানী সংগীত বলেই অনেকের বিশ্বাস। নজরুল আরব দেশের এক বিশিষ্ট সুরকে জিপসিদের গানের চালে বা স্টাইলে ফেলে রচনা করেছেন “রুম্ ঝুম্ ঝুম্ ঝুম, রুম্ ঝুম্ ঝুম, খেজুর পাতার নূপুর বাজায় গানগুলি।অন্যদিকে “দূর দ্বীপবাসিনী, তোমারে চিনি গো চিনি” গানটির মধ্যে রয়েছে দূর প্রাচ্যের দ্বীপের সুরের টান ও ছন্দভঙ্গিমা। আহ্বানের সুর তার সপ্তকে যায় ও ঘৃতস্বরের মতো তাতে টান থাকে। এই নীতি আদিম সংগীত থেকেই চলে আসছে।
আদিম সংগীতের ও কিছু প্রচলিত লোকসংগীতেরও বেশ কিছু শাখা শ্রমের সঙ্গে তথা কর্মের সঙ্গে যুক্ত।পাল্কিবাহকদের গান, ছাদপেটানোর গান, নৌকা বাইচের গান, ঢেঁকিতে ধান ভাঙা ও চিরে কোটার গান প্রভৃতি হচ্ছে শ্রমসংগীত বা কর্মসংগীত। আদিম সংগীতের উপাদান এগুলির মধ্যে যথেষ্ট আছে। সংগীতের সঙ্গে যৌথভাবে কর্ম করলে শ্রমের লাঘব হয়, শুধু তা নয়; সুর ও তালের নিয়মিত গতিতে কর্ম সুষ্ঠুভাবে সাধিত হয়। পালকির সামনে যে বাহকরা থাকে তারাই শুধু পথ দেখতে পায়। গানের সুরে তালে তারা বলতে থাকে কোথায় চলার পথে কাঁটা গাছ আছে, কোথায় গর্ত আছে, কোথায় কোন দিকে বাঁক নিতে হবে, কখন তারা কাঁধ বদলাবে ইত্যাদি। পিছনের বাহকরা সামনে দেখতে পায় না। তাদের মুখের সামনেই পালকি। তারা সামনের বাহকদের নির্দেশ শুনতে থাকে ও “হুম্ হুম্ না” ধ্বনি করে সাড়া দিতে থাকে সোজা সমান পথে, যেখানে নির্দেশ দেবার কিছু থাকে না, সেখানে সামনের ও পিছনের বাহকেরা সুরে তালে হাস্য পরিহাসও করতে থাকে। ঢেঁকিশালের কর্মে ছন্দ একান্ত প্রয়োজন। কেন না, যে সময় ঢেঁকিতে পা পড়ছে তখনই সামনের দিকটি ওপরে উঠছে, যে মুহূর্তটিতে গর্তে হাত দিয়ে ধান উল্টেপাল্টে দেবার অথবা চাল বা চিরে একটু একটু করে তুলে নেবার উপযুক্ত অবসর। একটু দেরি হলেই পা তুলে নেওয়া হবে ও গর্তে ঢেঁকির মুষলটি সজোরে পড়বে। ছন্দপতন হলেই হাতে লাগবে মারাত্মক আঘাত। গানের তালে তালে কাজ করলে কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। “মেঘ গুর্ গুর্ মেঘ গুর্ গুর্ ঢেঁকিতে পা পড়ে”, “চিরা কুটি চিরা কুটি” প্রভৃতি গান রচনার পিছনে রয়েছে ঢেঁকিশালের কাজের সুর ও ছন্দ। সমছন্দে দাঁড় বাওয়ার তাগিদ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে নৌকা বাইচের গান বা সারি গান। “খর বায়ু বয় বেগে” গানটির “হাই মারো মারো টান হাঁইয়ো হাঁইয়ো হাইয়ো” অংশে রয়েছে এমন এক আদিম সংগীতের উপকরণ যা খুব সার্থকভাবে প্রযুক্ত হয়েছে জলযাত্রার পটভূমিকায় “তাসের দেশ” নাটকের প্রারম্ভে। লক্ষণীয়, রবীন্দ্রসংগীতের মতো বিদগ্ধ সংগীতেও আদিম সংগীতের উপাদান রয়ে গেছে।
আদিম মানুষের যুগ থেকেই সংস্কারাচ্ছন্ন লোকসমাজে মন্ত্র তন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, তুকতাক ইত্যাদির চল রয়েছে। অনেক সময় সেগুলির অঙ্গ ছিল গান, তা সে যতই অমার্জিত অবস্থায় হোক। সেই ধরনের গানেরই ছায়া রয়েছে নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকায় প্রকৃতির মায়েরও তার দলবলের ভূমিকার মধ্যে। “টান দে, টান দে, টান দে”, “পাক দে, পাক দে, পাক দে” প্রভৃতি অংশ আদিম সংগীতের অনুষঙ্গকেই বহন করে আনছে। তেহাই দেবার রীতি ভারতীয় লোকসংস্কৃতির অন্তর্গত আদিম সংগীতের দান।
🍂
আরও পড়ুন 👇
এই রীতি শুধু লোকনৃত্য-গীত-বাদ্যে নয়, আমাদের শাস্ত্রীয় নৃত্য-গীত-বাদ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। আমাদের হিন্দুস্থানী সংগীতের আসরে সুরতালের আবেগে অঙ্গসঞ্চাচন, বিভিন্ন মুদ্রাদোষ, সমে মাথা ঝাঁকানি দেওয়া বা চেঁচিয়ে ওঠা আদিম মানুষের ধারাধরনকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
লাঠি বা বল্লম নিয়ে নাচগান আদিম মানুষের সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল। আচার্য গুরুসদয় দত্ত সেই ব্যাপারকেই তুলে ধরেছেন রাইবিশে বা রাইবেশে নাচগানের মধ্যে। শুধু উগ্র ব্যাপারগুলি নয়, মানব হৃদয়ের কোমল ও করুণ বৃত্তিগুলিও সংগীতের সঙ্গে জড়িত সেই আদিকাল থেকে। ডারউইনকে বলতে শুনি:
"The habit of uttering musical sound was first developed, as ...I have a means of courtship, in the early progenitors of man, been lead to infer that the progenitors of man probably uttered musical tones, before they had acquired the power of articulate speech; and that consequently, when the voice is under any strong emotion, it tends to assume, through the principle of association,a musical character." (Charles Darwin, The Expression of the Emotions in Man and Animals, Watt & Co., London, 1934. pp.35-36). ডারউইনের The Descent of Man গ্রন্থেও একই বক্তব্য মিলবে।
(1930, pp.96-97).
শিশুকে আদর করে করে ঘুম পাড়াতে গিয়ে মায়েরা রচনা করেছে, ঘুমপাড়ানি গান।মৃতজনের শোকে মেয়েরা সুর করে কেঁদেছে। এগুলিও আদিম সংগীতেরই নিদর্শন। পুরো মাত্রায় সংগীত এগুলি না হতে পারে; কিন্তু সংগীতের প্রাথমিক উপাদান এগুলির মধ্যে বর্তমান থাকা স্বাভাবিক ।
"The starting point for all arts, poetry, painting or music is the breath, the rhythm, which is inherent in the human body and which is the same everywhere, and is therefore universal. I believe musicians must often be inspired by the rhythm of the circulation of blood or breath. A very interesting study would be a comparison of four tunes of different countries. With more developed music things become more complex, and the underlying similarities cannot be systemetically traced.” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সংগীতচিন্তা, বিশ্বভারতী, ১৩৯২,পু:৪১) তুলনামূলক সংগীততত্ত্বের (Comparative Musicology) গবেষণার প্রস্তাব আমরা কবির কাছ থেকেই পাচ্ছি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যৌথভাবে এই কাজ করার যথেষ্ট হার্বাট স্পেন্সারের "The Origin and function of Music" প্রবন্ধটিও এই প্রসঙ্গে খুব মূল্যবান। এক জায়গায় তিনি বলছেন:
"Every one of the atterations of vioce which we have found to be physiological result of pain or pleasure, is carried to its greatest extreme in vocal mucic."
(Herbert Spencer, Essays Scientific, Political and Speculative, Williams and Norgate, London, 1868, p.221) বলা বাহুলা, সকলেরই জানা, রবীন্দ্রনাথ কুড়ি বছর বয়সেই প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলেন ও অনুরূপ একটি প্রবন্ধ 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। (“সংগীতের উৎপত্তি ও উপযোগিতা”, স.চি., পৃ: ২৭৪-২৮২)। “সংগীতচিন্তায় স্পেসার ও রবীন্দ্রনাথ” প্রবন্ধে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি (সুরদমা পত্রিকা, সমাবর্তন ও রবীন্দ্র জন্মোৎসব সংখ্যা, ১৩৯৩, প:৮-১৪)।
2 Comments
ধন্যবাদ
ReplyDeleteউপসংহারে বলা যায়, আদিম সংগীত বা primitive music-এর উপাদান হারিয়ে যাবার নয়। উচ্চাঙ্গ সংগীতের নাড়ীর স্পন্দনে ও স্নায়ুমণ্ডলীর সংবেদনে তা বর্তমান যে সংগীত সাধনার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তা মূলতঃ আদিম সংগীতের ই দান। সেখান থেকে আগত বিভিন্ন ধারাই এক একটি রাগ রাগিনী যা আদি অনন্ত কাল ধরে নদীর মত প্রবাহিত হচ্ছে যুগ থেকে যুগান্তরে। আমাদের সংস্কৃতি শুদ্ধ হচ্ছে আর তৃপ্ত হচ্ছে, তার ই জলে আবগহন করে।
ReplyDeleteতথ্যসূত্র ---
১) সুরদমা পত্রিকা, সমাবর্তন ও রবীন্দ্র
জন্মোৎসব সংখ্যা, ১৩৯৩,
২)সংগীতের উৎপত্তি
ও উপযোগিতা
৩) Herbert Spencer, Essays Scientific, Political and Speculative,
Williams and Norgate, London, 1868,
৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সংগীতচিন্তা, বিশ্বভারতী, ১৩৯২,