সালেহা খাতুন
প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজ জীবনের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে সে বাঁধনের ইতিবৃত্তের ইতি কোনোদিনই ঘটবে না। চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে যাচ্ছি তাকে ঘিরে। অনার্স পার্ট ওয়ান শেষ করে পৌঁছলাম পার্ট টুতে। পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট বেরিয়েছিল ১৯৯৩ এর বারো অক্টোবর। টেনশন মুক্ত থাকার জন্য পুরো কলেজ চষে বেড়িয়েছি। বিকেল পাঁচটা পনেরোয় কলেজে রেজাল্ট এলো।
চৈতালী,বন্দনা,তনুজা,অমিতা, শ্রাবণী রায়, শ্রাবণী ঢ্যাং আরো সব বন্ধুদের চিন্তার অবসান হলো। বন্ধুরা সবাই আমরা উত্তীর্ণ হয়েছি, এর থেকে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে। ভালো রেজাল্টের জন্য বন্ধুরা আমায় অনেক কিছু উপহার দিয়েছিল। ছোটোকাকা দিয়েছিলেন একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। শ্রাবণীর বাবা শম্ভুকাকু সবার আগে মিষ্টি খাইয়েছিলেন। শ্রাবণী রায় আমার গ্রাম সাহাপুরেই থাকতো। সর্বাণীও তাই। ওদের সঙ্গে প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজের গার্লস কমনরুমে সুন্দর একটা সময় কাটতো। বিশেষ করে নানান ধরনের টিফিন খাওয়া এবং বানানো শেখা চলতো পুরোদমে। শ্রাবণী ঢ্যাংয়ের সঙ্গেও গভীর বন্ধুত্ব ছিল। গল্পের ফোয়ারা চলতো। শ্রাবণী ঢ্যাংয়ের জুজারসাহার বাড়িতেও একবার গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু রুমা ব্যানার্জির বাবা জুজারসাহার পি এন মান্না হাইস্কুলে পড়াতেন। ওঁরা স্কুলের কোয়ার্টারে থাকতেন। সেখানে আমরা রুমার দিদির বিয়েতে গিয়েছিলাম। রুমা অবশ্য বিতানের সঙ্গে অনার্সে হাওড়া বিজয়কৃষ্ণ গার্লস কলেজে পড়তো।
পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট দেখে প্রিয় মানুষরা অনেকেই অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিজনবাবু স্বপ্ন দেখালেন। ভালো করে পার্ট টু দিতে বললেন। ভালো ফল হলে এম. এ. করতে বললেন। বললেন ‘দক্ষ স্যারের আন্ডারে করো পি এইচ ডি । তারপর হয়ে যাও কলেজের লেকচারার’। বিশাল স্বপ্ন দেখালেন তিনি। বিজনবাবু দেখা হলেই বলেন চেষ্টা করে দেখো না ফার্স্ট ক্লাসটা হয় কিনা। স্যার, চেষ্টা করেও এক পার্সেন্ট যে কম হয়ে গেল এম. এ. তে। আর একজন যাঁর সযত্ন তালিমে এখনকার আমি হয়ে ওঠা, অধ্যাপক শ্যামল কুমার সেনগুপ্ত তিরানব্বইয়ের উনতিরিশ ডিসেম্বর প্রথম আমাদের বাড়ি এলেন বিশাখাকে সঙ্গে নিয়ে। তিতাসেরও আসার কথা ছিল কিন্তু ও এলো না। তিতাস প্রেসিডেন্সিতে পড়তো। পার্ট ওয়ানে আমার রিভিউয়ের ফর্ম তিতাসই জমা দিয়েছিল। আমি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চিনতাম না। তিতাস অবশ্য এম.এ. তে জে. এন. ইউ. চলে যায়। স্যারের সঙ্গে তিতাসের সাঁতরাগাছির বাড়িতেও গিয়েছিলাম।
চুরানব্বই শুরু হয়ে গেল। তিন ভাইবোনে গেলাম মামার বাড়ি। দাদু দিদার কাছে। কিন্তু তাঁরা বৃদ্ধ হয়েছেন। মামাদের তত্ত্বাবধানে আছেন। মেজোমামা শ্বশুর বাড়ি গেছেন। ফলে ছোটোমামার কাছে উঠলাম।তিনিও পরের দিন আমাদের নিয়ে রাইদীঘিতে ভায়রা ভায়ের বাড়ি গেলেন। ওখান থেকে গাদিয়াড়া খুব কাছে। মামার কাছে বায়না করলাম গাদিয়াড়া নিয়ে চলো। আবদার পূর্ণ হলো না। মামিমা বললেন ঐ দিন রাইদীঘিতে থেকে যাবেন। আমরা তো ব্যাগপত্তর সবকিছু দাদু দিদার কাছে রেখে এসেছি। ফিরতেই হবে। তিন ভাইবোনে বেরিয়ে পড়ে বাস ধরে বাগনানের আন্টিলায় আসবো। বাসে ওঠার সময় খেয়াল হলো আমাদের কাছে কোনো টাকাপয়সা নেই। কী হবে? যখের ধনের মতো আমার নীল ডায়েরিটা তখন আমার সঙ্গে ছিল। ঐ ডায়েরির পেছনের পাতা থেকে একটা পঞ্চাশ টাকা পেলাম। বলা ভালো ঈশ্বর মিলিয়ে দিলেন। দাদুর বাড়ি গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আবার ফিরে এলাম বাসস্ট্যান্ডে। বাগনান স্টেশনে যাওয়ার বাস ধরবার জন্য আন্টিলায় দাঁড়িয়ে দেখলাম মামা মামিমা ফিরে আসছেন। আমাদের দেখতে পান নি। বছরের শুরুর দুটো দিন অনেক শিক্ষা দিল আমাদের।
🍂
আরও পড়ুন 👇
কী এক বিরক্তিকর অনুভূতি। ভালো লাগছে না কিছুই। কিন্তু সামনে বিরাট প্রতিশ্রুতি। তবুও কেন যে এতো দুর্বল হয়ে যাচ্ছি!! পড়াশোনা কিছুদিন ভালো চলে আবার সব গুলিয়ে যায়। কী যে করি বুঝে উঠতে পারছি না। এভাবে এগোলে কোথায় পৌঁছবো জানি না। গলা বুজে আসে মাঝে মাঝেই। ভাষা যায় হারিয়ে। বাইরে ভীষণ দিলখোলা ভাব দেখালেও, মনটা নানান চিন্তায় জর্জরিত হয়ে যায়। পরাজয়ের গ্লানি বিঁধতে থাকে। কোথায় যেন হেরে যাচ্ছি। মধ্যবিত্তের দ্বিধা সংশয় সবকিছুই যে আমাকে ঘিরে ঘটে এ নিত্যদিন দেখতে পাই। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজের মূল্যায়ন করি। কিন্তু সে ভাষা কোথায়? মনে হয় সবাইকে ছাড়িয়ে বিরাট হয়ে উঠি। কিন্তু সে শক্তি কোথায়? চুরানব্বইয়ের বারো ফেব্রুয়ারি ডায়েরিতে লিখে প্রতিজ্ঞা করে ছিলাম বড়ো আমায় হতেই হবে।
মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তাম। গলায় অসহ্য কষ্ট ভোগ করতাম। শারীরিক দুর্ভোগে পড়াশোনা ব্যাহত হতো। ঘরে বাইরে খুব একটা আনন্দের পরিবেশ থাকতো না। কিন্তু ঐ যে প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজ, আনন্দের পাঠশালা সেখানে গেলেই পরিবেশ যেত বদলে। বাইশ ফেব্রুয়ারি বনশ্রী সেনগুপ্ত এলেন কলেজের সোশ্যাল ফাংশানে। গান তো তখন খুব শুনতাম। খোকাদাদা একটা টেপ রেকর্ডার ও বেশ কিছু ক্যাসেট দিয়েছিলেন। তাঁর বন্ধু নজরুলদার দোকান থেকেও অনেক ক্যাসেট সংগ্রহ করেছিলাম। বনশ্রী সেনগুপ্তের গান ভালো লাগতো। ছাত্র সংসদের দাদারা তাঁর সঙ্গে আলাপের ব্যবস্থা করে দিলেন। জীবনে আমি একবারই অটোগ্রাফ নিয়েছি। সেটা বনশ্রী সেনগুপ্তের।
ক্ষণিকের অতিথি এক সন্ধ্যায় এসে মন জাগিয়ে দিয়ে বৃন্দাবন ছেড়ে সেই যে মথুরায় গেল আর কোনোদিন তাকে ফিরে পাবো না তখন কে জানতো তা। এপ্রিল এসে গেল। কালবৈশাখীর সঙ্গে শুরু হলো নতুন বছর। সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেল। ভাইবোনের সঙ্গে রেডিও কাড়াকাড়ি করে ভাঙলুম তার হাতল। একুশে এপ্রিল থেকে শুরু হলো পার্ট টু পরীক্ষা। তিরিশে এপ্রিল পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু একদিন পিছিয়ে গেল। শেষ পরীক্ষাটা হলো মে মাসের দু তারিখে। একেই বলে কপাল!! আমার পরীক্ষার জন্য হালিম দাদার(জ্যেঠতুতো দাদা) বিয়ে পিছিয়ে পয়লা মে করা হয়েছিল। বিধি বাম। সবাই যখন আনন্দ করছে আমি তখন দরজায় খিল লাগিয়ে পড়াশোনা করছি। অবশ্য নিজের বিয়েও সেট নেট পরীক্ষার মাঝে পড়ায় বিয়ে ব্যাপারটাই বোধোগম্য হয় নি।
(ক্রমশ)
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী
0 Comments