জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —৪০/সুমিত্রা ঘোষ



লোকমাতা রানি রাসমণি —৪০
সুমিত্রা ঘোষ 

রাধাকান্ত দেবাহাদুর বলেন ঐ জমি বাড়ুজ্যে জমিদারের দশআনি/ ছয়আনি জমির অন্তর্ভুক্ত। রানি রাসমণি বলেন জমিদারের জমিতে ঘাট বাঁধাই করা হয়নি ঐ জমি মা গঙ্গার জমি কারণ একেবারে গঙ্গার গা ঘেঁষে ঘাট বাঁধাই করা হয়েছে। ইতিমধ্যে জমিদারের লেঠেল বাহিনী প্রীতরাম দাসের আড়তে আগুন ধরিয়ে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করল। প্রীতরাম দাসের পরিবারের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজেরও বিরোধ শুরু হয়। সেই সময় অঘোরনাথ শাস্ত্রী মহাশয় ছিলেন ওই জমিদারের মাথাস্বরূপ এবং ব্রাহ্মাণসমাজের সর্বেসর্বা।  অঘোরনাথ শাস্ত্রী মন্তব্য করেন হালিশহরে রানির গ্রামে ঘাট বাঁধাই বে-আইনি হয়েছে। রানির বক্তব্য নদীর পাড় ঘেঁষে ঘাট তৈরি হয়েছে।গঙ্গার পাড়ের সমস্ত জমি মা গঙ্গার সম্পদ।

জানবাজারে প্রীতরাম দাসের ফ্যামিলিতে শত্রুর অভাব ছিল না। প্রীতরাম দাসের ছোটভাই কালীচরণ ছিলেন খুব ভালমানুষ, তিনি এই পরিবারের মঙ্গল কামনা করতেন এবং দাদা-প্রীতরাম দাস ও বৌদি মায়াদেবীকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন কিন্তু কালীচরণের স্ত্রী এবং পুত্র সর্বদা এই পরিবারের অনিষ্ট চিন্তা করত এবং বাইরের শত্রু ডেকে এনে মাড় পরিবারের ক্ষতি করত। রাজচন্দ্র দাসের খুড়তুতো ভাই অভয় প্রথম বিবাহিতা স্ত্রীকে ত্যাগ করে আবার দ্বিতীয়বার বিয়ে করে রাসমণির সংসারে ঘোর অমঙ্গল ঘটায়। জানবাজারে রাজবাড়ির শত্রুর কাহিনি বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যায়। রানি রাসমণি স্বামী রাজচন্দ্র দাসের মৃত্যুর পর ক্ষুরধার বুদ্ধি বিবেচনা, মনের জোর, সাহস এবং ইষ্টদেরের প্রতি অত্যধিক ভক্তির দ্বারা সমস্ত বিপদ কাটিয়ে উঠেছেন। রানি যতদিন ইহলোকে ছিলেন ততদিন মেজো জামাই মথুরামোহন বিশ্বাসের পরামর্শ ও সহযোগিতায় অনেক বাধা অতিক্রম করতে পেরেছেন। মন্দির প্রতিষ্ঠায় সময় রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রানিকে যে ভাবে সাহায্য করছেন তা ইতিহাস হয়ে আছে। রামকুমার ভৈরবী মায়ের নির্দেশে গদাধরকে মা ভবতারিণীর পূজারি নিযুক্ত করে যান।
🍂

কলকাতার দক্ষিণেশ্বর মন্দির জগৎবিখ্যাত কালীমন্দির, যে মন্দির নির্মাণ স্বয়ং জগন্মাতা রানি রাসমণিকে দিয়ে করিয়ে নিলেন। ১২৫৪ বঙ্গাব্দে রানির বাসনা হল কাশীতে গিয়ে বিশ্বেশ্বর দর্শন করবেন। সেই সময় কিছু কিছু জায়গায় রেলপথ হলেও কলকাতা থেকে কাশী পর্যন্ত রেল চালু হয়নি। জলপথেই যেতে হবে। আর যাবেন কে? কলকাতার বিখ্যাত ধনী রানি রাসমণি। রানির কাশী যাওয়ার সৌজন্যে পঁচিশখানি বজরা তৈরি হল। রানি যাবেন বিশ্বেশ্বর দর্শনে। তাই তোড়জোর শুরু হল। রানির জন্য সুসজ্জিত বজরা তৈরি করানো হল। সঙ্গে যাবেন দাস-দাসী, আত্মীয়স্বজন  ও বিভিন্ন প্রকার খাদ্যসম্ভার। এই সব ছাড়া রানির ছোট মেয়ে জগদম্বা ও  জামাই মথুরামোহনও যাবেন। এঁরা দুজন রানিকে সদা-সর্বদা সুনজরে রাখতেন। ১২৫৪ বঙ্গাব্দে রানি রাসমণি কাশী যাওয়া মনস্থির করলেন। তখন রাজচন্দ্র দাস জীবিত নেই, ১২৪৩ বঙ্গাব্দে (ইং১৮৩৬ সালে) মাত্র উনপঞ্চাশেই সন্ন্যাস রোগে ইহলোক ত্যাগ করলেন।

অনুমান করা যায় ওই সময় রাজচন্দ্র দাসের সম্পত্তির মূল্য ছিল আশি লক্ষ টাকা। রাজচন্দ্রের  দাস পরিশ্রম করে সম্পত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি  করেছেন। রাজচন্দ্রের অবর্তমানে রানি বিপুল সম্পত্তির অধিকারিণী হয়েও ধৈর্য হারাননি। রানি ছায়ার মত স্বামীর সমস্ত কাজে উৎসাহ উদ্দীপনা জুগিয়েছেন।  জমিদারি পরিচালনার ব্যাপারে তার কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। সেই সময় অনেকে ভেবেছিলেন রানি বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবেন না। কিন্তু বিচক্ষণ রানি মেজো জামাই মথুরাকে নিয়ে দিব্যি জমিদারির কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। প্রবল বাঁধা বিপত্তি ও শত্রুর  মুখোমুখি হতে হয়েছে রানিকে। কিন্তু তিনি পথভ্রষ্ট হননি। স্বামীর আদর্শ মাথায় রেখে ঠান্ডা মাথায় কাজে চালিয়ে গিয়েছেন। তবে একথা মানতেই হবে রাজচন্দ্র দাসের অকাল প্রয়াণের পর রানি মথুরামোহনকে নিয়ে জমিদারি পরিচালনা করতে পেরে ছিলেন। মথুরামোহন হিন্দু কলেজের নাম করা ছাত্র ছিলেন এবং রানি রাসমণির ডান হাতে স্বরূপ ছিলেন।

Post a Comment

0 Comments