জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানী-ভার্যা লেডি অবলা বসু /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৯১ 
বিজ্ঞানী-ভার্যা লেডি অবলা বসু

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

সময়টা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। গোটা ভারতবর্ষ তথা অবিভক্ত বাংলাদেশে তখন ব্রিটিশ শাসন অব্যাহত। তৎকালীন পূর্ব বাংলার (অধুনা বাংলাদেশ) বরিশালে ভূমিষ্ঠ হলেন একজন মহিয়সী নারী। লেডি অবলা বসু। এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে তাঁর জন্ম ৮ই আগস্ট ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন বিখ্যাত 'দাস' পরিবারের সদস্য। ঢাকা শহরের তেলিরবাগের বিখ্যাত 'দাস পরিবার' তাঁদের বংশধর। তাঁর বাবা দূর্গামোহন দাস ছিলেন একজন খ্যাতনামা মুক্ত মনের মানুষ। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা। ব্রাহ্মসমাজে তাঁর দারুণ প্রভাব প্রতিপত্তি। তাঁর মা ছিলেন ব্রাহ্মময়ী দেবী।
     
খুব ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন অবলা দেবী। বিশেষতঃ বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর ইন্টারেস্ট ও ট্যালেন্ট ছিল দেখার মতো। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বেথুন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেন তিনি। সেই সঙ্গে মিলে গেল উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য বেঙ্গল গভর্নমেন্টের স্কলারশিপ। তাঁর তীব্র ইচ্ছা ডাক্তারী পড়া। এমবিবিএস ডিগ্রি। উদারচেতা মা-বাবা রাজি। কিন্তু বিধি বাম! তাঁর ভাগ্য সঙ্গ দিল না। ঊনবিংশ শতকের আশির দশকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তাঁকে ভর্তি নিতে অপারগ। ভর্তির আবেদনে তাঁর মুখের উপর 'না' বলে দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। বিষয়টা কী? এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ? কারণ, তিনি একজন নারী। ইতিহাসের সবচাইতে ট্র্যাজিক ছিল তাঁর নারী হয়ে জন্মানো। তাই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এর পূর্বে কোনো মহিলা স্টুডেন্টকে ভর্তি কিংবা ক্লাস করার অনুমতি দেয়নি কর্তৃপক্ষ।

এবার তাহলে উপায় কী? তিনি পাড়ি দিলেন ভিনরাজ্যে। গন্তব্য দক্ষিণ ভারত। মাদ্রাজ (অধুনা, চেন্নাই) মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন ডাক্তারী পড়তে। সেটা ১৮৮২ সালের ঘটনা। ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েও একফোঁটা স্বস্থি নেই। নতুন আবহাওয়ায় মহাফাঁপরে পড়লেন অবলা দেবী। মাদ্রাজে পাড়ি দিতে না দিতেই তাঁর শরীরটি গেল খারাপ হয়ে। দিনকে দিন শরীর স্বাস্থ্য ক্রমশ ভাঙতে থাকে। মাঝে মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন। উদ্বিগ্ন মা-বাবা। শত কষ্ট সহ্য করে অসুস্থ অবস্থায় ফাইনাল পরীক্ষা সম্পূর্ণ করলেন। কিন্তু ডাক্তারির ইন্টার্নশিপ প্র্যাকটিস মূলতবী রেখে ফিরে এলেন স্বদেশ। স্বভাবতই অসম্পূর্ণ রয়ে গেল তাঁর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন।
      
বাড়ি ফিরে বসে বসে পাঁচ বছর কেটে গেল তাঁর। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ। দেখতে দেখতে তাঁর বয়স একুশ পেরিয়ে বাইশ। ঊনবিংশ শতকে অবিবাহিত মেয়েদের বয়স কুড়ি পেরোলে সমাজে নানান কটু কথা রটে। যেখানে বাল্যবিবাহ সমাজের রীতি এবং আকছার ঘটছে, সেখানে কৈশোর পেরোনো মেয়ের জীবনসঙ্গী খোঁজ করা মা-বাবার পক্ষে এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। রটনা আছে, (শুধুমাত্র মেয়েদের বেলায়) কুড়ি পেরোলেই বুড়ি! বয়স কুড়ি পেরোনো মেয়েদের দিকে আঙুল তুলে রে রে করে তেড়ে যেতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করে না সমাজ। নারীর চরিত্র কলঙ্কিত করে অনায়াসে। কিন্তু অবলা দেবীর মা-বাবা সেসব বেশি পাত্তা দেননি। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেবছর বিয়ে হয়ে গেল অবলা দেবীর। পাত্র একজন প্রথিতযশা বৈজ্ঞানিক এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ (প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়)-এর তরুণ অধ্যাপক। স্যার জগদীশচন্দ্র বসু। বিশ্বজোড়া তাঁর নামডাক। খ্যাতি। রেডিও সায়েন্সের জনক। বৈজ্ঞানিকের গবেষণার বিশাল ব্যাপ্তি। ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে তিনি প্রথম প্রমাণ করেছিলেন – গাছ অবলা জীব হলেও তার প্রাণ আছে। উত্তেজনায় সে সাড়া দেয়। আঘাত করলে কাঁদে। এছাড়াও ধাতুর ক্লান্তি (মেটাল ফ্যাটিগ), মাইক্রোতরঙ্গ, কৃত্রিম রেটিনা, উদ্ভিদ জগতের বৈদ্যুতিক সাড়া, অর্ধপরিবাহী ডায়োড, ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফ প্রভৃতি ক্ষেত্রে নবদিগন্ত উন্মোচন করে দুর্লভ প্রতিভার পরিচয় জ্ঞাপন করেছেন তিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবে সীমিত পরিসরে বিভিন্ন ফিল্ডে তাঁর গবেষণা বিশ্বজুড়ে খ্যাতিমান করে তোলে তাঁকে। সেজন্য প্রায়শই তাঁকে দেশের বাইরে পাড়ি দিতে হয়। বৈজ্ঞানিক স্বামীর পিছু পিছু অবলা দেবীও দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। বৈজ্ঞানিক কাজকর্মে স্বামীকে সহায়তা করেন। দেশ-বিদেশ ভ্রমনে তিনি চাক্ষুষ করলেন বিশ্বের হরেক রকম সমাজে মেয়েরা কীভাবে বাস করে। প্রেক্ষিত আর প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও নারীদের সংগ্রামের কঠিন ইতিহাস নারী জাতিকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ, একত্রিত করে রেখেছে।
🍂
বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত অভিজ্ঞতা ভারতীয় তথা বাংলার সমাজে প্রয়োগের তাগিদ অনুভব করলেন তিনি। সমাজে মেয়েদের মর্যাদা বাড়াতে তিনি সচেষ্ট হলেন। সমাজ থেকে সতীদাহ প্রথা ও বাল্যবিবাহ নির্মূল করতে আমৃত্যু তিনি কাজ করে গেছেন। বিধবা বিবাহ প্রচলন, সমাজে নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বপক্ষে তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল। কঠোর সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (একঘরে করা) এবং বাংলায় তরুণী বিধবাদের সম্পর্কে যাবতীয় কুসংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। 

তাঁর বাবা ছিলেন অত্যন্ত সম্মানিত এক ব্যক্তিত্ব। বিধবা বিবাহ পুনঃপ্রচলনে তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব ছিল।  শিক্ষার দ্বারা নারী শক্তির উন্মেষ ঘটাতে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। সেজন্য তিনি বালিকাদের শিক্ষা নিমিত্ত 'বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে অবলা দেবী 'ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়'-এর সম্পাদক পদ অলংকৃত করেন। সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘ ২৬ বছর অতিবাহিত করেছেন। ভগিনী নিবেদিতার সহযোগিতায় কিন্ডারগার্ডেন লেভেলে টিচারদের ট্রেনিং দিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। বালিকা বিদ্যালয়ে আত্মরক্ষার্থে মেয়েদের ট্রেনিং দেওয়া হত। 

অবলা দেবীর বন্ধু-বৃত্ত বেশ সম্পৃক্ত। সেই সব বন্ধু এবং তাদের পরিবারের সাহায্যে 'নারী শক্তি সমিতি' তৈরি করলেন তিনি। সমিতির লক্ষ্য ছিল শিক্ষার মাধ্যমে হাজার হাজার তরুণীর ক্ষমতায়নে সাহায্য করা। এ হেন মিশনে একগুচ্ছ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। যেমন, সূচিশিল্পের মতো হাতের কাজে পারদর্শী করে তোলা হয় মেয়েদের। নারী শিক্ষা ও বিধবাদের উন্নতি সাধনে ফান্ড জোগাড় ছিল সমিতির আরেকটি লক্ষ্য।
     
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বিদ্যাসাগর বাণী ভবন'। বিধবা মহিলাদের শিক্ষিত করে তোলা ও টিচার হিসেবে নারী শিক্ষা সমিতির অধীনে থাকা বিবিধ স্কুলে নিয়োগ দেওয়া ছিল এর কাজ। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি ৮৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৪টি প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলি শিক্ষায় উদ্ভাবনী পদ্ধতি প্রচলিত করে লক্ষ নিযুত কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করে তোলে।

লেডি অবলা বসু কোনো বৈজ্ঞানিক নন। তিনি একজন প্রথিতযশা সমাজকর্মী এবং নারীবাদী। মাঝপথে ডাক্তারী পড়া ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর বৈজ্ঞানিকের গৃহিণী। স্বামী জগদীশচন্দ্র বসুর প্রতিভার দ্যুতিতেই তিনি আলোকিত। বিলেতের বৈজ্ঞানিক কুলের নিরন্তর দ্বন্দ্ব ও বৈরিতার বিরুদ্ধে একা লড়ে লড়ে যে-জগদীশচন্দ্র বসু দারুণ ক্লান্ত, তাঁর জীবনের মৃত সঞ্জীবনী সুধা অবলা দেবী। স্বামীর সুখ দুঃখের শরিক। এ ব্যাপারে তাঁর মনে যে কিঞ্চিৎ হীনম্মন্যতা নেই, তা নয়। তবে জগদীশচন্দ্রের সূত্রে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে তিনি নিমন্ত্রিত অতিথি হয়েছিলেন। আলাপ পরিচয়ের পরিধি তখন ক্রমবর্ধমান। যদিও আগে অবলা দেবীর ধারণা ছিল যে, বৈজ্ঞানিকদের পত্নীরাও খুব বিদূষী। কিন্তু তাঁর সে-ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয় বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে তাঁর ভুল ধারণা ভাঙে। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, ওই মহিলারা সবাই খুব পতিগতপ্রাণা। লর্ড কেলভিন যেমন ভীষণ অগোছালো, অসাবধানি মানুষ। তাঁর স্ত্রী সবসময় স্বামীর ওপর খেয়াল রাখতেন। তেমনি অবলা দেবীও স্বামী অন্ত প্রাণ।‌ তাঁর প্রবল প্রতিভাধর স্বামীর সকল কাজে, এমনকি গবেষণা ক্ষেত্রে তাঁর সাহায্যের লম্বা হাত সর্বদা প্রস্তুত থাকত। আলবার্ট আইনস্টাইনের জীবনে মিলেভা মারিচ-এর যে-ভূমিকা, রসায়ন বিজ্ঞানী অটো হান-এর ল্যাবরেটরিতে লিজা মেইটনার-এর যে-গুরুত্ব; আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জীবনেও মহিয়সী লেডি অবলা বসুর তেমনই বিস্তর অবদান। অপরিহার্যতা। 

এ হেন বৈজ্ঞানিক জায়া স্বল্প রোগভোগের পর কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সেদিনটা ছিল বুধবার। ২৫ এপ্রিল ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ। মৃত্যু কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বৎসর। তাঁর মৃত্যুতে অবিভক্ত বাংলার অবলা নারী সমাজে নেমে এসেছিল অন্ধকারময় অনভিপ্রেত এক কঠিন সময়।

তথ্য সূত্র :
• 'Women Scientists in India' – Anjana Chattopadhyay
• 'নতুন আলো' – সৌম্য ভট্টাচার্য
• উইকিপিডিয়া
• Yahoo News 
• বিভিন্ন বাংলা পত্র-পত্রিকা

আরও পড়ুন 
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 



Post a Comment

0 Comments