জ্বলদর্চি

অনন্তের চশমা জুড়ে কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা/গৌতম মাহাত


অনন্তের চশমা জুড়ে কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা

গৌতম মাহাত 

অন্য ভুবন : অন্য ভাবনা

কাব্য দর্শন নতুন কিছু নয়। কারণ কবির প্রথমিক লক্ষণই তো হল কালের বৃত্ত ছাড়িয়ে যাওয়া। তাহলে তা নিয়ে এত কথা বলারই আয়োজন কেন বাপু। তাছাড়া আর যাই হোক কবিতা তো আর প্রাথমিক চাহিদার পরিপূরক নয় তাই হালকা করে চেপে গেলেই ল্যাটা চুকেবুকে যায়। কি দরকার বাওয়া ফালতু কোপচে!... 

     না এ সব আমার কথা নয়, আর না তো কোনও কবির উক্তি, তবু এই স্তবকটা সামনে রাখলাম ক্যানো সে নিয়ে বিশদ তর্ক চলতে পারে। তাতে থাকতে পারে কিছু অসাংবিধানিক শব্দের ছটা। আপনি হতেই পারেন চার্বাকপন্থী কিংবা সাংখ্যবেত্তা! তা হোন... কিন্তু প্রাথমিক চাহিদার বাইরে একটা বৃহত্তর বৃত্ত সজ্জিত হলে তার বিচরণ আটকাব ত্যামোন সাধ্য আজও জুটিয়ে উঠতে পারিনি। বরং ধীরে ধীরে সেই বৃত্তটার পরিধি ব্ল্যাকহোলের মত ক্রমশ বাড়তে বাড়তে গ্রাস করে নিতে উদ্যত হচ্ছে এই সমসাময়িক বৃত্তটিকে। দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিশে যাচ্ছে আমাদের বার্তালাপের রসজ্ঞ বোধ। তাতে উদ্ভাসিত হচ্ছে কবিতা। 

      ঋত্বিকদার(কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী) সাথে কবে থেকে পরিচয় মনে নেই। তবে যেটুকু মনে আছে সেটা নিবিষ্ট বোধকেন্দ্রিক তাতে সন্দেহ নেই। আমার মনে হয় কবিতাকে স্বজন করতে হলে কবিতার পরিধির ঊর্ধ্বে  উঠতে হয়। পরিচয়টা সেখান থেকে আজও সেখানেই প্রদক্ষিণ হয়ে চলেছে। একটা জটিল তত্ত্বের দর্শনকে আলাদা কোণ থেকে ভিন্ন পর্যায় ভাবনার নিরিখ পরিবর্তন করে কত সাবলীল ভাবে কিছু বিষয়কেন্দ্রিক শব্দ ও প্রতিশব্দকে কবিতা পদবাচ্য করে তোলা যায় তা মস্তিষ্কপ্রেমী পাঠকদের খোরাকের কোনও খামতি যে রাখবে না তাঁর কবিতা সে কথা বিনা দ্বিধায় বলা যায়। 

       এখানে যে কাব্যগ্রন্থের কথা বলার জন্য দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকা করে চলেছি এতে পাঠকের সামান্য ক্লান্তি আসতে পারে, কিন্তু আমি নিরুপায়। 

"কীলক লিপিতে ভুমি ও ভূমা"★

কাব্যগ্রন্থটি পড়ার আগে একটা সতর্কীকরণ বার্তা কবি দিয়ে দিলে খুব ভালো করতেন--"এই গ্রন্থ আত্মস্থ করার পূর্বে সামান্য কাব্যশিক্ষায় ও দর্শনে শিক্ষিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।"
    পুনশ্চঃ কোনও বিষয়ে কোনও দায় কবির নয়।

'বালখিল্য কথাগুলির জন্য নিশ্চয় ভ্রূ-যুগল কুঞ্চিত করিয়া আমার উপর অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিবার অভিপ্রায় অন্তরে প্রতিপালিত করিয়া থাকিলে মার্জনা করিবেন।' এই কাব্যগ্রন্থের পরত ছাড়াতে গেলে অন্বেষণকারী হওয়া দরকার। কবি প্রতিটি কবিতাতেই বিবাগীর বিচরণী আচরণ প্রদর্শন করে শূন্যের দিকে মুগ্ধতা ছড়াতে ছড়াতে হেঁটে চলে যাচ্ছেন আর আপনিও পাতি সেই স্টান্ট দেখতে দেখতে সম্মোহিত হতে হতে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা মত কবি সাথে পায়ে পা মিলিয়ে মিশে যাবেন অনন্তের উদ্ভাসিত আলো আর ইচ্ছেদিঘির স্নানে।
    কিন্তু কি আশ্চর্য আদতে এই সৌন্দর্যময়তা আসলে একটা বাবল, মায়া। এই আত্মোপলব্ধি যখন আপনার হবে ততক্ষণে সব সাঙ্গ হয়ে গ্যাছে। তাই আবার শুরু করতে হবে শুরু থেকে। কিন্তু কি আশ্চর্য দেখবেন, এতে কোনও ক্লান্তি নেই, শ্রম নেই, উপলব্ধি বা বোধ কিছুই নেই,-"হাতে থাকল পেনসিল", মানে 'মায়া'। এই মায়া কি বোঝাতে গিয়ে কবি তুলসি দাস-র (রামচরিত মানস)একটি অসাধারণ উক্তির মনে পড়ে যাচ্ছে--
 
"জল মে কুম্ভ কুম্ভ মে জল হ্যায়
বাহার ভিতর পানী
ফুটা কুম্ভ জল হি সমানা
ইহ তত্ত্ব জানো জ্ঞানী।।"

   কবি সেই মায়াকেই বারংবার আপনার সামনে এনে দাঁড় করাবেন, আর মুগ্ধ করবেন, যা মায়ার প্রধান চরিত্রের মধ্যে একটি। মানে তিনি মায়ার কথাই বলবেন এবং মায়াকে দিয়েই মায়ার সাকার সাক্ষাৎ (practically visit) করাবেন। তাই বইটির কোনও শব্দকেই হালকা ভাবে নিলে গোল বাধার সম্ভাবনা ততোধিক বেড়ে যাবে। যেমন কাব্যগ্রন্থটির নামকরণটিই ধরা যাক। "কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা" এখানে তিনটি শব্দ বন্ধের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে-(১) কীলক লিপি (২) ভূমি (৩) ভূমা। ক্যানো??
    মোটামুটি তিনটি শব্দেরই আমরা অর্থ জানি কিন্তু সাযুজ্য প্রায় ভ্যানিস। তাহলে কবি এত উদ্বায়ু কথাকে গুরুত্ব দিলেন ক্যানো। 
        এই বোধটির আস্বাদ নিতে গেলে মূল শিল্পটি প্রতিষ্টা করতে হবে। আর সেটা হলেই আমরা জানি কিছু আনুষাঙ্গিক শিল্পেরও জন্ম হয়। এখানে আনুষঙ্গিক শিল্পগুলি হল- বৌদ্ধ, জৈন ও সনাতন দর্শন। পাশ্চাত্য দর্শন, ট্রিনিটিবাদ, নোয়াম চমস্কি। ব্যাকরণ। অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্স ও হকিং থিওরি। রসমঞ্জরী, আনন্দবর্ধন, অলঙ্কার শাস্ত্র এবং কিছুটা দ্বন্দ্ব। 

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 

     তাই এই কাব্য বুঝতে হলে "ডিকোড"-র কৌশল জেনে নিতে হবে। এখন সমস্যা হল এগুলোর সামান্যতম ধারণা না থাকলে আপনি কবিতায় অবগাহন থেকে বঞ্চিত হবেন এবং আমার মত অকালকুষ্মাণ্ডের পক্ষে কবিতাগুলির ব্যাখ্যা করতে গেলে 'ছাত্রবন্ধু' রচিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবুও চেষ্টা তো করাই যায়... সেই ভরসা নিয়ে সামান্য এগোনো যেতেই পারে, কি বলেন? আসলে কবি আমাদের এক, দুই কিংবা ত্রিমাত্রিকতা ছাড়িয়ে বহুমাত্রিকতায় নিয়ে যেতে চান। এবং যেতে যেতে তিনি ফেলে ফেলে যান কিছু সংকেত(key)। এই সংকেতগুলি আপনাকে একটা একটা করে কুড়িয়ে নিয়ে শেষ অবধি পৌঁছোতে হবে খুব সাবধানে সন্তর্পনে। একান্তে। এবার সব সংকেতগুলি উন্মোচিত করুন একে একে। দেখবেন পেঁয়াজের খোসার মত খুলে যাচ্ছে এক একটা পরত।

    এবার পেছনের আলোচনায় ফিরে যাওয়া যাক, মানে নামকরণের সেই আলোচনায়। দেখি এর মধ্যে কি কি স্তর রয়েছে! কবি একদিকে য্যামোন ত্রিরত্ন বিন্দু থেকে ধরার চেষ্টা করছেন তেমনি ট্রিনিটিকেও ছাড়তে পারছেন না। আস্ত্বিক্যবাদের কথা বলতে বলতে নাস্তিক্যবাদে অবলীলায় বিচরণ করেছেন। কীলক লিপি বলতে কবি এখানে প্রথম বা আদি লিপিকে বোঝাতে চান। আমরা জানি কীলক লিপি মেসোপটেমীয় আদি লিপি। কিন্তু কবি এখানে সেই লিপিকে ব্যঞ্জনার রঙে চুবিয়ে তৈরী করলেন আমাদের সত্তার বা আত্মার লিপির রংমশাল। পরের দুটি শব্দ 'ভূমি' ও 'ভূমা'। এবার প্রশ্ন এসে যায়- ভূমি আগে ক্যানো? বা বলা যায় "ভূমা ও ভূমি" নয় ক্যানো! কারণ ট্রিনিটি বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনের বীজে ত্রিরত্নের কথা ও ট্রিনিটারিয়ান সম্পর্ককে কাব্যে নিজস্বতায় উদ্গিরণ করতে গিয়ে তিনটি বিন্দু বা স্তম্ভের অবতারণ করেছেন। ভূমি আগে কারণ কবি প্রকৃতি আর পুরুষের মধ্যে প্রকৃতিকে এগিয়ে রাখতে চান। মানে মেটিরিয়ালস্টিক বোধ, বস্তুবাদ সব পরিমান মতো মিশিয়ে পাঠকের মস্তিষ্কে একটা স্বাদু বিষ্ফোট ঘটাতে চান। তাই কবির কাছে আগে প্রকৃতি(যা মায়ায় আচ্ছাদিত) এবং পরে অপৌরুষেয় নিস্কর্মা নিরাকার পুরুষ। এই পর্যায় পর্যন্ত তো ঠিক আছে কিন্তু এখন আবার একটি প্রশ্ন এসে সামনে দাঁড়িয়ে পড়বে আপনার। সে বলবে- "ওহে তুমি যে বললে ট্রিনিটরিয়ান সম্পর্ক ও ত্রিরত্নের আধারে আধারিত, তবে! দুটো তো দেখছি-'ভূমি' ও 'ভূমা' আরেকটি কই? এখানেই কবির আস্তিনে লুকোনো ট্রাম্প কার্ড। আপনার হাতে তুলে তো দিয়েছেন কিন্তু কখন খেলবেন এবং ক্যামোন ভাবে খেলবেন সেটা আপনার ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভর করবে। এখানে এই তৃতীয় স্তম্ভটি হল 'আত্মা'। যে কিনা এই দুজনের মাঝে সেতুর মত সংযোগ স্থাপন করে চলে। এই আত্মা সেই আস্তিক্য দর্শনের আত্মা নয়! কবি এখানে ব্যঞ্জনাকে ছাপিয়ে লক্ষণাকে প্রধান করে তুলেছেন। এখানে 'আত্মা' হল আত্মসত্তা, বোধ। যা উহ্য। 

আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন--বইটির আলোচনায় এই ত্রি বা Trioকেই বা এত ক্যানো প্রাধান্য দিচ্ছি! এর উত্তর আপনি পাবেন ভেতরের কবিতাগুলি থেকে। বেশিরভাগ কবিতাই এই Trio কেন্দ্রিক। সেটাই মুখ্য সংকেত। যেমন ধরুন 'দ্বিখণ্ডিত' নামক কবিতাটি। কিংবা মহাকবির ব্যঞ্জনা ইত্যাদি। 
       এরকম আরও বহু উদাহরণ রয়েছে ছত্রে ছত্রে, কিন্ত কবিতা ধরে ধরে আলোচনা করলে এবার নির্ঘাৎ আপনাদেরও ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটতে পারে, আমারও। তাই এর দ্বিতীয় পর্বে কবিতা ধরে ধরে আলোচনা করা যাবে কিন্তু আজ এটুকুই না হয় থাক।

 বইটি প্রকাশ করেছে- 'সিগনেট'(আনন্দ পাবলিশার্স) 
প্রচ্ছদ : দেবাশিস সাহা
মূল্য- ২৫০/-

🍂

Post a Comment

2 Comments

  1. দারুন আলোচনা। পরের পর্বে অবশ্যই পড়বো।।

    ReplyDelete
  2. Valo hoye6e alochana

    ReplyDelete