জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক বিমানবিহারী মজুমদার/ নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক বিমানবিহারী মজুমদার 
      
নির্মল বর্মন

ভাগবতরত্ন বিমানবিহারী মজুমদার  ১৯০০ সালের ৭ই জানুয়ারি কুমারখালী, নদীয়াতে জন্মগ্ৰহন করেন। পিতা শ্রীশচন্দ্র মজুমদার। পড়াশোনা নবদ্বীপ হিন্দু স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ, কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ইতিহাসে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বি.এ পাশ। ১৯২৩ এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  এম.এ (ইতিহাস) ক্লাসে ১ম  শ্রেনী তে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। পরে অর্থনীতি তে এম.এ পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম  পিএইচ.ডি থিসিস বাংলায় লিখে ডিগ্ৰী লাভ করেন। গবেষণা'র বিষয়:-"চৈতন্য চরিত্রে উপাদান"। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ইতিহাস ও অর্থনীতিতে বিদগ্ধ পন্ডিত এবং ঞ্জানার্জন করলেও  বৈষ্ণবশাস্ত্রে   পারদর্শিতার পরিচয় মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর সুনাম অর্জন করতে পেরেছিলেন । সাহিত্যিক শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের পুত্র ভাগবতরত্ন বিমানবিহারী যেমন একাধিক ভাষায় কালজয়ী ব্যুৎপন্ন ছিলেন । তেমনি বিভিন্ন বিষয়ে যেমন,  রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস ও  ধর্মের আলোচনায় পাণ্ডিত্যের স্বরূপকে উপস্থাপিত করে বাংল'র সারস্বত সমাজকে উজ্জীবিত করেছিলেন। পাটনার বি.এন কলেজে ইতিহাস ও অর্থনীতি র অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ৬৯ বছর বয়সে ১৮ই নভেম্বর ১৯৬৯ এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
🍂
প্রাবন্ধিক ও  গবেষক বিমান বিহারী মজুমদার বৈষ্ণব সাহিত্যের উপর মূল্যবান গ্ৰন্থ রচনার জন্য বৈষ্ণব সমাজের শীর্ষস্থানীয় শ্রদ্ধামিশ্রিত "ভাগবতরত্ন" উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালে বিহারের আরার হরপ্রসাদ দাস জৈন কলেজের অধ্যক্ষ পদে স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৫২সালে বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক হন। অবসর গ্রহণের পর আজীবন পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি গবেষক অধ্যাপক ছিলেন।
প্রাবন্ধিক ড.বিমানবিহারী মজুমদার রচিত গবেষণাধর্মী গ্রন্থগুলি :-
 ‌ " History of political thought: From Rammohun to Dayananda: 1821-84" , গ্রন্থ রচনার জন্য "প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ" বৃত্তি পান। 
"শ্রীচৈতন্য চরিতের উপাদান" (১৯৩৯), "ষোড়শ শতাব্দীর পদাবলী সাহিত্য" (১৯৬১), " ঞ্জানদাস ও তাঁহার পদাবলী", ১৯৬১, "রবীন্দ্রসাহিত্যে পদাবলীর স্থান"(১৯৬১) ," গোবিন্দদাসের পদাবলী ও তাঁহার মুখ",১৯৬১,"ভারতের শাসন পদ্ধতি"-১৯৬৩, " রাষ্ট্রবিজ্ঞান"প্রভৃতি। বিমান বিহারী র সঙ্কলিত গ্রন্থগুলি:-  "চণ্ডীদাসের পদাবলী",  "পাঁচশত বৎসরের পদাবলী", "শ্রীশ্রীক্ষণদাগীতচিন্তামণি" ইত্যাদি।
প্রাবন্ধিক ও ভাগবতরত্ন  অধ্যাপক ড.বিমানবিহারী মজুমদারের "শ্রীচৈতন্য চরিতের উপাদান" আকরগ্ৰন্থ বাংলা সাহিত্যের পথপ্রদর্শক। তত্ত্ব ও তথ্যে ভরপুর ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে তুলনামূলক সমালোচনায় সমৃদ্ধ  গ্রন্থটির উৎকর্ষ  বাড়িয়ে দিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ ,                   'চৈতন্য জীবনের মূল মূল্যায়ন ও ঘটনার কাল- নির্ণয়', 'সমসাময়িক পদকর্তাদের দৃষ্টি ও ভাবনায় শ্রীচৈতন্য', 'বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক রচনা তে শ্রীচৈতন্য', 'বৃন্দাবনের পাঁচ গোস্বামী ও শ্রীচৈতন্যপ্রভু', । বিমান বিহারী'র রচিত বিভিন্ন 'চরিত গ্রন্থে চৈতন্যের স্বরূপ ও বিন্যাস' , 'সহজিয়াদের দৃষ্টিতে চৈতন্যচরিত', 'ওড়িয়া ভক্তবৃন্দের কাছে চৈতন্য', 'অসমিয়া ভাষায়  চৈতন্য ও তাঁর পরিকরদের ইতিকথা' ইত্যাদি এই গ্রন্থে সবিস্তারে স্থানলাভ করেছে। সম্মাননীয় সাথী ও অধ্যাপক ড.বিমানবিহারী এই গ্রন্থের ভূমিকায় গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করেছেন:--
"বাঙ্গালা দেশে বৃটিশ-অধিকার স্থাপিত হওয়ার পূর্বে সংস্কৃত, বাঙ্গালা, উড়িয়া, হিন্দী ও অসমীয়া ভাষায় শ্রীচৈতন্য ও তাঁহার সমসাময়িক পরিকরগণ সম্বন্ধে যাহা কিছু লিখিত হইয়াছে, তাহাদের তুলনামূলক ঐতিহাসিক বিচার করাই এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য।" 
 বিমান বিহারী'র শ্রীচৈতন্য জীবনীর সমালোচনামূলক বহুগ্রন্থের  মধ্যে এই গ্রন্থ ইতিহাসবোধ ও তথ্যনিষ্ঠার নিরিখে সর্বশ্রেষ্ঠ  |
বিমান বিহারী বাবুর  "ষোড়শ শতাব্দীর পদাবলী সাহিত্য" গ্রন্থটি পদাবলী সাহিত্যের রসাস্বাদনে সহায়ক আকর বিশিষ্ট । বস্তুতঃ তিনটি প্রধান ভাগে এই গ্রন্থটির সুবিন্যস্ত মূল্যায়ন:- 'ঐতিহাসিক পটভূমি', 'ঐতিহাসিক পটভূমির বিবরণ' এবং 'বিভিন্ন পর্যায়ের পদসংকলন ও তার যথোচিত ব্যাখ্যা'। ফলতঃ ষোড়শ শতাব্দীর  পদাবলী সাহিত্যে সুবর্ণযুগ হিসেবে স্বীকৃতি‌। সুতরাং প্রাবন্ধিক সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গ্রন্থটির সুচিন্তিত মূল্যায়ন করেছেন। পাঠকদের কাছেও বিরাট বিশ্লেষণী ক্ষমতা।
বিমান বিহারী মজুমদারের "পাঁচশত বৎসরের পদাবলী" গ্রন্থটিও পাঁচ 'শ বৎসরের পদাবলী সংকলিত করে প্রতি শতাব্দীর দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করে বাংলার সারস্বত সমাজ কে উপহার দিয়েছেন। 
প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক বিমান বিহারী মজুমদারের "রবীন্দ্র সাহিত্যে পদাবলীর স্থান" গ্রন্থটি যুগপৎ কালজয়ী পদাবলী সাহিত্য ও রবীন্দ্র সাহিত্যের তুলনামূলক সমালোচনা এবং রাবীন্দ্রিক ভাবনায় পদাবলীর জটিল মূল্যায়ন কেমন ছিল তার তুলনামূলক আলোচনা।
ড.বিমানবিহারী মজুমদারের  সূক্ষ্ম রসবোধ, ইতিহাসনিষ্ঠা অনুসন্ধানলব্ধ অভিজ্ঞতাকে তথ্য ও তত্ত্বের যুক্তিতর্কে সজ্জিত করে যত্নসহকারে পরিবেশনের নিরিখেই ভারতের জনপ্রিয় তাঁর গ্রন্থগুলি। যথেষ্ট মর্যাদা লাভ করলেও প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক হিসাবে বিমান বিহারী এই কৃতিত্ব  চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলেও বর্তমান প্রজন্ম চিত্রের মানচিত্রে বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক তকমা লাগিয়ে দিতে আর বেশী সময় নেই।

আরও পড়ুন 
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments