বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৭
বাঁকড়ি বাদাম
ভাস্করব্রত পতি
কেউ বলেন বাঁকড়ি বাদাম, কেউবা জিলিপি ফল। কেউ বলেন বাংড়ি বাদাম, কিচিমিচি, কিসমিস ফল, খোয়ে ফল, খই ফল, ননি বাবলা, সাকিবাওলা, বিলিতি বাবলা, মেনি বাবলার ফল, সাঁইবাবলা, বাঁকড়ি বেল ইত্যাদি। ইংরেজিতে বলে Blackbead, Sweet Inga এবং Monkeypod। গ্রামবাংলার অতি পরিচিত এই ফল এবং তার গাছ এখন ক্রমশঃ দুর্লভ হয়ে পড়ছে। অথচ গ্রামাঞ্চলে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কাছে একসময় এটি ছিল অন্যতম প্রধান খাদ্যদ্রব্য। অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। দিনবদলের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে চঞ্চলমতি শৈশব। হারিয়ে গেছে গ্রামবাংলার মনিমুক্তোগুলো।
এটির আসল নাম 'ম্যানিলা ট্যামারিণ্ড', 'ম্যাড্রাস থর্ন' বা 'ম্যানিলা তেঁতুল'। কিন্তু টক নয়। মিস্টি। তবে এই নামের সাথে ম্যাড্রাস কিংবা ম্যানিলার সম্পর্ক থাকলেও অন্য কোনও সংস্পর্শ নেই। মেক্সিকোতে এর আদি বাসস্থান। সেখানে একে বলে 'গুয়ামুছি', 'হুয়ামুছিল' এবং 'কুয়ামুছিল'। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে ওপিউমা, কলম্বিয়াতে চিমিনাংগো, পায়াণ্ডি নামে পরিচিত। ল্যাটিন আমেরিকায় এটি হল পিনজান। পুয়ের্তো রিকোতে বলে গুয়ামা অ্যামেরিকানো। নামে বিভিন্নতা থাকলেও স্বাদে এটি অতুলনীয়।
একে 'ম্যাড্রাস থর্ন' বা 'কামাচিলি'ও বলে। কুয়েতে বলে 'শওকত ম্যাড্রাস'। 'শওকত' এর অর্থ 'থর্ন'। দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা এবং মেক্সিকো এলাকায় 'ফ্যাবেসি' গোত্রের এই বাসিন্দা গাছটি কিভাবে ভারত সহ দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোতে এলো তা অবশ্য এখন আর জানার সম্ভাবনা কম। তবে ব্যবসায়িক যোগাযোগের কারনে কোনোভাবে কোনো ফলরসিকের হাত ধরে এই গাছের বীজ এসে গিয়েছিল এদেশে। মন জয় করে নিয়েছিল শিশু কিশোর থেকে মায় বয়স্কদেরও।
তেলুগুতে বলে 'সীমা চিন্তাকায়া', 'সুইট ইঙ্গা', তামিলে 'কোডুক্কাপ্পুলি' বা 'কোডিক্কাই', কন্নড়ে বলে 'ইলাইচি কাই', 'সীমি হুনাসে', গুজরাটিতে 'বাখাই আম্বলি' বা 'গোরাস আম্বলি' , হিন্দিতে বলে 'সিঙ্গরি', 'বিলায়তী ইমলী', 'গ্যাঞ্জেস ট্যামারিণ্ড', মারাঠীতে বলে 'ফিরিঙ্গী চিঁচ', সিন্ধ্রিতে 'আচ্ছি গিডামিরি', ওড়িয়াতে 'সীমা কাইয়ান', উত্তরপ্রদেশে এবং পাকিস্তানে একে বলে 'জঙ্গল জলেবি'। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম হলো Pithecellobium dulce।
এই ধরনের গাছ খরা সহায়ক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৫০০ মিটার উঁচুতেও বহাল তবিয়তে জন্মায়। মোটামুটি ৩৩ - ৪৯ ফুট লম্বা হয়। পুরো গাছটায় কাঁটা ভর্তি। এর ফলটা খুব সুদৃশ্য এবং পেকে গেলে লাল রঙের হয়। ভেতরে সাদা রঙের নরম তুলতুলে শাঁস দারুণ সুস্বাদু।
একসময় বিভিন্ন পার্কে, স্কুল ও রেলস্টেশন চত্বরে প্রচুর দেখা মিলতো। এখন এইসব গাছ আর দেখা যায়না। মেছেদা রেলস্টেশন সংলগ্ন এলাকায় এই জিলিপি ফলের গাছ অনেক রয়েছে। হুগলীর সোমরা বাজারের কাছে গঙ্গার চর -- 'সবুজ দ্বীপ' আছে । সেখানে অসংখ্য জিলিপি ফলের গাছ আছে। রূপনারায়ণের পাড় বরাবর বহু গ্রামে বাঁকড়ি বাদামের কিছু গাছ এখনও আছে।
আজ থেকে ২৫ - ৩০ বছর আগে যত্রতত্র দেখা গেলেও এখন কমে গিয়েছে। প্রকৃতিপ্রেমীদের দাবি, সরকারের উচিত এইসব প্রায় উধাও হতে বসা গাছগুলোকে যত বেশি সম্ভব উৎপাদন করা এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে বিতরণ করা। আমফান ঝড়ঝঞ্ঝাতে অনেক গাছ নষ্ট হয়েছে। এই জিলিপি ফলের গাছ কিন্তু জানে ঝড় কাটিয়ে টিকে থাকতে।
বনদপ্তরও এইসব গাছের চারাগাছ তৈরি করে না। অথচ রাস্তার পাশে এরকম গাছ 'ওরনামেন্টাল প্ল্যান্ট' হিসেবে লাগানোই যেতো। একদিকে যেমন সৌন্দর্য বৃদ্ধি হোতো, অন্যদিকে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সহায়ক হোতো। তবে এখন সচরাচর আর মেলেনা। তাছাড়া পিৎজা, বার্গার, বিরিয়ানি, চিকেন চাপে মজে থাকা বর্তমান প্রজন্মের চোখে এইসব ফলগুলো এখন যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোনো ডাইনোসরের ডিম।
0 Comments