জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪০ /বিজন সাহা

বুলগারের ইসলাম গ্রহণের স্মৃতিস্তম্ভ

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪০ 

বিজন সাহা 

বলগার বা বুলগার

তাতার ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার ছবি তুলে তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম জাদুঘরের দিকে। সেবার এই রাস্তাটুকু আমরা এসেছিলাম বাসে। এবার হাঁটতে গিয়ে দেখি অনেকটাই পথ। একেবারে শুরুতেই ফলকে লেখা আছে
রাষ্ট্রীয় ইতিহাস ও স্থাপত্যের জাদুঘর বুলগার। দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভোলগা তীরের বুলগার রাজ্যের রাজধানী। ধ্বংস প্রায় বিভিন্ন স্থাপনা, খাদ ও টিকে থাকা অন্যান্য চিহ্ন – এসবই হারিয়ে যাওয়া শহরের অমূল্য স্মৃতি যা রাষ্ট্র দ্বারা সংরক্ষিত। 

সমস্ত পরিবেশ পর্যটকদের নিয়ে যায় সুদূর অতীতে। হাঁটতে হাঁটতে আর ছবি তুলতে তুলতে আমরা চললাম বুলগার সাম্রাজ্যের ইতিহাসের জাদুঘরের দিকে। উপর থেকে একতলা এই বিল্ডিং দেখতে বেশ সাদামাটা। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে বোঝা যায় এসব শুধুই মায়া। কেননা এখান থেকে টিকেট কেটে এক্সেলেটরে করে একের পর এক তলা পেরিয়ে নীচের দিকে নামতে হয়। একেবারে শেষ ভোলগার তীর। সেখানে জাহাজ ঘাট। বহুতল বিশিষ্ট এই বিল্ডিং শুধু ঐতিহাসিক জাদুঘরই নয়, রীতিমত আধুনিক শপিং মল, যদিও পণ্য সামগ্রীর বেশির ভাগ স্থানীয় স্যুভেনির।      

🍂

বুলগার বা বলগার বা চুভাশ ভাষায় পালহার তাতারস্তান রিপাবলিকের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। মধ্যযুগীয় ভোলগা তীরের বলগার ও গোল্ডেন হোরড রাজ্যের রাজধানী বলগারের সমস্ত এলাকা জুড়ে আজ দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক বলগার শহর ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম বলগার। ধারণা করা হয় যে শহরের নামকরণ করা হয়েছে বুলগার জাতির নাম থেকে। আধুনিক বলগার এলাকায় প্রাচীনতম জনপদ গড়ে ওঠে নবম শতকের শেষ ও দশম শতকের শুরুতে। দশম শতকের প্রথম দিকের স্থাপনা গড়ে ওঠে ভোলগার অদূরে ছোট জেরুজালেম গিরিখাতের মুখে। যেখানে কামা এসে পড়ছে সেখানে ভোলগার উঁচু পাড় থেকে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যেত যা বিশাল অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার সহায়ক ছিল। ফলে এখানেই গড়ে ওঠে জনপদ। এছাড়া সেখানে ইতিমধ্যেই ভোলগা তীরের বুলগারে আগা-বাজার নামে এক বিখ্যাত বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। অনেকের মতে অষ্টম শতকের শেষ থেকে একাদশ শতকের শুরু পর্যন্ত রাশিয়ার সাথে এশিয়ায় ব্যবসা বানিজ্যের একমাত্র পথ বা দরজা ছিল এই বুলগার। ৯২০ সালে আরব ভুগোলবিদ আল-বালখির রচনায় বলগারের উল্লেখ পাওয়া যায়। কুড়ি ভান্টারের লেখা থেকে শহরের নিকটবর্তী এলাকায় ইউখান-ভাসান ও শেরপেত নামে দুই হ্রদের কথা জানা যায়। এছাড়া প্রাচীন আরব সাহিত্যে এখানে সোয়ান লেক বা আক্কোশ কুল নামে আরেক হ্রদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই এই এলাকা তিন হ্রদের দেশ নামেও পরিচিত ছিল। স্থানীয় রাজা আলমুশার আমন্ত্রণে ৯২২ সালে আব্বাসিদ খালিফা আল-মুক্তাদিরের রাষ্ট্রদূত বলগার ভ্রমণ করেন। রাষ্ট্রদূতের সেক্রেটারি ইবন ফাদলানের লেখা থেকে জানা যায় যে ৯২২ সালেই বলগার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। সেই সময় বলগারের সোনার কর্মকার, রাজমিস্ত্রী, চর্মকার, কামার ইত্যাদি পেশার লোকজনের সুনাম ছিল। বুলগারের অলঙ্কার, চর্মজাত পণ্য, পশম, মধু, রাবার – এসব বিভিন্ন দেশে সুপরিচিত ছিল আর সেসব দেশে বুলগারের পণ্যের চাহিদা ছিল ব্যাপক। বুলগারের বনিকেরা এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য করত। অন্য দিকে চীন, বাগদাদ, দামাস্ক, স্পেন ও স্ক্যান্ডিনাভিয়ান বনিকেরা বার্ষিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় যোগ দিতে বুলগারে আসত। অনেক বিদেশী কোম্পানির এখানে নিজস্ব পাড়া ও রাস্তা ছিল। আরবের ভুগোলবিদ ইদ্রিসির ১১৫৪ সালের মানচিত্রে বুলগার ও ভোলগা তীরের বুলগারিয়া বিস্তারিত ভাবে স্থান পেয়েছে। ১২২০ সালে রুশ যুবরাজগণ বুলগারে অগ্নি সংযোগ করেন। ১২৩৬ সালে মঙ্গোলদের কাছে পদানত হবার আগে পর্যন্ত বুলগার ছিল ভোলগা তীরের বলগার রাজ্যের বহিঃবানিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। দশক শতকের অনেক আরব লেখায় পাওয়া যায় যে খুবই ছোট্ট এক শহর হওয়া সত্ত্বেও বলগার হচ্ছে সেই রাজ্যের প্রধান বানিজ্য কেন্দ্র।  

রাষ্ট্রীয় ইতিহাস ও স্থাপত্যের জাদুঘর বুলগার

১২২৩ সালের শেষ ও ১২২৪ সালের শুরুতে মঙ্গোল বাহিনী ইরান ও ককেসাস হয়ে ফেরার পথে রুশ ও পোলোভশিয়ানদের পরাজিত করে বুলগার আক্রমণ করে। কিন্তু সেই যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়ে ফিরে যায়। ১২২৯ সালে মঙ্গোলরা আবারও বুলগার আক্রমণ করে সাকসিন দখল করলে বুলগারের সুলতান ভ্লাদিমিরের শাসকের সাথে আরও ছয় বছরের জন্য শান্তি চুক্তি প্রলম্বিত করে। ১২৩৬ সালে বাতুর নেতৃত্বে মঙ্গোলরা বুলগার দখল করে পুড়িয়ে দেয়। মুসলিম শাসনের সময় বুলগার গোল্ডেন হোর্ডের স্থানীয় কেন্দ্রে পরিণত হয় আর উজবেক খানের রাজ্যত্বকালে উন্নতির শিখরে পৌঁছে। সে সময় অনেক পাথরের স্থপনা তৈরি হয় যার ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান। ১৩৬১ সালে বুলাত তিমুর আবারও বুলগার পুড়িয়ে দিলে শহর পুনরায় নির্মাণ করা হয়। ১৩৯৯ সালে (অনেকে ধারণা করে ১৩৯৫ সালে) দ্মিত্রি দনস্কইয়ের তৃতীয় পুত্র যুবরাজ ইউরি দ্মিত্রিয়েভিচ সাফল্যের সাথে তাতার এলাকা আক্রমণ করে ভোলগা তীরের অনেক শহর দখল করেন। ১৪৩১ সালে গ্র্যান্ড ডিউক দ্বিতীয় ভাসিলির সেনাপতি ফিওদর পালেৎস্কি বুলগার রাজ্য ধ্বংস স্তূপে পরিণত করে। বলতে গেলে এখানেই বুলগার রাজ্যের ইতিহাসের ইতি ঘটে। পরবর্তীতে বুলগার জাতি নতুন করে নিজেদের রাজ্য গড়ে তোলে, তবে নতুন এই রাজ্যের রাজধানী হয় কাজান  আর নতুন রাজ্যের নাম হয় কাজান সুলতানাত। ৯২২ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী বলগাররা স্থানীয় ফিন্নো-উগ্রিক ও কিপচাক্সকি জাতির জাতি মিলে নতুন জাতির জন্ম দেয় জা কাজানস্কি তাতার নামে পরিচিত। এছাড়া সাভির ও বলগার জাতির আরেক অংশ যারা পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করত, একত্রিত হয়ে মারি ও চুভাশ জাতির জন্ম দেয়।   

ছোট মিনার, খানদের সমাধি, উসপেনস্কি সাবর

১৫৫২ সালে ইভান গ্রজনি কাজান দখল করলে বুলগার রুশ সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। সপ্তদশ শতকে বুলগারের ধ্বংস স্তূপে নির্মিত হয় উসপেনস্কি মনাস্তির। বুলগার রাজ্যের এই ধ্বংসাবশেষ দেখতে পিওতর দ্য গ্রেট ও সম্রাজ্ঞে দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনা এখানে আসেন। ১৭৮১ সালে বুলগারের নামকরণ করা হয় স্পাস্ক। এটা তখন ছিল রুশ সাম্রাজ্যের কাজান প্রদেশের এক মফঃস্বল বা কাউন্টি শহর। উনিশ শতকে স্পাস্ক ছিল আশেপাশের সমস্ত এলাকার সরবরাহ কেন্দ্র। ১৮৫৬ সালে এখানে ছিল একটি গির্জা, ২৪৬ বাড়ি আর পাঁচটি দোকান। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এটা ছিল স্পাস্ক ক্যান্টনের প্রাশাসনিক কেন্দ্র। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত সমস্ত মানচিত্রে এই শহর স্পাস্ক বলেই চিহ্নিত করা হয়, তবে এই নামের অন্যান্য শহর থেকে পৃথক করার জন্য একে স্পাস্ক-তাতারস্কি নামেও ডাকা হত। ১৯৩৫ সালে কুইবিশেভের মৃত্যুর পরে শহরের নাম বদলিয়ে কুইবিশেভ রাখা হয় যা ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। ১৯৫৭ সালে কুইবিশেভ রিজারভয়ারে জলোচ্ছ্বাসের ফলে শহর ডুবে যায়। ১৯৫৭ সালে ডুবে যাওয়া শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বুলগার গ্রাম থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে কুইবিশেভ নামে নতুন শহরের গোড়াপত্তন করা হয়। ১৯৬৯ সালে বলগার রাষ্ট্রীয় ইতিহাস ও স্থাপত্য সংরক্ষণ কেন্দ্র (২০০০ সাল থেকে জাদুঘর সংরক্ষণ কেন্দ্র) স্থাপন করা হয়। শুধু প্রাচীন নিদর্শন খোঁজার জন্য  খননকার্য নয়, সাথে সাথে চলতে থাকে পুনর্নির্মাণ কর্ম। ১৯৯১ সালে প্রাচীন শহরের নামানুসারে এই শহরের নাম রাখা হয় বলগার। ২০১০ সাল থেকে তাতারস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট মিন্তিমির শাইমিয়েভের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় বিশাল নির্মাণ যজ্ঞ “সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যঃ দ্বীপ শহর সভিয়াঝস্ক ও প্রাচীন বুলগার”। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ইতিমধ্যেই পুনর্নির্মিত হয়েছে ছোট মিনার, জামে মসজিদ, খানদের সমাধি, পূর্ব সমাধি, উত্তর সমাধি, ব্ল্যাক চেম্বার, ইস্ট চেম্বার, উসপেনস্কি সাবর। এছাড়াও তৈরি করা হয়েছে নদী বন্দর, বুলগার ঐতিহাসিক জাদুঘর, বুলগারের ইসলাম গ্রহণের স্মৃতিস্তম্ভ, শ্বেত মসজিদ ইত্যাদি। এখানেই সংরক্ষিত আছে ৫০০ কেজি ওজনের বিশাল কোরআন। বলা হয়ে থাকে এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কোরআন। সেটাও একটি জাদুঘরে সংরক্ষিত। শুধু মাত্র ইসলামের বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এটা পাঠ করা হয়। এছাড়াও এখানে তৈরি করা হয়েছে ডাক্তারের বাড়ি, কারুশিল্পের কর্মশালা, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর আরকিওলজিক্যাল রিসার্চ, ইন্টারন্যাশনাল আরকিওলজিক্যাল স্কুল, রুটির জাদুঘর। খোলা আকাশের নীচে তুলে ধরা হয়েছে তুর্ক-তাতার লিপির ইতিহাস, বলগার শহরের মধ্যযুগের শিল্প। আমরা তিন জনেই বেশ সময় নিয়ে এসব জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি ভোলগা তীরের অন্যতম প্রাচীন শহরের ইতিহাস। সে কথা বলব পরের পর্বে।    

বুলগার ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=c_Vev2gHrTE&t=38s

ছবিতে বুলগার
http://bijansaha.ru/album.php?tag=188

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments