সুরস্রষ্টা বিঠোফেন
মিলি ঘোষ
মলিন পোশাক, এলোমেলো চুল আর চোখে দুনিয়ার ক্লান্তি নিয়ে ভিয়েনার এক রাজপরিবারের সঙ্গীত আসরে বিশাল এক পিয়ানোর সামনে এসে বসলেন এক ব্যক্তি। গুঞ্জন শুরু হতেই শিল্পী হাত তুললেন। ব্যাস, সব চুপ। আনন্দ-দুঃখ-হাসি-কান্নায় মেশা এক অপার্থিব সুর বেজে উঠল পিয়ানোয়। সেই সুরের জাদুতে শ্রোতারা প্রায় আচ্ছন্ন। সময় বয়ে যায়, সুর থামে না। অনুষ্ঠানের শেষে শব্দ তরঙ্গের আবেগে ভেসে শ্রোতারা অভিনন্দনের বন্যায় ভরিয়ে দিতে চাইলেন শিল্পীকে। কিন্তু শিল্পী নির্বিকার।
সুরসম্রাট বিঠোফেন। জন্ম জার্মানীর বন নগরীতে 1770 সালের 16th ডিসেম্বর। বাবা দাদু দুজনেই সঙ্গীত জগতের লোক। বেহালাবাদক বাবার কাছেই তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি। কিন্তু সুর ভালোবাসলেও চরিত্রগত দিকে বাবা খুব সুবিধার মানুষ ছিলেন না। বিঠোফেনের প্রতিভার মান কোন পর্যায়ের, তা তিনি ধরতে পারেননি। কারণ, তিনি নিজে ছিলেন খুব সাধারণ মানের বেহালাবাদক। ছেলেকে সঙ্গীত শেখানোটা প্রায় অত্যাচারের জায়গায় পৌঁছে গেছিল। মেরেধরে যেভাবে হোক বিঠোফেনকে শিল্পী বানানোই ছিল তাঁর লক্ষ্য। মধ্যরাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে চার বছরের ঘুমন্ত শিশু-পুত্রকে ঘুম থেকে তুলে পিয়ানোর সামনে বসিয়ে দিতেন। ঘুম চোখে বাজাতে গিয়ে ভুল হয়ে যেত, পরিণামে জুটত কিল, চড়। কিন্তু এই বাবা'ই তাকে রাজসভার অর্গানবাদক ক্রিশ্চিয়ান নেফির কাছে পাঠালেন। নেফি উপলব্ধি করলেন বিঠোফেনের প্রতিভা। বিঠোফেনকে ধীরে ধীরে চিনতে শুরু করল সঙ্গীত জগৎ। বিঠোফেন নেফির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, " যদি আমি কোনোদিন বড় হই, তবে নিশ্চিত ভাবেই তার আংশিক কৃতিত্ব আপনার।" মাত্র এগারো বছর বয়সে নেফির উৎসাহে তিনি রচনা করলেন পিয়ানোর সোনেটা।
একদিকে অভাব। আর এক দিকে সুর। তবু, কিছু কিছু জায়গায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করলেন বিঠোফেন শুধু সুরকে ভালবেসে। কিন্তু পরিবারের আর্থিক অবস্থা ক্রমশঃ খারাপের দিকে যেতে থাকে। অবশেষে নেফির সহযোগিতায় রাজসভার শিল্পী হিসেবে নিযুক্ত হলেন বিঠোফেন। এরপর ভিয়েনাতে মোৎসার্টকে পেলেন তিনি শিক্ষক হিসেবে। মোৎসার্ট স্তম্ভিত হয়েছিলেন ছাত্রর প্রতিভা দেখে। মুখে উচ্ছ্বাস না দেখালেও তিনি বুঝেছিলেন এই ছাত্রটিই একদিন সুর দিয়ে পৃথিবী শাসন করবে। জীবনের মোড় হয়ত ঘুরেই যেত। কিন্তু দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ল না বিঠোফেনের। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে ছুটে আসতে হলো তাঁকে। বহু চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না মা'কে। স্বাভাবিকভাবেই শিল্পীর জীবনে এল চরম বিশৃঙ্খলা। কারণ, মা'ই ছিলেন তাঁর একমাত্র বন্ধু ও আশ্রয়। শোক অবশ্য বিঠোফেনের বাবার জীবনে কোনও পরিবর্তন আনল না। তাঁর তিরিক্ষি মেজাজ, মদের প্রতি আসক্তি আব্যাহত থাকল। মা থাকতে সংসারে যেটুকু হাল ফিরেছিল, তাঁর মৃত্যুতে সেটুকুও গেল। ছোট ভাই-বোনেদের মুখের দিকে তাকিয়ে বিঠোফেন অর্থ উপার্জনের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন।
বহু জ্ঞানীগুণী সঙ্গীতজ্ঞের সান্নিধ্যে থেকেও কোথাও তাঁর মন ভরল না। সব কেমন গতানুগতিক। সঙ্গীতকে আত্মস্থ করার আকণ্ঠ পিপাসা নিয়ে বিঠোফেন গেলেন শিল্পী হেডেনের কাছে। হেডেন যখনই কোনও সুর নিয়ে একটি পথ ধরেছেন, বিঠোফেন অন্য পথে চলেছেন। বিঠোফেন স্রষ্টা, গতানুগতিকতায় বিশ্বাসী নন। এর ফলে দেখা দিল গুরু শিষ্য সংঘাত ও বিচ্ছেদ। সারারাত ধরে বিঠোফেন সুর নিয়ে খেলা করতেন। ভাঙতেন,গড়তেন। শুধু সুর আর সুর। ভোরের আলো যখন জানলা দিয়ে এসে পড়ত, তখন বেহালা নামিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
বয়স যখন ত্রিশ, বিঠোফেন খেয়াল করলেন চারদিকের শব্দ কেমন যেন অস্পষ্ট। দূরের শব্দ তো কানেই আসছে না। কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজেই গেলেন ডাক্তারের কাছে। কোনও ডাক্তারই কোনও আশার আলো দেখালেন না। শ্রবণশক্তি ক্রমশঃ ক্ষীণ হতে লাগল। যে মানুষটা সুর ছাড়া কিচ্ছু বোঝেন না, সেই সুরই তাঁর কানে আসে না। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় দুহাতে সজোরে পিয়ানোর রিডে চাপ দিতেন, তবু কোনও শব্দ তাঁর কানে এসে পৌঁছত না। চূড়ান্ত হতাশা তাঁকে গ্রাস করল। চার বছর তিনি বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলেন। তারপর আবার নিজস্ব শক্তিতে ভর করে প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। শ্রবণশক্তি নষ্ট হলেও হৃদয় তো আছে। এতকাল বাইরে যে সুর শুনেছেন তখন তিনি অন্তরে তারই প্রতিধ্বনি পেলেন। ঝর্ণার মতো সুরের ধারা বইতে লাগল। একের পর এক সিম্ফনি সৃষ্টি করলেন। কত শত বছর পার করে আজও বিঠোফেনের সেই সৃষ্টি মানুষের মনকে আলোড়িত করে।
এত প্রতিকূলতার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া তো থাকবেই। যতক্ষণ বাদ্যযন্ত্র হাতে ততক্ষণ তিনি অন্য মানুষ। বাকি সময় অস্বাভাবিক আচরণ করতেন। জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলতেন। বাড়ির কাজের লোকেরা ভয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াত। কখনও হয়ত দুদিন না খেয়ে কাটিয়ে দিতেন। আবার ধীরে ধীরে শান্ত হতেন। এক অনুষ্ঠানে সামান্য কথা বলার জন্য এক বন্ধুকে তিরস্কার করলেন। আবার যখন শুনলেন সেই বন্ধুর সন্তান মারা গেছে, তিনি ছুটে গেলেন। কোনও কথা না বলে পিয়ানোয় একটার পর একটা সান্ত্বনার সুর তুললেন।
এ প্রসঙ্গে সঙ্গীত শিল্পী মাধুরী চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করতেই হয়। শুনেছি মাধুরী দেবীর বাবার সঞ্চয়ে দেশ বিদেশের বহু শিল্পীর অসামান্য সৃষ্টিগুলি ছিল। কন্যা মাধুরী দিনরাত সেগুলি শুনে শুনে সুরের মায়াজালে আটকা পড়ে থাকতেন। বিশেষ করে বিঠোফেন তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিলেন। এরপর একদিন বিঠোফেনের 6th সিম্ফনির প্রথম চলনের ওপর বেস করে সুর দিলেন তাঁর নিজেরই লেখা গান 'ওই যে সবুজ বনবিথীকা'। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে গাইলেন সেই গান। তারপরের ঘটনা তো ইতিহাস।
এই হলেন সুরস্রষ্টা বিঠোফেন। জার্মানীর লুডউইগ ভ্যান বিঠোফেন। শ্রবণশক্তি ছাড়া যিনি সুর সৃষ্টি করেছেন। অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। বিঠোফেনরা পৃথিবীতে বারবার আসেন না। কারণ, তাঁরা বিরল প্রতিভা। তাই আড়াইশো বছর পরেও সমগ্র বিশ্ব আজও তাঁকে মনে রেখেছে।
তথ্য :
1) The life of Beethoven
David Wyn Jones
2) বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জীবনীশতক।
0 Comments