জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( দ্বিপঞ্চাশত্তম পর্ব ) /শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী- আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত ( দ্বিপঞ্চাশত্তম পর্ব ) 

শ্রীজিৎ জানা

ঊমানাথ ঠাকুরের মুখ গম্ভীর দেখায়। খগেন মাস্টার তখনও কিছু বলতে চায়। লোখা এবার উসখুশ করে। তার ধৈর্য্য আর থাকে না। এম্নিতে সে গল্পবাজ। একনিষ্ঠ শ্রোতা। কিন্তু এবার সে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছে না। কথার মাঝে আঁচড় কাটতে চায়। বলে,
– একটা কথা বোলবো, মেস্টার। কিছু মনে কোরবেনি ত। আপনিও কিছু মনে কোরবেননি ত স্যার।
খগেন মাস্টার কিছুতেই সম্মতি দিতে চায় না। সে লোখার ধাত জানে। হঠাৎ কথার মাঝে বেমক্কা একটা কথা গুঁজে দেবে সে। কিন্তু তাকে বাধা দিলেও বিপদ। মাস্টারের মুখ খোলার আগেই ঊমানাথ ঠাকুর সম্মতি দেয়।
– মনে করার কি আছে। বলো, বলো, কি বলতে চাও।
– না, মানে মেস্টারকেই বোলতে চাচ্চি কথাটা। এই যে কুন রাজা শোভা সিংহর কথা মেস্টার বোলচে। সেটা শুনতে ভালোই লাগচে। কুন্তু যেটুকু বুজলম, তার জাত লিয়ে সবাই রঁজমজ কোচ্চে। রাজা বাগদি নাকি অন্য জাতের! এখন পশ্ন হচ্চে মেস্টার, সে বাগদি হোলে মোদের কি লাভ? অন্য জাতের হোলেই বা কি? সেই রাজাও নাই, তার রাজত্বও নাই। তাকে বাগদি পমাণ কোরে মোদের কুনু দুখ্যু মিটবে কি?
গ্রামে হলে মাস্টার একটা ঝাপড় নিত লোখার উপর। এখানে সে নিরুপায়। গায়ের রাগ গায়ে মেখে নেয়। অপ্রস্তুত মুখে ঊমানাথ ঠাকুরের দিকে তাকায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ঊমানাথ ঠাকুরই এগোয়,
–এতে সুখ দুঃখের ব্যাপার নয়। আসলে তোমার জাতের একটা গৌরবময় অধ্যায় আলোআঁধারে পড়ে আছে। তার প্রকৃত স্বরূপ বাইরে আসা দরকার। জাতিস্বত্বার গৌরব যদি না তোমাকে আনন্দ দেয় তাহলে তোমাকে ধিক্! তোমাদের জাতের একটা রাজা ছিল এই অঞ্চলে। সে রাজত্ব করেছে দাপটের সঙ্গে। মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। অথচ তোমাদের হীন চোখে দেখি আমরা। তোমরা নিজেরাও নিবজেদেরকে ছোট ভাব। এই দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে ওই অতীতের গৌরবকে জানতে হবে। নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। খগেন্দ্র এই নিয়েই লড়াই করছে নীরবে। তোমাদের তার পাশে থাকা উচিত।
–উ লড়াইয়ের কুনু মূল্য নাই,স্যার। মোদের জাতটাই অভিশপ্ত জাত। অ্যারা নিজের ভাল কিসে কুনু দিন বুজলনি। আর কেউ বুজাতে এলে,ঘুরে তার-ই পিছানে লাগবে। এই মেস্টারকেও কি ছেড়ে কথা বলে মোদের গেরামের লোক। আমি অত পড়াশুনা করিনি। ইতিহাস ভূগোল জানিনি। সুদু জানি মোদের জাতকে বেবহার করেচে, এখনো কচ্চে সকলে। আর অ্যারা যেন অপরের দাসত্ব কত্তেই জন্মচে। বাপ বোলতো,বাগদির হাড়েও উন্নতি নাই। 
🍂

হয়তো তাল কেটে যাচ্ছে আলোচনার। কিন্তু মাস্টার বুঝতে পারে কথাগুলো তো একবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কবে নিজেদের ভালটা বুঝতে পারবে বাগদিরা! কবে নিজেদের গৌরবময় ইতিহাসের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনবে! লোখার কথা অযৌক্তিক নয় মোটেই। তবু তার কথার মাঝে রসিকতা করে মাস্টার,
— কেন রে! হাড়ে উন্নতি নাই কেন? জানেন স্যার, অর সেরা ডায়লগ,বাগদিকে দমানা অত সজা নয়,অন্য জাতের হাড় দু'শ ছ'টা। বাগদির দু'শ সাতটা, একটা বেশি!
– এটা শুধু ও বলে এমনটা নয়,খগেন্দ্র। আমি কথাটা তোমাদের বহু লোকের মুখে শুনেছি। তোমাকে আগেও বলেছি, এই হাড় আসলে প্রতীকী। রাজা নিজের জীবন ও রাজত্ব বাঁচাতে দধীচির অস্থি চেয়ে বসল। প্রাণ দিল বেচারা দধীচি। তৈরি হল বজ্র। রাজার হাতে শোভা পেল সেই অস্ত্র। রাজা হল ভগবান। যুগে যুগে রাজাকেই আমরা দেবজ্ঞানে পূজা করে এসেছি। কে এই দধীচি? কেন তার অস্থিই প্রয়োজন হল অসুর দমনে?এখানেই রাজার কূটনৈতিক চাল লুকিয়ে আছে।
— লুকানার কিছু নাই, স্যার। সেকালে দধীচির হাড়ে মেরেছে অসুরকে।একালে বাগদিদের দিয়ে মারছে বাগদিকে। ওই হাড়টাকে চিরকাল ব্যবহার করেছে রাজারা। কুনু বদল ঘটেনি। তখন ছিল রাজার যুগ,এখন হইচে নেতা- মোনতিরির যুগ। বাগদির একটা হাড় সত্যিই বেশি আছে। কুন্তু হাড়টা শুদু পয়সাবালাদের,নেতাদের বেগার খাটতে, লাঠি ধরতে জানে। নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াইটা লড়তে জানেনি। মেস্টার লড়ছে, লড়ুক। আমি কুনু দিন তার সঙ্গ ছাড়বোনি। কুন্তু আমি জানি,মেস্টারের এই লড়াই বিথাই যাবে।
–এতটা হতাশ হওয়ার কিছুই নেই। আগের চেয়ে তো অনেক সচেতন হয়েছো তোমরা। দারুণ পড়াশুনা করছে তোমাদের ছেলেমেয়েরা। চাকরি করছে। প্রশাসনের চেয়ারে বসছে। আগের থেকে অবস্থা অনেক পাল্টে গেছে।
—পাল্টিছে,অনেকটাই পাল্টিছে। কুন্তু পরের হাতের বাঁদর হোয়ে লাচার অভ্যাসটা এখনো পাল্টায়নি। যারা এক গেলাস মদে আর দু'দশ টাকা ট্যাঁকে গুঁজে দিলে লোকের চাকর খাটে তাদের বদলানা মুশকিল। এরা ত নিজেরাই বদলাতে চায়নি। জানে হুড়কামি করেই জগতটাকে জয় করে লিবে। আর পশাসনে বসার কথা! উটা দারুণ খেলা। বাগদির ঘাড়ে বোন্দুক রেখে শিকার কত্তে সব দলই অস্তাদ। ইদিকে মোদের যারা নেতা হয়,তাদের ভাবটা যেন রাজা- জমিদার। আসলে ভাঙা গাঁয়ে শিয়াল রাজা। জানি,মেস্টার মোর ইসব কথা শুনে রেগে খোঁচে যাচ্চে। যাউ,মোর কিচ্ছু যায় এসে নি। লোকটা ঘরের খেয়ে বিলের মোষ তাড়ায়। মোর ইচ্ছা করেনি। তবু বাধ্য হয়ে থাকি। লোকটাকে ছাড়তে পারিনি।
খগেন মাস্টার আর চুপ থাকতে পারে না। লোখাকে থামাতে চায়। ঊমানাথ ঠাকুরের সঙ্গে আগের আলোচনায় ফিরতে চায়।
—উসব কথা ছাড়ুন তো, স্যার। উ একবার কথা শুরু করলে সহজে থামে না।অর একটু বাজে বকার অভ্যেস আছে।
— না, খগেন্দ্র,ওর সব কথা তো আর ফ্যালনা নয়। তবে তোমাকে বলি বাপু, এতটা নিরাশ হোয়ো না। একটা গোষ্ঠীর জাগরণের আন্দোলন সহজ কথা নয়। সেই চেষ্টা চালাতে হবে নিরন্তর। কেউ সহজে কাউকে মাথায় স্থান দেয় না।
— সেইজন্যই বারবার ছুটে আসি আপনার কাছে। এই জাতাটার শিকড়ে পৌঁছাতে চাই। অতীতের যত গৌরব-গাথা জড়িয়ে আছে তাকে বর্তমানের সামনে রাখতে চাই। অন্যরাও দেখুক। আমাদের জাতের নতুন প্রজন্মরাও গর্বিত হোক তাদের জাতিসত্বার গরিমায়। সেইজন্যই তো এই ঢোল পরিবেষ্টিত ভূভাগের যিনি অধিপতি ছিলেন, তাঁকে জানা আবশ্যক নয় কী!
–বলো, তুমি আর কি জানতে চাও?
– আসলে আরও একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরে। কোন উত্তর পাইনি কোথাও। ধরে নিলাম শোভা সিংহ রাজপুত।অথচ কোথাও তার রাজপুত সত্ত্বার চিহ্ন মিলবে না। তার ধর্মীয় আচার আচরণে কোথাও রাপুত সুলভ ধর্মাচরণের প্রকাশ মেলে না। দ্বিতীয়ত শোভা সিংহের রানীর আত্মরক্ষার কাহিনীটির কোন সারবত্তা আছে বলে মনে হয় না। অনেক ঐতিহাসিক কোন উল্লেখ পর্যন্ত করেন নি।শোভা সিংহের মৃত্যুর পর রাজ্যের দায়িত্ব নিলেন হিম্মৎ সিংহ। তাঁর আমলে বরদা আক্রমণ করলেন বর্ধমানরাজ। শোভাসিংহের বিধবা রানী সহ কয়েকজন অন্তঃপুরিকা নিজেদেরকে বাঁধলেন একটি নৌকার সঙ্গে। আর বর্তমান বিশালাক্ষী মন্দিরের পিছনের দিঘিতে ভাসিয়ে দিলেন। যদিও নৌকাতে আগে থেকেই ফুটো করা ছিল।এটাকে কি রাজপুত মহিলাদের জহরব্রত বলে আপনি মনে করেন?
–আসলে কি জান খগেন্দ্র,প্রথমত,এই কাহিনীকে আমার খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।অনেকটা ওই রাপুত ভাবধারাকে জোর করে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তবে এটাও সত্যি চন্দ্রকোণা এলাকায় জহোরাপুকুর বলে একটা পুকুর আছে শুনেছি।
–সব যেন তালগোল পাকিয়ে যায়। অতীত মনে রাখার দায় কার আছে! যাদের মনে রাখার প্রয়োজন ছিল,তারা নিজেরাই হারিয়ে গেছে অন্ধকারের অতলে। আর যারা দায় নিয়েছিল,তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের ধ্বজা উচ্চে তুলে ধরেছে। দেখুন কি মজার বিষয়, শোভা সিংহের বিধবা স্ত্রী জহরব্রত পালন করলেন। অথচ হিম্মৎ সিংহের মহিষীর কোন উল্লেখ নেই কোথাও। তিনি কি অকৃতদার ছিলেন? কিন্তু তাঁর চরিত্র সেকথা আদৌ প্রমাণ দেয় না।
– এখানে আমিও একটা বিষয়ে ভাবি। শোভা সিংহের রাজত্বকাল ১৬শ শতকের মধ্যভাগ। ওদিকে নাড়াজোল খান জমিদারদের উত্থান প্রায় ১৪শ শতক থেকে। শোভা সিংহের রাজধানী রাজনগর থেকে নাড়াজোলের দুরত্ব মাত্র কয়েক কিমি। সহজ করে বললে কালসাবা আর বাছড়ার মাঠ পেরোলেই হল। অথচ দুটো বংশের সঙ্গে কোনরকম শত্রুতা কিংবা মিত্রতার যোগ মেলে না। এটা ভারি আশ্চর্যের।এদের ধর্মীয় আচারের একটা তফাৎ দেখা যায়। দুই পরিবারই দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। দেবীর প্রতিষ্ঠা ও পূজা করেন। তার মানে উভয়েই শাক্তপন্থী। কিন্তু খান রাজপরিবারের দেবী বলি গ্রহণ করেন না। খানেরা অনেকখানিই বৈষ্ণব ভাবে চলে না। অন্যদিকে সিংহ রাজবংশের দেবী ছাগ বলি গ্রহণ করেন। আরও একটি বিষয় খান বংশের লেঠেল বাহিনীতে বাগদিরা থাকলেও,প্রধান দলপতি কিন্তু ওই জাতের নয়।
— এইসব বিষয়ের মধ্যদিয়ে আসলে আপনি কোন দিকের ইঙ্গিত করতে চাইছেন,স্যার।
–আমি কোনোদিকের প্রতি ইঙ্গিত করছি না। এমনকি কোন মতকে জোর করে চাপাতেও চাইছি না। আমার মনে হওয়া টুকু তোমাকে জানাচ্ছি। আমার মনে হয় খান পরিবার জাতিগত প্রশ্নে, শোভার চারিত্রিক দোষের প্রশ্নে, হিম্মতের অত্যাচারের প্রশ্নে হয়তো শতযোজন তফাৎ বজায় রেখেছিল। সেক্ষেত্রে খান পরিবার মেদিনীপুরমুখি ছিল বেশি।
কথার রেস থামছে না দেখে, লোখা এবার সরাসরি বলতে বাধ্য হয়।
– মেস্টার, রাত হচচে। এবার থাম। আজগে চল,পরে এগদিন আসব খন।
খগেন মাস্টার লোখার অস্বস্তি বুঝতে পারে। ঊমানাথ ঠাকুরকে বলে,
– হ্যাঁ স্যার, লোখা ঠিকই বোলেচে। আমি খেয়ালই করিনি। রাত হচ্চে। এবার উঠি। পরে একদিন আসব।
– আরে উঠবে কেন! বোসো, রাতে খেয়ে যাও।
– আজ থাক স্যার।
বলেই সটান উঠে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে খগেন মাস্টার। লোখাও তাই করে। উমানাথ ঠাকুর দরজার কাছ করে এগিয়ে দিয়ে যায় দুজনকে।

Post a Comment

0 Comments