জ্বলদর্চি

কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু /অর্ণব মিত্র

 


  কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু

   অর্ণব মিত্র


          “ট্রামের লাইনের পথ ধরে হাঁটি 

          এখন গভীর রাত,

          কবেকার কোন সে জীবন টিটকারি দিয়ে যায় 

          ‘তুমি যেন রড ভাঙা ট্রাম এক

          ডিপো নাই, মজুরির প্রয়োজন নাই 

          কখন এমন হলো হায়’ 

          আকাশের নক্ষত্রে পিছে অন্ধকারে 

          কবেকার কোন সে জীবন ডুবে যায়।”

লিখেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ।তাঁর একটি কবিতায়। কলকাতা শহরের ট্রাম নিয়ে তাঁর আরও কয়েকটি কবিতা আছে। এছাড়া ১৯৩২ সালে ডায়েরির পাতায় লিখেছেন ‘ how quiet possible it may be to slip and runover by tram’। আর কলকাতা শহরের এই ট্রামের আঘাতেই ১৯৫৪ সালের ২২শে অক্টোবর মৃত্যু হয় গত শতাব্দীর সব থেকে আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ-এর। 

কবিতায় লিখেছেন ‘এখন গভীর রাত’। কিন্তু সেদিন, মৃত্যুর আট দিন আগে ১৪ই অক্টোবর- সময়টা ছিল ‘সন্ধ্যাবেলা’। ধর্মতলা থেকে বালিগঞ্জের দিকে ২৪ নম্বর রুটের ট্রামটি রাস্তার মাঝখানের ঘাসের মধ্যে ট্রামলাইন বেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল। ছেলে রঞ্জুর জন্য দু’হাতে দুটি ডাব নিয়ে লেক মার্কেট থেকে তাঁর ল্যান্সডাউন রোডের ভাড়াবাড়িতে ফিরছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলেন বা বুঝতে পারেননি ট্রামের গতি। তাছাড়া ডায়াবেটিসের জন্য গত কয়েক বছর ধরে দৃষ্টিশক্তিও ঝাপসা হয়ে এসেছিল। ট্রাম থেকে অবিরাম ঘণ্টা বাজাচ্ছিলেন ও নিজে চিৎকার করে বার বার সতর্ক করছিলেন ড্রাইভার। কিন্তু যা অনিবার্য , তাই ঘটল। কবি ট্রামের সামনে পড়ে গেলেন। ইঞ্জিনের সামনের কাউক্যাচার টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল তাঁকে। এরপর ট্রাম থামিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে ট্রামের নীচে পড়ে গুরুতর আহত হলেন কবি। পরের দিন সেই সময়ের একটি দৈনিকের পাতায় লেখা হল ‘ ট্রাম হইতে পতনের ফলে গুরুতর আহত হন কবি’।          

চাকরি জীবনে একসময় পূর্ববঙ্গের বরিশালে ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। সেই কলেজে কবি জীবনানন্দ দাশ-এর ছাত্র ও পরবর্তীকালে বিখ্যাত লেখক ইন্দ্র মিত্র কবির ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার সময় কলকাতায় ছিলেন। তিনি লিখেছেন ‘ল্যান্সডাউন রোড আর রাসবিহারী এভিন্যুর মোড়ে গিয়ে সেদিন রাত্রে শুনলাম,খানিক আগেই ওখানে ট্রাম দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন জীবনানন্দ’। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। খানিকবাদে আবার জ্ঞান ফিরে এসেছিলো। জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আমি কোথায় ?’ 

উপস্থিত এক ভদ্রলোক বলেছিলেন ‘আপনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন, তাই’ 

‘ও।তাহলে আমি এখন বাড়ি যেতে পারি? – আহত কবি বলেছিলেন। 

হ্যাঁ, 

বাড়ি যাবার জন্যে জীবনানন্দ উঠলেন। উঠেই পড়ে গেলেন। আবার জ্ঞান হারালেন। চারপাশের লোকজন দৌড়ে এল। ওখানে দুর্ঘটনাস্তল-এর কাছে ফুটপাথের পাশে চুনীলালবাবুর জলখাবারের দোকান। চুনীলাল দে- বজরং ব্যায়ামাগারের ট্রেনার, কুস্তিগির, বেশ স্বাস্থ্যবান তিনি। পুলিশের ভয়ে কেউ না ধরলেও চুনীলালবাবু এগিয়ে এলেন। পাজাকোল করে কবিকে তুলে নিলেন। তারপর কোনওমতে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে আহত কবিকে নিয়ে ভর্তি করালেন শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে।

তাঁর মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশ ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হওয়া ও হাসপাতালে কবির মৃত্যু সমন্ধে লিখেছেন ‘এমনি একদিন সন্ধ্যাবেলায় পৃথিবীর পথে চলতে গিয়ে কবি আর ঘরে ফিরলেন না। শুনলাম ট্রাম অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।আমরা দৌড়ে গেলাম শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। দেখি,বাবার মলিন কাপড়ে রক্তের দাগ। দু’দিন পরে ডাক্তারের হাত ধরে বলেছিলেন,ডাক্তারবাবু,আমি বাঁচবো তো ? বাবার শরীরের অনেক হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল।হাসপাতালে হাজারো মানুষ আসতেন। শুভার্থী সুহৃদ স্বজন। হাতে ফল, কণ্ঠে শুভেচ্ছা। হাসপাতালে সেবিকা ছিলেন। বাবাকে দেখতেন। তবুও কজন আত্মীয়,দু’তিনজন তরুণ কবি ও আমরা –সব সময় কাছে থাকতাম,পরিচর্যার জন্য। 

একদিন বাবার শিয়রে বসে আছি।আমরা দু’জন ছাড়া আর কেউ ছিল না।দেখলাম বাবার চোখ সজল।যে মানুষ কখনো ভেঙ্গে পড়েননি, আজ সময়ের নির্মম আঘাতে সে চোখ সজল। আমি সামনে এলাম। আমায় দেখতে পেয়ে বাবা নিমেষে সহজ হলেন। বললেন, অমুক পত্রপত্রিকা এনে রাখিস। 

হাসপাতালে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে চেয়েছিলেন। শেষদিকে ডাক্তার বিধান রায় দেখতে এলেন। ডাক্তার রায় খানিকক্ষণ বাবার মুখের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন। কোন কথা বললেন না। শুধু বাবার জন্য অনেক সুব্যবস্থা করে গেলেন।কিন্তু জীবনকে জানবার অবিরাম ভার বাবাকে আর বইতে হল না।

সেটা ১৯৫৪-এর,২২ অক্টোবর।রাত প্রায় সাড়ে এগার। আমার সবচেয়ে প্রিয়জনের সবচেয়ে ধূসর সময়। 

বাবা সজোরে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন। বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা সবাই। অনেক স্বজন-ক্রমে জীবনের স্পন্দন থেমে গেল’। 

১ 

কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মেছিলেন ১৮৯৯ সালে, অভিব্যক্ত বাংলাদেশের বরিশালে। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজী সাহিত্য নিয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশুনা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শেষ করে কর্মজীবন শুরু করেন অধ্যাপনা দিয়ে। ১৯১৯-এ প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে স্নাতক ও পরে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর পাশ করে ১৯২৬ সালে চাকরি জীবনের শুরু  কলকাতার সিটি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হয়ে। এরপর তিনি সেই চাকরি ছেড়ে কলকাতার দক্ষিণে বাঘেরহাট পি,সি কলেজে অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। তবে সেখানেও তিনি স্থায়ী হতে পারেননি। এরপর তিনি তাঁর জন্মস্থান বরিশালের কাছে ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনার জন্য যান। সেখানে সুস্থির ভাবে ১১ বছর চাকরি করার পরে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময় ভৌগোলিক ভাবে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ-স্থান দুটি আলাদা দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়াতে তাঁদেরকে সপরিবারে কলকাতায় চলে আসতে হয়।

জীবনানন্দেরা ছিলেন তিন ভাই-বোন। জীবনানন্দই ছিলেন বড়। ভাই অশোকানন্দ  ও বোন সুচরিতাকে নিয়ে সব মিলিয়ে একান্নবর্তী পরিবার। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনার সময় থেকে সাহিত্য পত্রপত্রিকায় লেখালেখির শুরু।তিনি কবিতা লিখে ট্রাঙ্কে রাখতেন।  ছোটবোন সুচরিতা খুব স্নেহের পাত্রী ছিলেন তাঁর। কখনও কখনও তাঁর সামনে তিনি বার করতেন ওই ট্রাঙ্কের লেখা। তাঁর জীবদ্দশায়  ৫৫ বছর বয়স অবধি সাতটি  কবিতাগ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। বাকি ট্রাঙ্কভর্তি সব লেখা  তাঁর মৃত্যুর পরে উদ্ধার করা হয়েছে। ১৯২৭ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হল।  ‘ঝরা পালক’-এর পর একে একে প্রকাশিত হয়  ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন(কবিতাভবন সংস্করণ), ‘মহাপৃথিবী’, ‘ সাতটি তারার তিমির’, ‘বনলতা সেন’(সিগনেট প্রেস সংস্করণ), ‘জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’।

কবি সামগ্রিক কর্মজীবনে পাঁচটিরও বেশি কলেজে  অধ্যাপনার কাজ করেছেন।ভাল না লাগায় ১৯২৯ সালে বাগেরহাট কলেজের চাকরি ছেড়ে দেন। সেখা‌ন থেকে দিল্লি। ১৯৩০ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনি দিল্লিতে ছিলেন। তার পর বিয়ে করতে বরিশালে এসে আর দিল্লি যাননি। ১৯৩৫ সালে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার আগে এবং আবার কলকাতায় ফেরা পর্যন্ত, এ শহরে তাঁর থাকবার জায়গা ছিল কখনও মেস, কখনও ত্রিকোণ পার্কে ভাই অশোকানন্দের বাড়ি, কখনও ল্যান্সডাউনের ভাড়াবাড়ি। দেশভাগের পরে কলকাতায় এসে বন্ধু সঞ্জয় ভট্টাচার্যের চেষ্টায় ‘স্বরাজ’ নামে একটি নতুন দৈনিক পত্রিকার রবিবাসরীয় সাহিত্য বিভাগটি সম্পাদনার কাজ পেয়েছিলেন। ‘স্বরাজ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে ১৯৫০ সাল নাগাদ কিছু দিন মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর কলেজে কাজ করছিলেন। সেখান থেকে  কলকাতা শহরে ফিরে  বড়িশা কলেজ ও ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। এরপর এই কলেজগুলি ছেড়ে  হাওড়া গার্লস কলেজে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। থাকতেন রাসবিহারীর কাছে ল্যান্সডাউনের ভাড়াবাড়িতে। হাওড়া গার্লস কলেজে চাকরি করার সময় ১৯৫৪ সালে দুর্গাপূজার কয়েকদিন পরেই এই ট্রাম দুর্ঘটনাটি ঘটে।

   ‘অনেক রাত হয়েছে – অনেক গভীর রাত হয়েছে ;

   কলকাতার ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে-ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে 

   কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো 

            এই-যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে 

       পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ 

                 অনুভব করে হাঁটছি আমি। 

গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে-কেমন যেন ঠাণ্ডা বাতাস; 

কোন দূর সবুজ ঘাসের দেশ নদী জোনাকির কথা মনে পড়ে আমার,-

তারা কোথায় ?

তারা কি হারিয়ে গেছে ? 

একটি কবিতায় এই কথাগুলি লিখেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। কলকাতা শহরের ফুটপাথে রাত্রে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন তিনি।প্রায় রোজই সন্ধ্যাবেলা হাঁটতে বেরতেন ও ফিরতেন রাতের দিকে। ট্রামলাইন ধরে হাঁটতেন। দুর্ঘটনার দিন যেমন হাঁটছিলেন। কিন্তু কলকাতা শহরের ট্রামলাইনের স্পর্শ তাঁর কাছে বিস্বাদ লাগত। শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ট্রামলাইনকে তাঁর মনে হত কোন আদিম সাপের মত। যাঁদের বিষময় বিস্বাদ স্পর্শ শরীরের রক্তে অনুভব করতেন ও হাঁটতেন। আর মনে পড়ত দূরের কোনও সবুজ ঘাসের দেশ ,জোনাকি ও নদীর কথা। কবিতায় তিনি প্রশ্ন করেছেন তারা কোথায় ? তারা কি হারিয়ে গেছে? আর এই প্রশ্ন নিজেকেই করেছেন তিনি। কারণ কলকাতায় চলে আসার ফলে সেই ছোটবেলার বরিশালের জগত হারিয়ে গেছিল একদিন তাঁর কাছ থেকে ।

মাথার ভিতর বরিশালের  প্রান্তরের সবুজ ঘাসের ঘ্রাণ আর পায়ের তলায় ট্রামলাইনে ভরা কলকাতা  ।  কবি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বকে নিয়ে চলেছেন।কবি জীবনানন্দ দাশকে বলা হত নির্জনতম কবি । ব্যক্তিগত জীবনে  অসুখী, জীবনভর আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভোগা, একের পর এক চাকরি ছাড়া, লোকের সঙ্গে সহজ ভাবে মিশতে না পারা, সমালোচকদের আক্রমণে ধ্বস্ত এক শিল্পী ছিলেন তিনি আজীবন। 

কলকাতায় তাঁর সমসাময়িক কবি ও উপন্যাসিকরা ছিলেন  বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে । চল্লিশের দশকের শেষে ধীরে ধীরে কবি হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন ,তবে  তখনও তাঁর কবিতা পত্র-পত্রিকা থেকে ফেরত আসে, নতুন কবিতা সংকলনে তাঁর নাম ছাপা হয় না। অন্য দিকে ব্যক্তিগত, আর্থিক জীবনেও অনিশ্চয়তা ছিল।বরিশাল-এর স্থান ছিল তাঁর হৃদয়ে।তবে কাজের ও অর্থের নিশ্চয়তার জন্য শেষ পর্যন্ত কলকাতা শহর ছেড়ে যেতে পারেননি! । 

বরিশালের কাছে বগুড়া মোড়ের বিশাল জায়গা জুড়ে বাড়ি, সেই জমির ঝোপের মধ্যে হলুদ ছোপ পড়া আনারস ফল, কাঁঠালগাছ, আমগাছ, শিশির পড়ার  শব্দ, গভীর রাতে সুপুরি নিয়ে ইঁদুরদের ছোটাছুটি , মাছ ধরা, ঠাকুমার গল্প, মফস্‌সলের নদী-খালের মতো বরিশালের প্রকৃতির বিভিন্ন  উপকরণ, দৃশ্য, মুহূর্তের সঙ্গে ছোটবেলায় তাঁর মনে  যে অদৃশ্য বাঁধন তৈরি হয়েছে, সেই বাঁধন আজীবন তাঁর সঙ্গে চলেছে, সে তিনি যেখানেই যান না কেন! সেই সমস্ত দৃশ্যই  খুলে দিয়েছে তাঁর কল্পনার দরজা । 

ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কবি জীবনানন্দ দাশকে পরের দিন দেখতে গেছিলেন তাঁর ছাত্র লেখক ইন্দ্র মিত্র। তাই তিনি লিখেছেন ‘হাসপাতাল থেকে ফিরতি পথে বারবার মনে হয়েছে, যে-শহরে উনি বহুকাল ছিলেন, যে শহরকে উনি খুব ভালোবাসতেন- সেই বরিশালে থাকলে, আর যাই হোক, ট্রাম ওকে স্পর্শ করতে পারত না’। 

১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর। আগের দিনই রেডিয়োয়  কবিতাও পাঠ করেছিলেন। তা নিয়ে সে দিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন। তার পর প্রতি দিনের মতো ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ি থেকে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই হাঁটা  তাঁর অভ্যেস। ওপার বাংলায় ছোটবেলার সেই স্টিমারের জেটি। কিছুটা দূরে ঝাউয়ের সারি। লিচু, অজস্র ফুল-ফল সমারোহে বিশাল এলাকা নিয়ে ব্রাউন সাহেবের কুঠি। সে সব পার হয়ে ব্রাহ্ম সমাজ সার্কিট হাউসের গির্জা, তা ছাড়িয়ে গেলে শ্মশানভূমি, লাশকাটা ঘর।  সে দিনও কি হাঁটতে বেরিয়ে জীবনানন্দ সন্ধ্যের আকাশের মেঘ দেখে বরিশালের কথা ভাবছিলেন? না হলে কেন ট্রামের অবিরাম ঘণ্টা বাজানোর আওয়াজ, ট্রাম চালকের চিৎকার শুনতে পাবেন না তিনি! 

🍂

৩ 

কবি জীবনানন্দ দাশ শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ১৪ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবরের রাত অবধি আটটি দিন ও রাত মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছেন।

১৯৫২ সালে তরুণ  কবি  ভূমেন্দ্র গুহ ও তাঁর বন্ধুরা মিলে বার করতেন কবিতার কাগজ ‘ময়ূখ’। ‘ময়ূখ’ পত্রিকার জন্য কবিতা চাইতে গিয়ে তাঁর আলাপ হয় কবি জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর পরিবারের সাথে। 

তিনি কবির মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছেন ‘ এমনি করেই ২২ অক্টোবরের রাত এসে পড়ল। তিনি মারা গেলেন। বেঁচে উঠবার সাধ ছিল,কিন্তু গলায় তেমন জোর টেনে আনতে পারতেন না। দিদি(সুচরিতা দাশ) বলতেন, ভাবছ কেন, এই তো আজ তুমি অনেক ভালো আছ, জ্বর নেই, ভালো হয়ে উঠবে। 

সেই রাত্রির বিবরণ দিয়ে কবি  ভূমেন্দ্র গুহর বন্ধু ও ‘ময়ূখ’ পত্রিকার তরুণ সহ-সম্পাদক সমর চক্রবর্তী ‘শেষের কদিন’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘ সমস্ত ব্যবস্থা করে কবিকে নিয়ে যেতে অনেক রাত হয়ে গেল। মোটরের মধ্যে কবিকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিল। এলগিন রোড ধরে ল্যান্সডাউনে গিয়ে গাড়ি দাঁড়ালো। গভীর রাত্রি। মহানগরী ঘুমে অচেতন। সারি সারি দেবদারু আর কৃষ্ণচূড়া গাছ চোখ মেলে দেখছে এই মহাযাত্রা।গাড়ি এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াল’। 

শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতাল থেকে কবি জীবনানন্দ দাশ-এর শবদেহ নিয়ে আসা হয় তাঁর ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে। তবে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার আগে তাঁকে নিয়ে আসা হয় কাছে ত্রিকোণ পার্কে ভাই অশোকানন্দ দাশের বাড়িতে।   

এ সমন্ধে কবি  ভূমেন্দ্র গুহ লিখেছেন ‘আমরা তাঁর স্বজন-পরিজনের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ করে তাঁর শবদেহ সেই রাত্রেই ত্রিকোণ পার্কে অশোকানন্দ-নলিনী দাশের দোতলার ফ্ল্যাটে নিয়ে এলুম।সিঁড়ির গোড়ার ঘরটিতে দরজার দিকে মুখ করে তাঁকে পুস্পাচ্ছাদনে সাজিয়ে শুইয়ে রাখা হল’। 

তিনি লিখেছেন খুব সকালে সবার চাইতে আগে এসেছিলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। এছাড়া সাহিত্যিকদের মধ্যে কবিকে দেখতে এসেছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু,প্রেমেন্দ্র মিত্র, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়,কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সদ্য কৈশোর পেরনো কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। 

কবির মরদেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় তরুণ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও শবযাত্রীদের সঙ্গী হয়েছিলেন। এ সমন্ধে তিনি স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন ‘শবানুগমনে খুব বেশি লোক হয়নি। আমাদের অল্পবয়সি কাঁধ বেশ শক্ত, আমরা কয়েকজন কাঁধ দিয়েছিলাম পালা করে। জীবনে একবারই মাত্র সেই কবির শরীর আমি স্পর্শ করছি,তখন নিস্পন্দ। ক্যাওড়াতলায় তখনও বিদ্যুৎচুল্লি হয়নি,তাঁকে চিতায় পোড়ানো হয়েছিল। কবির শরীর যখন চিতায় জ্বলছে,কিছুদুরে একটা ফাঁকা জায়গায় বসে আমরা কয়েকজন অনর্গল তাঁর কবিতা বলছিলাম’।

৪    

শহরের প্রাণঘাতী ট্রামলাইনে তাঁর পথ হাঁটা থেমেছিল আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে  । কবি  জীবনানন্দ দাশ আর ফেরেননি !  তবে তিনি রয়ে গেছেন তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়ে। এই প্রজন্মের কাছে তাঁর এই কবিতার লাইনগুলি যেন এই কথাটিকেই সমর্থন করে    

                         ‘তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই- তবু, 

           গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই- তুমি 

           আজো এই পৃথিবীতে রয়ে গেছ’।


তথ্যসূত্র 

আনন্দবাজার পত্রিকা,

গৌতম মিত্র, সংবাদ প্রতিদিন, ‘সেকেন্ড ক্লাস’- বিশেষ ট্রাম সংখ্যা।

জীবনানন্দ-আধুনিক কবিতার প্রাণপুরুষ, কামরুজ্জামান, এডুকেশন ফোরাম। 

আমার জীবনানন্দ আবিস্কার ও অনান্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। 

জীবনানন্দের স্মৃতি-সাহিত্যম।

জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা - ভারবি।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇



Post a Comment

2 Comments

  1. বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্র পতন।

    ReplyDelete
  2. বন্ধু অর্ণব মিত্রের এই বিশেষ নিবন্ধটি মন ছুঁয়ে গেল ।

    ReplyDelete